যেমন চাই চকবাজার তেমনি চাই রমনা পার্ক

ছোট ছোট ছাত্রবন্ধুরা,

ছাত্রদের আগে আমি বন্ধু বলেই সম্বোধন করতাম—এখন সাহস হয় না। ভয় লাগে, হয়তো বলে বসবে: আপনি বুড়ো হয়ে আমাদের বন্ধু বলেন! আপনার সাহস তো কম নয়।

খুব ভালো লাগছে তোমাদের দেখে, মনটা ভরে যাচ্ছে। অনেক বছর ধরে তোমাদের এই কলেজে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইপড়া কর্মসূচি চলছে। বরাবরের মতো এবারও তোমরা অনেকে এতে যোগ দিয়েছ। কিছুক্ষণের মধ্যেই তোমরা পুরস্কার পাবে। ওখানে পুরস্কারগুলো সাজানো আছে। সবার সামনে দিয়ে পুরস্কারগুলো তোমরা নিতে আসবে বিনীত ভঙ্গিতে, ফিরে যাবে গর্বিত পায়ে। স্কুল ছুটি হলে এগুলো নিয়ে বাড়ি যাবে। হয়তো একটু লুকিয়েই ঢুকবে বাড়িতে, ভাবটা এমন—যেন কিছুই নেই হাতে। তোমাকে ওভাবে ঢুকতে দেখে মায়ের হয়তো সন্দেহ হবে। বলবেন, ‘কিরে, ওভাবে ঢুকছিস কেন? হাতে তোর কী যেন দেখছি।’ তুমি সসংকোচে বলবে, ‘না, না এমন আর কী।’ তবু মা নাছোড়বান্দা। ‘দাঁড়া তো দেখি, হাতে কী।’ তারপর পুরস্কারগুলো দেখে তো তাঁর চোখ ছানাবড়া। ‘অ্যা, বই, মানে তুই বই পুরস্কার পেয়েছিস? এতগুলো বই!’ তুমি তখন সহাস্য গর্বের সঙ্গে বলবে, ‘কী আর করা! না দিয়ে যে ছাড়ল না!’ (ছাত্রছাত্রীদের হাসি)।

এ রকম এক-আধটা ঘটনা হয়তো আজ ঘটবে কোনো কোনো বাসায়। তোমাদের দেখে আমার ঈর্ষা হচ্ছে এ জন্য যে আমি যখন তোমাদের বয়সী ছিলাম, তখন এ ধরনের কোনো পুরস্কারের সৌভাগ্য আমার হয়নি। যেটা করতে গেছি সেটাতেই ব্যর্থ। একবার নাম দিয়েছিলাম ইংরেজি কবিতা আবৃত্তিতে। আশা ছিল কিছু একটা পাব। খুব মন দিয়ে প্র্যাকটিস করেছি। আবৃত্তিও করছি চমত্কার। বিচারকদের চেহারাও সপ্রশংস। প্রাইজ জুটেই যায় আর কী। এমন সময় ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা। হঠাত্ উইংসের পাশ থেকে কে যেন চিত্কার করে উঠল ‘তাড়াতাড়ি!’ কে কেন কাকে তাড়াতাড়ি বলল কে জানে। হয়তো কেউ আস্তে আস্তে হাঁটছিল, তাই কেউ চিত্কার করে উঠেছে: ‘তাড়াতাড়ি’! কিংবা কাউকে বলা হয়েছে দৌড়ে এক গ্লাস পানি আনতে, সে আসছে আস্তে আস্তে, তাতে কেউ চেঁচিয়ে উঠেছে: ‘তাড়াতাড়ি।’ কিন্তু আমার কেন যেন মনে হলো কথাটা আমাকেই বলেছে। হয়তো আমি কবিতাটা বেশি আস্তে আস্তে পড়ছি দেখে চেঁচিয়ে বলেছে ‘তাড়াতাড়ি’। মানে, ‘এত আস্তে কেন রে গাধা? ওতে কি প্রাইজ হবে? জলদি পড়, ‘তাড়াতাড়ি। দৌড় দে।’ আর যায় কোথায়। আমি ছুটিয়ে দিলাম পাগলা ঘোড়া। পড়ছিলাম আস্তে আস্তে হঠাত্ এক শ মাইল গতিতে তুবড়ি ছুটিয়ে পড়া শুরু করলাম। বিচারকেরা হতভম্ব। ‘কী হলো রে ছেলেটার? ভালোই তো পড়ছিল। হঠাত্ ইঁদুরের মতো দৌড় দিল কেন?’

