গণিতের মজা : কেন বারবার কিশোর আলোই আসে?

অনেকেই হয়তো এর মধ্যে কিশোর আলোর ফেসবুক পেজে একটা মজার গাণিতিক খেলা দেখেছ, যেখানে কতগুলো ছোট ছোট অঙ্ক কষে সবচেয়ে প্রিয় জিনিসকে খুঁজে বের করতে হয়। কীভাবে বের করতে হয়, শুরুতে সেটাই দেখে নেওয়া যাক।

প্রথমে ১ থেকে ৯ পর্যন্ত যেকোনো একটা সংখ্যা ভাবো। সংখ্যাটিকে তিন দিয়ে গুণ করো, গুণফলের সঙ্গে তিন যোগ করো। যোগফলকে আবারও তিন দিয়ে গুণ করো। শেষ গুণফলে দুটি অঙ্ক আছে, অঙ্ক দুটি যোগ করো। যোগফল যত আসবে, নিচের তালিকার তত নম্বর জিনিসই তোমার সবচেয়ে প্রিয়।

তালিকায় আছে, ১. মুভি, ২. পাহাড়, ৩. পাঠ্যবই, ৪. চকলেট, ৫. চা/কফি, ৬. টিভি সিরিজ, ৭. সমুদ্র, ৮. তিন গোয়েন্দা, ৯. কিশোর আলো, ১০. অ্যানিমে, ১১. মোবাইল এবং ১২. গেমস।

তুমি কি মনে মনে কোনো সংখ্যা ভেবে হিসাব করে দেখেছ? না দেখে থাকলে চট করে একটা সংখ্যা ভেবে হিসাব করে দেখো। কী পেয়েছ? সত্যিই কি ওই জিনিস তোমার সবচেয়ে প্রিয়? আচ্ছা, যদি তুমি ওই সংখ্যা না ধরে অন্য সংখ্যা ধরতে? অন্য একটা সংখ্যা ভাবো এবং বাকি হিসাবও করে ফেলো। এবার প্রিয় জিনিস কী পেলে?

আমি পেয়েছি কিশোর আলো। তুমিও কিশোর আলো পেয়েছ? দ্বিতীয়বার? এবারও কিশোর আলো? আমিও তো তা-ই পেয়েছি। বাহ, আমার সঙ্গে তোমার পছন্দ মিলে যাচ্ছে, তাও পরপর দুবার। আরও একবার দেখতে পারো। এবারও কিশোর আলোই আসছে? কেন হচ্ছে এমনটা? চলো, সেটাই খুঁজে বের করার চেষ্টা করি।

ছোটবেলা থেকেই এমন নানা গাণিতিক ধাঁধা আমরা নানাজনের কাছে দেখে থাকি। যে ধাঁধায় প্রথমেই মনে মনে একটা সংখ্যা ধরতে হয়। এসব ধাঁধার পেছনের কলকবজা বোঝার প্রধান উপায়, মনে মনে একটা সংখ্যা না ধরে সংখ্যাটা x বা ক ধরা। তোমরা তো গণিত পড়তে গিয়ে শিখেছই, অজানা কিছু বের করতে প্রথমেই আমরা তাকে x বা ক ধরে নিই, এরপর গাণিতিক যুক্তি খাটিয়ে অজানা সংখ্যাটা বের করি। তো এখানেও আমরা তা-ই করব।

যখনই আমাদের ভাবতে বলা হলো একটা সংখ্যা, আমরা ধরে নিলাম, সংখ্যাটা হলো ‘ক’। ক-এর মান ১, ২, ৩ ইত্যাদি হতে পারে। তো, এরপর কী করতে বলেছে? সংখ্যাটা ৩ দিয়ে গুণ করতে। গুণ করলে সংখ্যাটা হলো ৩ক। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে আরও ৩। তাহলে আমাদের কাছে থাকা যোগফলটি হলো (৩ক + ৩)। এই যোগফলকে আবার গুণ করতে হবে ৩ দিয়ে। তাহলে গুণফল কী হবে? গুণফল হবে ৩(৩ক + ৩)। এ সংখ্যাটাই আসলে দুই অঙ্কের সংখ্যা, যার অঙ্কগুলো যোগ করে আমরা ৯ পেয়েছি, যতবার পুরো কাজটুকু করেছি, উত্তর ৯ পেয়েছি। এখন আমরা এই ৩(৩ক + ৩)-কে ভেঙেচুরেই বের করব, কেন সব সময় ৯ হচ্ছে।

তোমরা যারা একটুখানি বিজগণিত শিখেছ বা সরল করতে জানো, তারা নিশ্চয় এই ৩(৩ক + ৩)-কে একটু সরল করে লিখতে পারবে। সরল করে লিখলে কী হবে?

