শব্দ বানাই

আমরা কথা বলি: মুখ থেকে বেরিয়ে আসে গুচ্ছ গুচ্ছ ধ্বনি। ধ্বনিগুলো যেন খাঁচা-থেকে-বেরিয়ে-পড়া পাখির ঝাঁক, একবার মুখপিঞ্জর থেকে ডানা মেলে বেরিয়ে পড়তে পারলে তারা আর কোনো দিন খাঁচায় ফেরে না। মিলিয়ে যায় আকাশে বাতাসে অনন্তে। তবে আমাদের মুখ এক চমত্কার ধ্বনি বানানোর যন্ত্র, যা মুহূর্তে মুহূর্তে বানাতে পারে নানা রকম গুঞ্জনময় ধ্বনি। তাই মুখ থেকে ধ্বনি যতই বেরিয়ে যাক না কেন, তা কখনো ফুরোয় না। যে-ধ্বনিটি এইমাত্র বেরিয়ে গেল মুখ থেকে, সেটি আর মুখে ফিরে আসবে না কোনো দিন, কিন্তু সে-ধ্বনিটিকে পরমুহূর্তেই বানাতে পারে আমাদের মুখ। আমরা কথা বলি: এর অর্থ হচ্ছে মুখ দিয়ে আমরা অবিরাম উচ্চারণ করি গুচ্ছ গুচ্ছ ধ্বনি। ধ্বনিগুলো মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ে দলবেঁধে এবং অন্যদের জানিয়ে দেয় আমাদের মনের কথা। পৃথিবীতে ভাষা আছে অনেক: বাংলা ইংরেজি ফরাসি জর্মন রুশ জাপান তামিল তেলেগু হিন্দি উর্দু আরবি, নানা ভাষা আছে পৃথিবীতে। প্রতিটি ভাষায় রয়েছে গুটিকয় ধ্বনি। সংখ্যায় তারা বেশি নয়। কোনো ভাষায়ই কোটি কোটি বা লাখ লাখ বা হাজার হাজার ধ্বনি নেই, এমনকি শ খানেক ধ্বনিও নেই। যে ভাষায় সবচেয়ে কম ধ্বনি আছে, তাতে আছে বারোটির মতো ধ্বনি; আর যে ভাষায় সবচেয়ে বেশি পরিমাণ ধ্বনি আছে, তাতে আছে ষাটটির মতো ধ্বনি। সামান্য কয়েকটি ধ্বনিকে নানাভাবে সাজিয়ে গড়ে ওঠে একেকটি ভাষা। যদি কোনো ভাষায় থাকত হাজার হাজার ধ্বনি, তবে অত ধ্বনিকে ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারত না কেউ। ফলে ভাষাটিকে ব্যবহার করত না কেউ। আসলে হাজার হাজার ধ্বনি মানুষ উচ্চারণই করতে পারে না। আমাদের মুখে ধ্বনি উচ্চারণের জন্য বেশ কিছু প্রত্যঙ্গ রয়েছে। সে প্রত্যঙ্গগুলো উচ্চারণ করতে পারে শ খানেকের মতো ধ্বনি। তাই হাজার হাজার ধ্বনিতে কোনো ভাষার গড়ে ওঠার কোনো উপায়ই নেই।