পুরস্কারের আশা মাঠে মারা গেল। কিন্তু ও না হলেই যে নয়। কী করে পুরস্কার পাই? অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম স্পোর্টসেই নাম দেব। কিন্তু তাতেই পুরস্কার কি অত সোজা! মাসের পর মাস প্র্যাকটিস করলে তবেই না পুরস্কার। কিন্তু আমি তো কিছুই প্র্যাকটিস করিনি। কী করে পারব? লংজাম্প-হাইজাম্প হবে না। আমি ছিলাম এমনই মোটা যে আমার পক্ষে নিচের দিকে পড়তে যত সুবিধা, ওপরের দিকে ওঠা ততটাই কঠিন। কাজেই ওতেও আশা নেই। পোলভল্টও হবে না—ওজনের চাপে বাঁশ ভেঙে যাবে। ভেবে দেখলাম কোনো কিছুতেই আশা নেই। কিন্তু প্রাইজ যে না পেলেই নয়। অন্তত একটা প্রাইজ।

হঠাত্ মাথায় একটা চিন্তা এসে গেল। না, আছে। আছে একটা আইটেম।

এ যুগের স্পোর্টসে সেটা আর নেই, কিন্তু সে যুগে ছিল। প্র্যাকটিস ছাড়াও ওতে অনেক সময় প্রাইজ জুটে যেত। এ হলো, পেছন দিকে দৌড়। কেউ ওটা প্র্যাকটিস করে না। এমন সুযোগ আর হবে না। নেমে গেলাম কোমর বেঁধে। স্বপ্ন ব্যর্থ হলো না। প্রথম দ্বিতীয় পুরস্কার না পেলেও জুটে গেল ‘থার্ড’ প্রাইজটা। (সবার হাসি) পুরস্কার হিসেবে যা পাওয়া গেল তা খুব সম্মানজনক নয়। একটা চায়ের চামচ। (সবার হাসি) তা-ও আবার প্লাস্টিকের। (সবার হাসি) কিন্তু সম্মানজনক না হলে হবে কী? ওই চামচ দিয়ে আমি চারপাশের সবাইকে একেবারে সন্ত্রস্ত করে তুললাম। আব্বার বন্ধুরা যখন ড্রয়িংরুমে বসে সরগরম আড্ডা দিতেন, তখন আমি ঘরের এক কোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে ওই চামচটা মুখের সামনে তুলে ধরে এদিক-ওদিক নাড়াতে থাকতাম। আশা: কেউ নাকি তবু জিগ্যেস করে: ‘খোকা, তুমি চামচ নাড়ো কেন?’ তখন আমাকে পায় কে? গর্বের হাসি হেসে বলা যাবে, হুঁ, হুঁ, এ যেমন-তেমন চামচ নয় গো। এ হলো গিয়ে ‘থার্ড প্রাইজ’। ‘থার্ড প্রাইজ’ কথাটা বলতাম প্রায় গর্জন করে।

যা-ই হোক, এই হলো আমার শৈশবের ইতিহাস। এ জন্য কাউকে পুরস্কার পেতে দেখলে আমি একদিকে যেমন খুশি হই, তেমনি মনের ভেতরে একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাসের শব্দও শুনতে পাই। প্রাইজ পাওয়া প্রতিটা ছেলেমেয়েকে দুর্লভ জগতের মানুষ মনে হয়।