৩(৩ক + ৩) = ৩x৩(ক + ১)

এখানে আমরা কী করেছি? বন্ধনীর মধ্য থেকে ৩ কমন নিয়ে বাইরে এনেছি। আরেকটু কাজ করা যাক। ৩x৩ হয় ৯। তাহলে আরও সরল করে আমরা নিচের মতো করে লিখতে পারি।

৩(৩ক + ৩) = ৩x৩(ক + ১) = ৯(ক + ১)

তার মানে এত ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে আমরা যা করছিলাম তা আসলে খুব সোজা। তুমি মনে মনে একটা সংখ্যা নেবে। সেই সংখ্যার সঙ্গে ১ যোগ করে তাকে ৯ দিয়ে গুণ করবে। যেমন ধরো, তুমি নিলে ৪। তাহলে হবে ৯x৫। একদম সোজা কাজ।
এখানেই আসলে ট্রিকটা। তুমি ১ থেকে ৯ পর্যন্ত যে সংখ্যাই নাও, কী হবে? তাকে এক বাড়িয়ে নয় দিয়ে গুণ করে একটা সংখ্যা পাবে এবং সেই সংখ্যার অঙ্কগুলোই তুমি যোগ করবে।

একটা জিনিস বলো তো, ৯ দিয়ে নানা সংখ্যা গুণ করলে যেগুলো পাওয়া যাবে সেগুলো কী? ঠিক ধরেছ। ৯-এর ঘরের নামতা পরলেই তো সেগুলো পেয়ে যাওয়া যাবে। নয় এক্কে নয়, নয় দুগুণে আঠারো, তিন নং সাতাশ। এভাবে কী কী সংখ্যা আসতে পারে? ১৮, ২৭, ৩৬, ৪৫, ৫৪, ৬৩, ৭২, ৮১ এবং ৯০। প্রতিটা সংখ্যার অঙ্কগুলো যোগ করে দেখো, সব সময় ৯ হয়।

১ + ৮ = ৯, ২ + ৭ = ৯, ৩ + ৬ = ৯ ইত্যাদি।

সব সময় যদি নয়ই হয়, তাহলে ৯ নম্বরে থাকা কিশোর আলোই যে প্রতিবার আসবে, তা নিশ্চয় বুঝতে পারছো এখন। নয় নম্বরে কিশোর আলো না রেখে যদি তিন গোয়েন্দা রাখা হতো, তাহলে প্রতিবার প্রিয় জিনিস হতো তিন গোয়েন্দা। অবশ্য কিশোর আলোর মতো তিন গোয়েন্দাও আমার প্রিয়, তাই খারাপ লাগত না।

সব ঠিক আছে, বোঝা গেল যে সব সময় যোগফল ৯ হচ্ছে বলেই উত্তর আসছে কিশোর আলো। আমরা দেখলাম কীভাবে ট্রিক করে আমাদের দুইটা তিনের আড়ালে আসলে ৩ গুণ ৩ করে ৯–এর নামতায় নিয়ে গেছে। সে জন্যই সব সময় উত্তর আসছে ৯। এ তো জানা গেল কীভাবে ৯-এর নামতায় নিয়ে আসা হলো। কিন্তু নয়ের নামতায় যোগফলই বা কেন নয় হয়? অন্য সংখ্যায় তো তা হয় না। চলো, খোঁজা যাক এই প্রশ্নের উত্তর।

আগের মতো আমরা আবারও শুরু করব যেকোনো একটা সংখ্যা ধরে। তোমাদের নিশ্চয় মনে আছে, এমন কলকবজা খুঁজতে শুরুতেই আমরা এক্স বা ক ধরে নিই। আগে যেহেতু ‘ক’ ধরেছি, এবার ধরব ‘খ’। খ-কে আমরা গুণ করব ৯ দিয়ে। তাহলে হবে ৯খ।

এখন দেখো, আমরা ৯-কে লিখতে পারি (১০-১)। তাহলে কী হলো?