বাংলা আমাদের ভাষা। আমরা কোটি কোটি মানুষ দিনরাত বাংলা বলি। আবেগে নরম হয়ে কোমল কথা বলি, রাগে তেতে উঠে বলি কড়া কড়া কথা। বাসায় বলি সাদা তুচ্ছ কথা, স্কুলে, সভা-সমিতিতে শুনি উচ্চ উচ্চ কথা। কেউ ছোট-বড় পঙিক্ত সাজিয়ে কবিতা লেখেন, কেউ জমজমাট পাতা ভরে রচনা করেন হাজার পাতার উপন্যাস। বলার মতো যত কথা আছে, সবই আমরা বলি বাংলায়। মাত্র এক দিনে যত কথা বলে বাঙালিরা তা যদি লিখে ফেলা যেত, তবে তাতে হয়তো ভরে উঠত পৃথিবীর সমস্ত দালানকোঠা। পৃথিবী ভরানো এসব কথার মূলে আছে মাত্র কয়েকটি ধ্বনি। আমাদের সমস্ত কথা পৃথিবীর সমস্ত বাংলা বই তন্নতন্ন করে খুঁজেও কেউ বের করতে পারবে না হাজার হাজার ধ্বনি। এমনকি এক শ ধ্বনিও পাওয়া যাবে না। পাওয়া যাবে সামান্য কয়েকটি ধ্বনি: আটাশটি ব্যঞ্জনধ্বনি, সাতটি স্বরধ্বনি, আর একটি নাসিক্যগুণখচিত ধ্বনি। এ-ছত্রিশটি ধ্বনি নানাভাবে মিলেমিশে গড়ে উঠেছে আমাদের বিশালব্যাপক বাংলা ভাষা।

ধ্বনিদের নিজেদের কোনো অর্থ নেই। কয়েকটি বাংলা ধ্বনির উদাহরণ হচ্ছে (অ, আ, ই, উ, ও, ক্, চ্, ট্)। এ-ধ্বনিগুলো পৃথকভাবে উচ্চারণ করলেই বোঝা যাবে যে এদের কারও কোনো অর্থ নেই। [অ]-র আবার অর্থ কী? কীই-বা অর্থ আছে [আ]-র? এদের কারও কোনো অর্থ নেই। এরা আমাদের কানে ঢুকিয়ে দেয় নিজ নিজ ধ্বনি, কিন্তু মনে সঞ্চার করতে পারে না কোনো অর্থ। আমরা অন্যের কানে চমত্কার ধ্বনিগুঞ্জন বাজানোর জন্য কথা বলি না। কথা বলি অন্যদের মনে আমাদের মনের কথা সঞ্চার করে দেওয়ার জন্য। আমাদের কথার অর্থ আছে। ভাষার মৌল জিনিস হচ্ছে ধ্বনি, কিন্তু ওই মৌল জিনিসের নিজের কোনো অর্থ নেই। ধ্বনিরা একাকী অর্থহীন; কিন্তু তারা একে অন্যের সঙ্গে মিলে তৈরি করতে পারে এমন বস্তু, যার অর্থ আছে। ধ্বনিরা একে অন্যের সঙ্গে অর্থময় যে জিনিস তৈরি করে, তাকে বলি শব্দ। শব্দের আছে আপন অর্থ। [আ] ধ্বনির কোনো অর্থ নেই, তেমনি কোনো অর্থ নেই [ম্] ধ্বনির। কিন্তু যখন এরা মিলে তৈরি করে [আম] ধ্বনিগুচ্ছটি, তখন এ ধ্বনিগুচ্ছকে ঘিরে জড়ো হয় অর্থ। {আম} ধ্বনিগুচ্ছটির আছে অর্থ, তাই এটি একটি শব্দ। আম বলতে আমরা বুঝি একরকম ফল। শব্দের অর্থ থাকে। তবে শব্দ ও তার অর্থের মধ্যে কিন্তু নেই কোনো স্বর্গীয় স্বাভাবিক সম্পর্ক: শব্দের সঙ্গে অর্থের সম্পর্ক পাতানো বন্ধুত্ব। আম বলতে আমরা একটি ফল বুঝি। এর কারণ হলো আমরা সবাই মেনে নিয়েছি যে আম বললে আমরা অন্য কোনো কিছু বুঝব না, বুঝব বিশেষ ধরনের একটি ফল। ধ্বনির আপন কোনো অর্থ নেই। কিন্তু অর্থ আছে ধ্বনিদের মিলনে গড়ে ওঠা শব্দের।