যা-ই হোক, তোমরা তো আমাদের বই পড়া কার্যক্রমে অংশ নিয়ে আজ পুরস্কার পেতে যাচ্ছ। কিন্তু কেন এই কর্মসূচি আমরা করি, কেন দেশ-বিদেশের মজার মজার বই, সুন্দর সুন্দর বই, স্বপ্নের মতো বই তোমাদের পড়তে দিই, এসো, এবার সে সম্বন্ধে কিছু বলি। প্রথমে তোমরা আমাকে বলো, তোমরা ক্লাসে যেসব পাঠ্যবই পড়ো সেগুলো তোমাদের পড়ার দরকার আছে কী নেই।

(ছাত্ররা: আছে)।

নিশ্চয় আছে। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে, মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে, মর্যাদার জীবন পেতে হলে, ওই সব বই আমাদের পড়তেই হবে। যদি আমরা এসব বই ঠিকমতো না পড়ি—তাহলে আমরা কোনো দিন আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হব না। মানবসভ্যতাকেও এগিয়ে নিতে পারব না। আমাদের বেঁচে থাকাটাই ছোট হয়ে যাবে। তাই ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক ওটা আমাদের করতেই হবে। বিশেষ করে তোমাদের মতো এমন ছবির মতো সুন্দর আর পরিপাটি একটা স্কুলে যদি পড়ার কারও সৌভাগ্য হয়, তবে তো এ আরও বেশি করে করতে হবে।

চিন্তা করে দেখো, কত সুন্দর বিশাল একটা স্কুলে তোমরা পড়ো। কী বিরাট মাঠ তোমাদের, কী অনবদ্য পরিবেশ। দেশের সাধারণ ছেলেমেয়েদের তুলনায় কত ভাগ্যবান তোমরা। তোমাদের তুলনায় কত আলোহীন, ভ্যাপসা, অন্ধকার স্কুলের মধ্যে তারা পড়ে। সেসব স্কুলের দম আটকানো ঘুপচির ভেতর তাদের কল্পনা আর অনুভূতিগুলো কীভাবে তিলে তিলে শেষ হয়ে যায়। তোমরা যখন বড় হবে আর ছেলেবেলার কথা মনে করবে, তখন তো ভাবতে পারবে: কত সুন্দর বড়সড় আর

অপরূপ একটা স্কুল-কলেজে তোমরা পড়েছিলে। পরিতৃপ্তিতে তোমাদের মন ভরে যাবে। জানো তো, এ দেশের অধিকাংশ ছেলেমেয়েই কিন্তু তোমাদের মতো এমন সুযোগ পায় না।

পাঠ্যবই তো তোমাদের তাই পড়তেই হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি কিছু অপাঠ্যবইও আবার পড়া দরকার। দিনের সঙ্গে রাত যেমন দরকার, রাজবাড়ির সঙ্গে সরোবর যেমন দরকার, তেমনি। পাঠ্যপুস্তক পড়ে তোমরা সুশিক্ষিত হবে, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে, বৈষয়িক জীবনকে জয় করবে। আর এই যে বাইরের বই, যেগুলোকে অনেকে অপাঠ্য মনে করে দূরে সরিয়ে দেন—এগুলো পড়লে তোমাদের মন বিকশিত হবে। ভেতরের স্বপ্নগুলো বড় হবে। তোমরা আলোকিত মানুষ হয়ে গড়ে উঠবে।

মৌলভীবাজার নামে ঢাকায় একটা জায়গা আছে জানো? কোথায় বলো তো?

(একজন ছাত্র: পুরান ঢাকায়)!

