৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এরপর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সরকার গঠন হয় ৮ আগস্ট। এর মাঝখানে দেশে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে। প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর স্বল্প উপস্থিতির কারণে কিছু মানুষ পরিস্থিতির সুযোগ নিতে চেষ্টা করে। গণভবন, সংসদ ভবনসহ বিভিন্ন এলাকায় অরাজকতা তৈরি হয়। পরিবর্তিত এ পরিস্থিতি সামলাতে দায়িত্ব পালন করে শিক্ষার্থীরা। এদের মধ্যে কেউ সড়ক সামলায়, কেউ গণভবন ও সংসদ ভবন পরিস্কারে অংশ নেয়। নিরাপত্তা দিতে এলাকায় এলাকায় পাহারার কাজ করে অনেকে। সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে কেউ দেয়াললিখন করে। এ ছাড়া বিভিন্ন এলাকা পরিস্কার করাসহ সড়ক বিভাজকে গাছও লাগিয়েছে শিক্ষার্থীরা। এ সব কাজে অংশ নেওয়া কয়েকজন শিক্ষার্থীর কাছে আমরা জানতে চেয়েছি তাদের অভিজ্ঞতা ও অংশগ্রহণ নিয়ে। আজ থাকছে ডাকাত ধরতে বের হওয়ার অভিজ্ঞতা। আসহাবিল ইয়ামিনের গ্রন্থনায় বিস্তারিত।
৫ আগস্ট স্বৈরাচার পতনের পর নানা রকম ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে গেছে দেশ। পরিস্থিতি এমন ছিল যে বেশ কিছুদিন আইন-কানুন, প্রশাসন ছাড়াই বসবাস করছিলাম আমরা। আমাদের দেশে এমনিতেই আইন মানতে চায় না মানুষ। তার ওপর দেশে যখন পুলিশ বাহিনী নেই, তখন কিছু মানুষ এই পরিস্থিতির সুযোগ নেবে, এটাই তো স্বাভাবিক। যেহেতু দেশে এত বড় একটা পরিবর্তন হয়েছে, সেহেতু ছোটখাটো অসুবিধা মেনে নিতেই হবে। আমি মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা। যেখানে মাঝেমধ্যে দিনদুপুরে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। সেখানে রাতে চুরি-ডাকাতি করা আরও সহজ। তাই নিজের পরিবারের এবং এলাকার মানুষের নিরাপত্তার কথা ভেবে এগিয়ে আসা আমাদেরই দায়িত্ব। নতুন বাংলাদেশ গঠনের এই কঠিন সময়ে আমরা এগিয়ে না গেলে আর কারা আসবে?
আমাদের কাজকে ভালোভাবেই নিয়েছিল এলাকাবাসী। বিপদের সময় নিরাপত্তার কথা ভেবে আমরা যে সামনে এসে দাঁড়িয়েছি, সে জন্য এখনো অনেকের কাছে প্রশংসা পাই।
শুরুতে শুনেছি অন্যান্য এলাকায় অনেক ডাকাত পড়েছে। আমরাও ভেবেছিলাম যদি সাহস করে চলেই আসে, দু-একটা ডাকাত কিংবা চোর ধরতে তো পারবই। সেই অনুযায়ী প্রস্তুতিও নেওয়া ছিল আমাদের। কিন্তু ভাগ্য খারাপ, একটা চোর-ডাকাতেরও দেখা পাইনি। মাঝেমধ্যে সেনাবাহিনী টহল দিচ্ছিল। সেনাসদস্যরা গাড়ি থেকে জিজ্ঞেস করেছেন যে আমরা কী করছি। অন্য রকম অভিজ্ঞতা হয়েছে ওই কয়েকটি রাতে।
এমনিতে আমি রাত জাগতে পারি। কিন্তু কাজ করতে গেলে যে এত ঘুম আসে, তা এই কাজ করার আগে জানতাম না। সে জন্য গলিতেই রাতের বেলা ফুটবল-ক্রিকেট খেলেছি রাতে। খেলতে গিয়ে দেখেছি অনেকেরই অসুবিধা হচ্ছে। তা-ও এলাকাবাসী তেমন কিছু বলেনি। পরে অবশ্য গিয়ে কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করেছেন অনেকে।
এলাকা পাহারা দিতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি ঝামেলায় পড়েছি মানুষের অভাবে। পুরো এলাকার ছোটখাটো গলি পাহারা দিতে লাগত ৩০-৩৫ জন। সেখানে আমরা ছিলাম মাত্র ১৬-১৭ জন। তারপর আবার অনেকেই সারা রাত থাকতে পারে না। এ জন্য আমরা ভাগ হয়ে প্রতিটি গলির মুখে ছিলাম। কিছুক্ষণ পরপর সবাই সবার খোঁজ নিচ্ছিলাম, সব ঠিক আছে কি না। কেউ ভয় পাচ্ছে কি না। সুনসান নীরবতার মধ্যে বাতাসে একটি কাগজ উড়ে গেলেও গা একটু শিরশির করে উঠত।
প্রথম দিন এত রাতে বাসা থেকে বের হতে দিতে চায়নি। যখন দেখল সবাই বের হয়েছে, তারপর আমাকেও বের হতে দিয়েছিল। তবে রোজ রোজ যাওয়াটা পছন্দ করেনি। তা–ও আম্মুকে রাজি করিয়ে রাতে ক্রিকেট খেলতে নামতাম।
কাজটা অনেক বড় কিছু না, তবে নিজের এলাকার নিরাপত্তায় ছোট্ট একটি অবদান রাখতে পারা আমার জন্য অনেক। আমি গিয়েছিলাম নিজের বিবেক ও দায়িত্ববোধ থেকে। প্রথমে ভেবেছিলাম যত দিন নিরাপত্তারক্ষীরা না ফিরছেন, তত দিনই থাকব রাস্তায়। যদিও এখন পুলিশ ফিরে এসেছে ধীরে ধীরে, দেশ স্বাভাবিক হচ্ছে। তবু আমরা এখনো সচেতন। দরকার হলে আবারও নামব রাস্তায়। শুধু এটুকু বলতে চাই শিক্ষিত, দুর্নীতিমুক্ত, সবার জন্য নিরাপদ, অর্থনৈতিকভাবে স্থিতিশীল, বাসযোগ্য একটি দেশ চাই। যেখানে দিন-রাত সব সময় সবাই নিরাপদ।
রাফিউল হাসান, এইচএসসি পরীক্ষার্থী, ঢাকা সিটি কলেজ