সামান্য কয়েকটি ধ্বনি অসীম শক্তিমান। তারা একে অন্যের সঙ্গে মিলে নানা কৌশলে গড়ে তোলে ভাষার লাখ লাখ শব্দ। বাংলা ভাষায় কত শব্দ আছে, তা কেউ জানে না। মনে করা যাক বাংলা ভাষায় শব্দ আছে এক কোটি। মাত্র ছত্রিশটি ধ্বনি একে অন্যের সঙ্গে নানাভাবে মিলে গড়ে তুলেছে ওই এক কোটি শব্দ। তবে ওই এক কোটি শব্দ বানাতে গিয়েই সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলেনি ধ্বনিগুলো। ইচ্ছে করলে ওই ধ্বনিগুলোকে অন্যভাবে সাজিয়ে অন্যভাবে গেঁথে আমরা বানাতে পারি নতুন নতুন শব্দ।

ধ্বনির সঙ্গে ধ্বনি গেঁথে তৈরি করা হয় শব্দ। তবে কোন ধ্বনির সঙ্গে কোন ধ্বনি গাঁথা যাবে, তার রয়েছে অনেক নিয়ম। পৃথিবীর সব ভাষাতেই রয়েছে ধ্বনি গাঁথার আপন নিয়ম। যে নিয়মে ধ্বনি গাঁথা হয় বাংলায়, সে নিয়মে ধ্বনি গাঁথা হয় না ইংরেজিতে, বা জাপানিতে, বা ফরাসিতে। বিভিন্ন ভাষার ধ্বনিদের মধ্যে থাকে পার্থক্য, আর থাকে ধ্বনি গাঁথার নিয়মের পার্থক্য। তাই একটি ভাষা পৃথক হয়ে ওঠে অন্য ভাষা থেকে। যদি সব ভাষাতে থাকত একই রকম ধ্বনি ও ধ্বনি গাঁথার নিয়ম, তবে পৃথিবীতে থাকত শুধু একটি ভাষা। বাংলা ভাষায় রয়েছে ধ্বনি গাঁথার অনেক নিয়ম। সব নিয়ম আমরা সচেতনভাবে জানি না কেউ। কিন্তু অচেতনভাবে জানি সবাই। দুটি ধ্বনি নেওয়া যাক; [আ] এবং [ম্]! আগে আ এবং পরে ম বসিয়ে বানাতে পারি আম শব্দটি। এটি একটি বাংলা শব্দ। যদি আগে [ম্] এবং পরে [আ] বসাই, তবে গড়ে ওঠে মা শব্দটি। এটিও বাংলা শব্দ। [অ] ধ্বনি এবং [ঙ] ধ্বনি এবং [ক] ধ্বনি মিলিয়ে পাই অঙ্ক শব্দটি। এটিও একটি বাংলা শব্দ। বাংলা অনেক শব্দেই পাওয়া যায় [ঙ] ধ্বনিটিকে। কিন্তু [ঙ] ধ্বনি দিয়ে কোনো শব্দ শুরু হয় না বাংলায়। তাই ‘ঙাক’ বা ‘ঙুকু’ বলে কোনো শব্দ পাওয়া যাবে না বাংলায়।