ঠিক বলেছ, পুরান ঢাকায়। সেখানে কী হয় জানো? সে এক অদ্ভুত ব্যস্ততার রাজ্য। সেখান থেকে ঢাকা মহানগরীর যাবতীয় চাল, ডাল, গম, তেল, আলু, মসলার চালান আসে। তাই সেখানে আছে গুদাম, আড়ত হাজারো কেনাবেচার ব্যবস্থা। সেখানে অনেক কাজ, ব্যস্ততা, হুড়োহুড়ি আর ঠাসাঠাসি, মানুষ-গাড়ি-জিনিসপত্রের নিকট শব্দে উত্তেজনায় দম আটকানো অবস্থা। তোমরা সেখানে গেলে দেখবে সেই অন্ধকার গলিঘুঁজিওয়ালা ঘিঞ্জি জায়গায় তোমাদের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, ভিড়ের চাপে চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছে।

এবার বলো তো, এই জায়গাটার দরকার আমাদের আছে, না নেই? আমি বলব, নিশ্চয়ই আছে। ওই জায়গা থেকে যদি চার-পাঁচ দিনের জন্যও আমাদের চাল-ডাল, নুন-তেল বা প্রতিদিনের দরকারি জিনিসগুলো না আসত তাহলে কী ত্রাহি ত্রাহি আর্তনাদই না আমাদের শুরু হয়ে যেত, এই মিলনায়তনে এমন দার্শনিকের মতো গাম্ভীর্য নিয়ে তোমরা বসে থাকতে পারতে না। পেট চোঁ চোঁ করত। জ্ঞানচর্চা শিকেয় উঠত। খাবারের জন্য এতক্ষণ ছোটাছুটি, লাঠালাঠি শুরু করতে। তাই আমাদের প্রথম কাজ বেঁচে থাকা। ভালোভাবে, সুষ্ঠুভাবে বাঁচা। তারপর বিকাশ: বড় হওয়া, সমৃদ্ধ হওয়া।

তাই ঢাকা শহরে কেবল মৌলভীবাজার, চকবাজার নেই, এদের মতো আরও কিছু জায়গা আছে, এসো এবার তাদের দিকে তাকাই। জায়গাগুলো চকবাজার, মৌলভীবাজারের ঠিক উল্টো। মৌলভীবাজার যেমন সারাক্ষণ শ্রমে ঘামে জবজবে, এগুলোতে তেমনি আবার কোনো কাজই নেই। কোন জায়গা বলো তো, এগুলোর অন্তত একটার নাম বলো! বলো তো, ঢাকা শহরে এমন কি কোনো জায়গা আছে যেখানে কোনো কাজ নেই? কেবল সার বাঁধা গাছপালা আর বসে বসে গল্প।

(একজন ছাত্র: রমনা পার্ক)

ঠিক বলেছ, রমনা পার্ক। মানুষের কোনো কাজ নেই ওখানে! সেখানে অযথাই বসে থাকে, গল্প করে, চিনাবাদাম খায়, ঘুরে বেড়ায়, প্রেম করে। আলসেমিতে, অবসরে, অর্থহীন আনন্দে সময় কাটানোর জন্য যায়। জীবনের বাস্তবতা থেকে দূরে নীল আকাশের নিচে সবুজের রাজ্যে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নেয়। তো, এখন তোমরা বলো, ঢাকা শহরে শুধু মৌলভীবাজার, চকবাজার থাকলেই কি চলবে? নাকি রমনা পার্কও থাকতে হবে?

(সবাই: রমনা পার্কও থাকতে হবে)।

কেন থাকতে হবে? কারণ, কেবল কোনোমতে টিকে থাকলেই আমাদের চলে না, আমাদের পরিপূর্ণভাবে বেঁচে থাকতে হয়। কেবল ক্ষুধার খাদ্য হলেই চলে না, ফুলেরও দরকার হয়। কী বলেছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)? যদি একটা পয়সা জোটে তবে তা দিয়ে ক্ষুধার খাদ্য কিনো, যদি দুটো পয়সা জোটে তবে দ্বিতীয়টা দিয়ে ফুল কিনে নিয়ো। এ জন্য দেখো, সরকার কী খরচটাই না করেছে। রমনা পার্কের ভেতর যে জায়গাটুকু আছে তার দাম কম করে হলেও কত হবে বলো তো? অন্তত পাঁচ হাজার কোটি টাকা! কী বোকা আমাদের সরকার, তাই না? কাজকম্ম নেই, পাঁচ হাজার কোটি টাকার জায়গা অযথাই ফেলে রেখেছে শুধু প্রেম আর গল্পের জন্য। কত কিছুই তো করা যেতে পারত ও দিয়ে! হাজার হাজার দালান তুলে আর দশটি চকবাজার, মৌলভীবাজার বানাতে পারলে কত লাভই না হতো! কিন্তু মনে রেখো, মানুষ অত বোকা না। নিশ্চয়ই এ দিয়ে কোনো কাজ হয়। না হলে ও জায়গা ওভাবে ফেলে রেখেছে কেন?