৯খ = (১০-১) খ

বন্ধনীটা ভেঙে লিখলে হবে নিচের মতো,

৯খ = (১০-১)খ = ১০খ-খ

(১০খ-খ)-কে আমরা এবার একটু সাজিয়ে অন্যভাবে লিখব। এভাবে লিখলেও যে আগের মতোই থাকে, বোঝার জন্য একটু চিন্তা করো নিজে নিজেই।

৯খ = (১০-১)খ = ১০খ-খ = ১০(খ-১) + (১০-খ)

এবার ব্যাপারটা খুব সোজা। এর মানে হলো আমরা ৯খ-কে লিখতে পারি ১০(খ-১) + (১০-খ) আকারে। তোমাদের যদি স্থানীয় মানের কথা মনে থাকে, তাহলে নিশ্চয় মনে করতে পারবে, দুই অঙ্কের যেকোনো সংখ্যাকে কীভাবে দশকের অঙ্ককে ১০ দিয়ে গুণ করে লেখা যায়। যাদের মনে নাই, তাদের দেখিয়ে দিই।

যেকোনো একটা দুই অঙ্কের সংখ্যা নেওয়া যাক, যেমন ২৭। একে আমরা লিখতে পারি, (১০x২ + ৭)। আবার ৭৩-কে লিখতে পারি (১০x৭ + ৩)।

এখন দেখো, ৯খ-কে আমরা যখন ১০(খ-১) + (১০-খ) লিখছি, তখন আসলে ওই কাজই করছি। ৭৩-এর সঙ্গে তুলনা করলে দেখবে (খ-১) হলো ৭, আর (১০-খ) হলো ৩। নয়ের নামতা পড়ে যে সংখ্যাই পাই, আমরা চাইলেই এই পদ্ধতিতে লিখতে পারি। এখানেই ম্যাজিকটা। আচ্ছা, আমরা যদি (খ-১) এবং (১০-খ) যোগ করি তবে কী হবে?
(খ-১) + (১০-খ) = খ-১+১০-খ = -১+১০ = ৯।

বাহ, খ হিসেবে আমরা যা-ই নেব, ৯খ-এর গুণফলের অঙ্কগুলোর যোগফল আসবে ৯। সেখানে খ বা অন্য কিছু থাকবেই না। এই বুদ্ধিই আসলে খাটানো হয়েছে ওপরের ধাঁধাটা বানানোর জন্য।

তো এবার তোমাকে একটা বুদ্ধি শিখিয়ে দিই, যখনই কেউ তোমাকে অঙ্কের ধাঁধা ধরার জন্য মনে মনে একটা সংখ্যা নিতে বলবে, তুমি সংখ্যা না নিয়ে নেবে এক্স বা ক। তারপর সে যা করতে বলবে ওই কাজগুলোই করবে, যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ। একটু মনোযোগ দিয়ে চিন্তা করলেই দেখবে তুমি বের করে ফেলেছ ওই ধাঁধার রহস্য।

এবার নতুন একটা ধাঁধা। এই ধাঁধাটা আমি স্টেজে শত শত ছেলেমেয়েদের ধরেছি, ওরা খুব অবাক হয়েছে।

আমি লেখাটা লিখছি ২৪ তারিখ। তাহলে প্রথমেই তোমাকে আমি দিলাম ২৪। এই ২৪-এর সঙ্গে তোমার পছন্দমতো যেকোনো একটা সংখ্যা যোগ করো। করেছ? কিশোর আলোর বয়স এখন ৬। তাই যোগফলকে ৬ দিয়ে গুণ করো। বাহ, অনেক কিছু করেছ। এবার যেহেতু ৩০টা রোজা হয়েছে, তাই গুণফলের সঙ্গে ৩০ যোগ করো। চমৎকার করেছ। ভাগ করা হয়নি? তাহলে যোগফলকে ৩ দিয়ে ভাগ করো। যোগ-গুণ-ভাগ হয়েছে, বিয়োগ যেহেতু হয়নি, এবার আমরা বিয়োগ করব। ভাগফল থেকে তুমি যে সংখ্যাটা নিয়েছিলে, তার দ্বিগুণ বিয়োগ করো। কাজ শেষ।

আচ্ছা, বিয়োগফল কত হয়েছে? কোনো একজন বন্ধুকেও ধাঁধাটা করতে বলো, তার বিয়োগফল কত? আশপাশে কোন বন্ধুকে পাচ্ছ না? নিজেই আবার ভিন্ন কোনো সংখ্যা ধরে ধাঁধাটা করতে পারো। কী ফল পেয়েছ? মজা না?
তোমাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো আমার আগে দেওয়া বুদ্ধি অনুযায়ী সংখ্যা না ধরে নিয়েছিলে x। তারা নিশ্চয় এতক্ষণে আমার চালাকিটা ধরেই ফেলেছ! তোমাকে অভিনন্দন।

লেখক: সদস্য, সম্পাদনা দল, বিজ্ঞানচিন্তা