শুধু ব্যঞ্জনধ্বনি দিয়েও কোনো শব্দ হয় না বাংলায়। তাই আমরা বানাতে পারি না ক্চ্শ্-র মতো শব্দ। এটি কেউ উচ্চারণ করতে পারবে না। দুটি ব্যঞ্জনধ্বনিকে জোড়া দেওয়ার জন্য বাংলা ভাষায় অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে একটি স্বরধ্বনি। একটি ইংরেজি শব্দ, রিস্ক, নেওয়া যাক। এ শব্দটি বানাতে লেগেছে [র্, ই্, স্, ক্], ধ্বনি চারটি। চারটি ধ্বনিই আছে বাংলাতে। তবু রিস্ক শব্দটি বাংলা নয়। কেন? যেহেতু এটি বাংলা ভাষাতে নেই, তাই কি এটি বাংলা শব্দ নয়? না, এটি বাংলা নয় অন্য কারণে। যে নিয়মে এ শব্দে ধ্বনিরা মিলেছে, সে নিয়ম নেই বাংলায়। বাংলা ভাষায় কোনো শব্দের শেষে ‘স্ক’ ধ্বনিগুচ্ছ থাকতে পারে না, কিন্তু থাকতে পারে ইংরেজিতে এবং অন্য অনেক ভাষায়। আস্ক, মাস্ক, ডিস্ক-এর মতো শব্দ বাংলায় নেই, বাংলা শব্দের শেষে ‘স্ক’ ধ্বনিগুচ্ছ থাকতে পারে না বলে। বাংলায় শব্দের শেষে থাকতে পারে না যুক্তব্যঞ্জন। এবার একটি শব্দ বানানো যাক: টশর। এ শব্দটির অর্থ কেউ জানে না, এ শব্দটি এর আগে কেউ শোনেনি। কেননা, এটিকে আগে বানানোই হয়নি। কিন্তু এটিকে বানানো যেত যেকোনো সময়। ট-অ-শ-অ-র ধ্বনি বাংলা শব্দে বসতে পারে পাশাপাশি। তাই এ ধ্বনিগুলোকে পরস্পরের সঙ্গে গেঁথে অনায়াসে বানাতে পারি ‘টশর’ শব্দটি। এ শব্দটির প্রয়োজন এর আগে কেউ বোধ করেনি, তাই শব্দটি জন্ম পায়নি। আজ দরকার হলো, তাই বানিয়ে নিলাম। এখন প্রশ্ন উঠবে ‘টশর’ শব্দের অর্থ কী? এর অর্থ কেউ জানে না, আমিও জানি না। ইচ্ছে করলেই আমরা এ শব্দটিকে দিতে পারি একটি অর্থ। ‘টশর’ শব্দটিকে দেওয়া যাক এর অর্থটি: রূপকথার যে জানোয়ারের কপালে একটি ধারালো শিং আছে, তাকে বলে টশর। একটি নতুন শব্দ বানালাম আমরা।

তবে আমরা প্রতি মুহূর্তে কিন্তু একেবারে অচেনা-অজানা শব্দ বানাই না। ধ্বনির সঙ্গে ধ্বনি গেঁথে হাজার হাজার মূল শব্দ অনেক আগেই বানানো হয়েছে বাংলায়। সে মূল শব্দগুলোকে নানাভাবে ব্যবহার করি আমরা। কখনো অবিকলভাবে ব্যবহার করি, কখনো এক শব্দকে গেঁথে দিই অন্য শব্দের সঙ্গে এবং বানিয়ে তুলি আরেকটি নতুন শব্দ। কোনো শব্দের বাঁয়ে যোগ করি অন্য এক শব্দ, কোনো শব্দের ডানে যোগ করি অন্য এক শব্দ। ফলে পাই নতুন নতুন শব্দ। ছোট ছোট শব্দকে গেঁথে গেঁথে বানিয়ে তুলি নতুন বড় বড় শব্দ। শব্দের সঙ্গে শব্দ গেঁথে নতুন শব্দ বানানোর অনেক নিয়ম আছে বাংলায় এবং সব ভাষায়। কেউই আমরা সবগুলো নিয়ম সচেতনভাবে জানি না। তবে বেশ জানি অসচেতনভাবে। ভাষা এক মজার ব্যাপার। এর সামান্য অংশ শিখতে হয় সচেতনভাবে আর বড় প্রকাণ্ড অংশ আমরা শিখে ফেলি এমনি এমনি। তা যদি না হতো, তবে ভাষা ব্যবহার করতে পারতাম না আমরা। শব্দের সঙ্গে শব্দ গেঁথে নতুন শব্দ বানানোর নিয়মগুলো আমরা অসচেতনভাবে জানি। কেউ জানি একটু বেশি, কেউ একটু কম।