কী কাজ হয় রমনা পার্ক-চন্দ্রিমা উদ্যান দিয়ে? এসো, এবার তাই নিয়ে কথা বলি। বেঁচে থাকার জন্য মৌলভীবাজারের যেমন দরকার, তেমনি মনের আনন্দের জন্য, সম্পন্ন জীবনের জন্য দরকার রমনা পার্কেরও। দুটোর কোনোটা না হলেই হয় না। কেন দুটোই দরকার, এই কথাটা এবার বুঝিয়ে বলি। যে জিনিস যত বেশি কাজ করে, গায়ে খাটে, পরিশ্রম করে, তার চেহারা তত কদাকার হয়ে পড়ে। যেমন বিশাল বিশাল ট্রাক। সারা দিন গোঁ গোঁ করে মাল টানছে, পশুর মতো খাটছে। সবই আছে তাদের, টাকাপয়সারও রোজগার অনেক। কিন্তু একটা জায়গাতে এরা অভিশপ্ত। ওরা দেখতে বড় বদখত। একেবারেই সুন্দর না। যাকে বেশি রকম শরীরের খাটুনি খাটতে হয়, তার সৌন্দর্য মরে যায়। চকবাজার, মৌলভীবাজারকে অনেক ভারী ভারী মোট টানতে হয়, তাই ওদেরও সৌন্দর্য নেই। তুমি কোনো বন্ধুকে বলে দেখো না: চলো না ভাই, মৌলভীবাজার থেকে একটু হাওয়া খেয়ে আসি। দেখো সে কী বলে? একইভাবে যে জিনিসের ব্যবহার কম, প্রয়োজন কম, জীবনের কোনো কাজেই প্রায় আসে না, দেখবে তার মধ্যে তত বেশি সৌন্দর্য। এ জন্য রমনা পার্ক ঢাকা শহরের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা।

তোমাদের এই স্কুলের মধ্যে দালান আছে, কোঠা আছে, অফিস আছে, ক্লাস আছে। কিন্তু এসব কিছুর চেয়ে—সবার চেয়ে সুন্দর কি এই স্কুল? ওই বিরাট দিগন্তছোঁয়া মাঠটা, তাই না? এই মাঠ দিয়ে কি কোনো কাজ হয়? মাত্র একটা জিনিসই হয়: আনন্দ। সেখানে খেলা হয়, প্রাণভরে নিশ্বাস নেওয়া হয়। ওই অফুরন্ত সবুজের ভেতর নিজেকে প্রজাপতির মতো হারিয়ে ফেলা যায়। এই মাঠ দিয়ে জীবনের কোনো বাস্তব কাজ হয় না। অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য, দোকানদারি, লাভ-মুনাফা কিছুই না।

তাজমহলের কথা ধরো, তাজমহল দিয়ে কি কোনো কাজ হয়? এত বড় একটা স্মৃতিসৌধ। পৃথিবীর রমণীয়তম দালান। সেকালে নয় কোটি টাকা খরচ করে তৈরি করা হয়েছিল। সে টাকা একালের হয়তো ৬০ হাজার কোটি টাকার সমান। অথচ দেখো, এত অনিন্দ্যসুন্দর একটা দালান, ২১ হাজার লোক ২২ বছর পরিশ্রম করে যা বানিয়েছে, সেই দালানে একটা রাত্রির জন্যও কারও থাকার ব্যবস্থা নেই। কোনো কাজেই লাগে না সে। কাজে লাগে না বলেই না ও অত সুন্দর। তুমি যাও না, গিয়ে বলো না, ‘বাবা, আমি একজন বাংলাদেশি মুসাফির, দেন না আমারে এখানে এক রাত থাকতে।’ দেবে থাকতে? ওই তাজমহলকে কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না। করলে ও আর তাজমহল থাকবে না। ওর সৌন্দর্য হারিয়ে যাবে। সে মৌলভীবাজার হয়ে যাবে। এত বড় একটা দালান মাত্র এক দিনের জন্য ওখানে শ দুই গরু রাখো না? ও কি তাজমহল থাকবে?

এই জীবনের যত জিনিস আছে সবই আমাদের লাগবে। আমাদের যেমন মৌলভীবাজার লাগবে, তেমনি আবার রমনা পার্কও লাগবে। এতে একদিকে যেমন বাস্তব প্রয়োজন মিটবে, তেমনি সৌন্দর্যের বা উচ্চতর আনন্দের প্রয়োজনও মিটবে। দুয়ে মিলে আমরা পূর্ণ হব। আমাদের পাঠ্যপুস্তকও লাগবে, আবার আউট বইও লাগবে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষদের সুন্দর সুন্দর বইগুলো লাগবে। কেন লাগবে? একটা বই মানে কী? রবীন্দ্রনাথের একটা বই মানে কী? রবীন্দ্রনাথের একটা বই মানে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে যা কিছু সুন্দর, যা কিছু আনন্দময়, যা কিছু আলোময় ছিল, সেসবই তো। সুতরাং তাঁর কোনো বই যখন পড়ি তখন কতগুলো কাগজের পৃষ্ঠাই শুধু পড়ি না, রবীন্দ্রনাথের অন্তরের সব সৌন্দর্য আর আলোকেও আমরা স্পর্শ করি। অন্তরের মধ্যে একটা জ্যোতিপ্রবাহ তখন খেলা করে। আমি যদি শেক্সপিয়ার পড়ি তবে তাঁর জ্যোতিও আমার মধ্যে আসবে। যদি প্লেটো পড়ি তবে তাঁর জ্যোতিও। যদি অ্যারিস্টটল পড়ি, হাদিস পড়ি, কালিদাস পড়ি, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মানুষদের শ্রেষ্ঠ ও সৌন্দর্যময় লেখা পড়ে যাই, তাহলে একদিন আমি কি এই আমি থাকব? থাকব না। আমি আমার চেয়ে অনেক সুন্দর, অনেক বিভাময়—বড় স্বপ্নে, বড় ভালোবাসায় আর মূল্যবোধে-ভরা একজন মানুষ হয়ে যাব। এ জন্য এই বইগুলো আমরা তোমাদের পড়তে দিয়েছি।

আমাদের মৌলভীবাজারও লাগবে, আবার তাজমহলও লাগবে। মানুষের দরকার বড়, বিশাল। পৃথিবীর সবকিছু না হলে সে বাঁচে না। শেখ সাদির একটা অসাধারণ কথা আছে। কথা হলো: এক জায়নামাজে নয়জন সুফির জায়গা হয় কিন্তু এক রাজ্যে দুজন রাজার জায়গা হয় না। হূদয়ের ভেতর প্রতিটি মানুষই রাজার মতো, বাঁচতে তার অনেক কিছু লাগে। ছোট্ট ঘরের সংকীর্ণ কুঠুরির মধ্যে সে বাঁচতে পারে না। তাকে ছড়িয়ে পড়তে হয় অনেক দূরে। এই দেখো না, এতগুলো জানালা কেন এই অডিটরিয়ামে। মনে হচ্ছে জানালাই যেন আছে, দেয়ালই নেই। এ আছে এ জন্য, যাতে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তোমার পার্থক্য ঘুচে যায়। তুমি বাইরের সমান হয়ে ওঠো। প্রতিটা বই এমনই এক একটা বিশাল জানালা। এ জন্য উচ্চতর মানুষ হওয়ার জন্য পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি তোমাকে সারা পৃথিবীর সুন্দর সুন্দর বইও পড়তে হবে।