যখন কথা বলি আমরা, তখন শব্দগুলোকে এমনভাবে ব্যবহার করি যাতে একটির সঙ্গে অন্যটির বেশ গভীর বন্ধুত্ব জন্মে। শব্দগুলোকে ছাড়াছাড়াভাবে উচ্চারণ করে যাই না, বরং তাদের মধ্যে পাতিয়ে দিই নানা রকম সম্পর্ক। এ সম্পর্ক পাতানোর সময় অনেক শব্দের চেহারা যায় বদলে। কোন শব্দের চেহারা কেমনভাবে বদলে যাবে, তার নিয়মকানুন বেশ জানি আমরা। আমি একটি বাংলা শব্দ, তুমি একটি বাংলা শব্দ, চিনি একটি বাংলা শব্দ। যখন এ শব্দ তিনটিকে একসঙ্গে বসিয়ে কোনো কথা বলি তখন আমি বা তুমির চেহারা বদলে যেতে পারে। আমি বলতে পারি, আমি তোমাকে চিনি। আমি তোমাকে চিনি বলার সময় তুমির সঙ্গে যোগ করেছি কে শব্দটিকে; আর অমনি তুমি বদলে হয়েছে তোমা। আমরা কখনো বলি না: * আমি তুমিকে চিনি; কেননা আমরা জানি যে তুমির সঙ্গে কোনো কিছু যোগ করলে তুমি বদলে তোমা হয়ে যায়। তেমনি বলতে পারি তুমি আমাকে চেনো। এখানে দেখছি যে আমির সঙ্গে কে যোগ করায় আমি বদলে হয়ে গেছে আমা। আমরা কখনো বলি না তুমি আমিকে চেনো; কেননা আমির সঙ্গে কোনো শব্দ যোগ করলে আমি হয়ে যায় আমা। খুব চমত্কারভাবে বদলে যায় সে শব্দটি। যদি বলি সে আমাকে চেনে, তখন সে-এর কোনো বদল ঘটে না। কিন্তু যখন বলি আমি তাকে চিনি; তখন সে-র সঙ্গে কে শব্দটি যোগ করার ফলে সে বদলে হয়ে গেছে তা। আমরা কখনো বলি না: * আমি সেকে চিনি বা * সেরা আমাকে চেনে, বা * সেদের অনেক বই আছে। সে-এর সঙ্গে কোনো কিছু যোগ করলেই সে বদলে হয়ে যায় তা। কথা বলার সময় এভাবে বদলে যায় অনেক শব্দের আপন চেহারা। খুব বেশি শব্দের চেহারা এমনভাবে বদলায় না। চেহারা বদলে কিন্তু সৃষ্টি হয় না একেবারে অচেনা অজানা অভিনব শব্দ। বরং শব্দগুলো একটু নতুন চেহারা পায়।