আমি এখানেই কথা শেষ করি। তোমরা যারা বই পড়ার জন্য এসেছ তাদের আমি অভিনন্দন জানাই। যারা আসোনি তাদেরও বলি: চলে এসো। জীবন বারবার আসে না। টিএস এলিয়টের একটা অসাধারণ কথা আছে ঞযবত্ব রং হড়ঃযরহম ধমধরহ. ‘আবার’ বলে পৃথিবীতে কিছু নেই। তোমরা হয়তো লক্ষ করেছ, সাপলুডুর মধ্যে নানান ঘরে নানান আকারের সাপ হাঁ করে বসে থাকে। এদের মুখ ওপরের দিকে, বড় সংখ্যার ঘরে। লেজ নিচের দিকে, ছোট সংখ্যার ঘরে। সবচেয়ে বড় সাপটা আছে ৯৮-এর ঘরে। ওর মুখে পড়লে আর রক্ষা নেই, সোজা চলে আসবে ১৩-তে। এখন ধরো, তুমি যেতে যেতে ৯৬-তে চলে গেছ। এবার তুমি শেষ চালটা দিচ্ছ। আশা তুমি জিতে যাবে। কিন্তু চালে পড়ল দুই। তুমি পড়লে গিয়ে সোজা ৯৮-এর সাপের মুখের ভেতর আর সে সাপ গপ করে তোমাকে গিলে পাঠিয়ে দিল ১৩-এর ঘরে। তুমি বলে উঠলে: থুরি, না, না, হয়নি, চালটা আমি আবার দেব। এ কি হবে কোনো দিন? দিতে দেবে কেউ? কেউ কি মেনে নেবে? নিলেও কি তা বৈধ হবে? পৃথিবীতে ‘আবার’ বলে কিছু নেই। কোনো চাল দুবার দেওয়া যায় না।

তোমাদের এই তরুণ বয়সও আর আসবে না। এখন তোমরা কিশোর, তরুণ। তোমরা অনুভূতিময়, স্পর্শকাতর, সংবেদনশীল, গ্রহণক্ষম, অসীম সম্ভাবনাসম্পন্ন। এখন তোমাদের ভেতর সমস্ত পৃথিবী ভিড় করে পাতা মেলার জন্য অধীর হয়ে কাঁপছে। তোমরা এখন উত্কর্ণ, উন্মুখ। এ সময় মনটাকে খোলা রাখো। বিশ্বচরাচরে যত কিছু আছে, সব দিয়ে তাকে ভরে দাও। মানুষ ছোট জীব, কিন্তু সারা পৃথিবীর সবকিছু তার দরকার। আমাদের জন্ম হয়েছে এই বিশ্বের সবকিছুর জন্য। জীবনের যতটুকু বাদ দেবে, জীবন ততটুকু ছোট হয়ে যাবে। জীবনের যা কিছু সুন্দর এবং ভালো, তাকে তোমরা দুহাতে লুটে নাও। তোমরা যারা এ কর্মসূচিতে এসেছ, তোমাদের আমি অভিনন্দন জানাচ্ছি। তোমরা আরও বেশি করে এসো। যারা এখনো আসোনি তারাও এসো। এ হচ্ছে তোমাদের জীবনের তাজমহল, রমনা পার্ক, চন্দ্রিমা উদ্যান। একে একবার হারিয়ে ফেললে আর কোনো দিন পাবে না।

[ঢাকা রেসিডেনসিয়াল স্কুল ও কলেজে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইপড়া কর্মসূচির পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রদত্ত বক্তৃতা: ২০০০]

অলংকরণ: রাকিব