কিন্তু শব্দের সঙ্গে শব্দ মিলিয়ে আমরা তৈরি করতে পারি বেশ নতুন শব্দ, যাদের অর্থও নতুন। এমন নতুন শব্দ বানানার হাজারো নিয়ম আছে বাংলায়। এ নিয়মগুলো তৈরি করে অজস্র নতুন শব্দ। একটি শব্দ নিচ্ছি: সংবাদ। এ শব্দটি আমরা প্রতিদিন শুনি, এর অর্থও জানি অনেকে। এটির সঙ্গে যোগ করতে পারি ইক রূপের একটি শব্দ। সংবাদ ও ইক যোগ করে বানাতে পারি সাংবাদিক শব্দটি। যাঁরা সংবাদ সংগ্রহ করেন ও পরিবেশন করেন তাঁদের বলা হয় সাংবাদিক। যদি সং বদলে সাং না হতো, তাহলে পেতাম সংবাদিক। কিন্তু সংবাদিক শব্দটিকে আমরা গ্রহণ করি না, গ্রহণ করি সাংবাদিক শব্দটিকে। সাংবাদিক শব্দের সঙ্গে যোগ করতে পারি তা শব্দটি এবং বানাতে পারি সাংবাদিকতা শব্দটি। সাংবাদিকের পেশা বা কাজকে বলা হয় সাংবাদিকতা। এভাবে সাহিত্য শব্দের সঙ্গে ইক যোগ করে বানাতে পারি সাহিত্যিক শব্দটি। একই নিয়মে প্রবন্ধ শব্দের সঙ্গে ইক শব্দ যোগ করে বানাতে পারি প্রাবন্ধিক শব্দ। কিন্তু সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক শব্দের সঙ্গে তা যোগ করে আর কোনো নতুন শব্দ আমরা বানাই না। তাই বাংলা ভাষায় *সাহিত্যিকতা, বা * প্রাবন্ধিকতা রূপের কোনো শব্দ নেই। সাহিত্যিক-এর পেশাকে আমরা * সাহিত্যিকতা বলি না এবং প্রাবন্ধিক-এর পেশাকেও বলি না * প্রাবন্ধিকতা। শব্দ বানানোর নিয়মগুলোর শক্তি বেশ কম। প্রতিটি নিয়ম দিয়ে বানাতে পারি সামান্য কয়েকটি শব্দ। যদি কোনো নিয়মকে প্রচুর পরিমাণে খাটাই, তবে এমন সব শব্দ বানিয়ে ফেলব, যারা একেবারে নতুন ও অর্থহীন।

আপাদমস্তক, আসমুদ্রহিমাচল-এর মতো শব্দ বইতে মাঝে মাঝে পাওয়া যায়। আপাদমস্তক শব্দটির অর্থ হচ্ছে পা থেকে মাথা পর্যন্ত, আসমুদ্রহিমাচল শব্দের অর্থ সমুদ্র থেকে হিমাচল পর্যন্ত। এ শব্দগুলো বানানো হয়েছে একটি মজার নিয়ম খাটিয়ে। কোনো জায়গা থেকে অন্য কোনো জায়গা পর্যন্ত এলাকাকে বোঝানোর জন্য আমরা ব্যবহার করি নিয়মটি। প্রথমে বসাই একটি আ, পরে বসাই শুরু এলাকার শব্দটি এবং শেষে বসাই শেষ এলাকার শব্দটি। এভাবে বানাই আপাদমস্তক, আসমুদ্রহিমাচল ইত্যাদি শব্দ। কিন্তু এ নিয়মটি খাটিয়ে বানানো যায় না বেশি শব্দ। তাই আমরা বানাতে পারি না * আবাড়িইস্কুল (বাড়ি থেকে ইস্কুল পর্যন্ত),  আঘরমাঠ (ঘর থেকে মাঠ পর্যন্ত), বা আঅনন্যমৌলি (অনন্য থেকে মৌলি পর্যন্ত)। এসব শব্দ এ নিয়মের সাহায্যে বানানো যায়, তবে তাদের মেনে নেবে না অনেকে। মাঝে মাঝে কবিরা অভাবিতভাবে শব্দ বানাতে পারেন। স্বপ্ন থেকে শরীর পর্যন্ত এলাকা বোঝানোর জন্য যদি বানাই আস্বপ্নশরীর শব্দটি,  তবে এটিকে মেনে নিতে পারে অনেকে।

শব্দ বানানোর রয়েছে অনেক কৌশল। কৌশলগুলো বেশ মজার, চমত্কার খেলার মতো মনে হতে  পারে। শব্দ যাদের মুগ্ধ করে তারা বানাতে চায় নতুন নতুন শব্দ। অনেকে শব্দকে সাজিয়ে দিতে পারে অনেক রঙে, বিভিন্ন গন্ধে। যারা তা পারে, তারা কেবল প্রতিদিনের কথা বলার জন্য শব্দ ব্যবহার করে না। তারা কথাকে অমর করে রাখতে চায়। তারা কবি। তারা পৃথিবীকে ভরে দেয় শব্দের রূপে ও সৌরভে।

বুকপকেটে জোনাকিপোকা বই থেকে