শব্দগুলো অনেক মজার

যে শব্দ যখন তৈরি হয়, তখন তার নির্দিষ্ট একটা অর্থ থাকে। কিন্তু পরে দেখা যায়, শব্দটির একাধিক অর্থ তৈরি হয়ে গেছে। কখনো এমনও হয় যে শব্দটির একেবারে নতুন অর্থ তৈরি হয়ে যায়। মোটকথা, শব্দের মতিগতি বুঝে ওঠা বেশ মুশকিল। অভিধান থেকে তুলে আনা এই রকম শব্দ ও বাগ্‌ধারা নিয়ে আজকের এই গল্প।

বানচাল

মাঝনদীতে মাঝি যদি হঠাৎ দেখে, তার নৌকা বানচাল হতে বসেছে, তখন সে যথাসাধ্য চেষ্টা করে নৌকা বাঁচানোর। বানচাল ঠেকানো সম্ভব না হলে হাল ছেড়ে দিয়ে মাঝি পানিতে গা ভাসিয়ে দেয়। অবশ্য এ অবস্থা শুধু নৌকার মাঝির। নৌকায় যদি আরোহী থাকে, তাদের অবস্থার বর্ণনা ভিন্ন রকম। অনেক সময় তা মর্মন্তুদ হয়ে থাকে।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, নৌকা কীভাবে বানচাল হয়? হাজারবার কসম খেয়ে মাঝি যদি বলে, নৌকা সত্যিই বানচাল হয়ে গেল, তার পরও মানুষ কিন্তু ভাবতে থাকবে, নৌকা কি কখনো বানচাল হওয়া সম্ভব? সবাই জানে ষড়যন্ত্র বানচাল হয়, অভিসন্ধি বানচাল হয়, গোপন পরিকল্পনা বানচাল করে দেওয়া হয়। তাই বলে নৌকা কীভাবে বানচাল হবে?

এসব ভাবনার অবশ্য কূলকিনারা পাওয়া অসম্ভব কোনো ব্যাপার নয়। নৌকা সত্যিই বানচাল হয় এবং নৌকা বানচাল হয় বলেই বানচাল কথাটা আমরা নৌকা থেকে উঠিয়ে ভাষার জায়গায় নিয়ে আসতে পেরেছি। আসল কথা হলো, নৌকা বানানোর সময় এক তক্তার সঙ্গে অন্য তক্তা জোড়া দেওয়ার জন্য যে খাঁজ কাটা হয়, তাকে বলে বান। এই বান আলগা হয়ে যাওয়া থেকেই বানচাল শব্দটা তৈরি।

নৌকা বানচাল হয় আবার ষড়যন্ত্রও বানচাল হয়। একই বানচাল শব্দ দুই জায়গায় দুই রকমভাবে দুই ধরনের অর্থ নিয়ে ব্যবহৃত হয়। ভাষায় সবই সম্ভব। বানচাল শব্দের মূল অর্থ হলো নৌকার তক্তার জোড় ফাঁক হয়ে যাওয়া। আর পরবর্তী অর্থ হলো ফেঁসে যাওয়া, ভেস্তে যাওয়া ইত্যাদি।

উৎসর্গ

বায়ান্নর ভাষাশহীদেরা মাতৃভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদেরা দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে বই উৎসর্গ করেছিলেন। উৎসর্গ সর্বদাই ভালো কাজ বা মহৎ উদ্দেশ্যে নিঃস্বার্থ দান বা নিবেদন। সব দানের ক্ষেত্রে উৎসর্গ শব্দটি ব্যবহার করা হয় না। উৎসর্গ শব্দটা তাই বহুল ব্যবহৃত নয়।

উৎসর্গ শব্দটা সংস্কৃত ভাষা থেকে আসা। উৎসর্গ শব্দ গোড়ার দিকে ধর্মীয় কাজকর্মের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। হিন্দু সম্প্রদায়ের যাগযজ্ঞে উপহার প্রদান, দেবতার উদ্দেশ্যে পশু বলি দেওয়া ইত্যাদি ব্যাপার ছিল উৎসর্গ। পরে তা থেকে উৎসর্গ শব্দের নতুন অর্থ দাঁড়ায়। সৎ উদ্দেশ্যে অর্পণ, মহৎ উদ্দেশ্যে স্বত্ব ত্যাগ, কারও উদ্দেশে নিবেদন ইত্যাদি ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়াদি হয় উৎসর্গ।

শব্দের মতিগতি সত্যিই বোঝা দায়। পরবর্তীকালে উৎসর্গ শব্দটির অর্থ ও উদ্দেশ্য আরও সরল হয়ে পড়ে। উৎসর্গ বলতে পরিহার বা পরিত্যাগ করাও বোঝানো হতে থাকে। পেটের মল যেহেতু সর্বদাই পরিত্যাজ্য বিষয়, তাই এককালে মলত্যাগ করা, অর্থাৎ একালের শহুরে ভাষায় টয়লেট করাকেও উৎসর্গ বিবেচনা করা হতো। ঘুম থেকে উঠে লোকে তখন বলত, যাই একবার উৎসর্গ করে আসি।

সুখের বিষয়, একালে উৎসর্গ শব্দটা তার অর্থের অধঃপতন থেকে রক্ষা পেয়েছে। উৎসর্গ বলতে আমরা এখন শুধু নিঃস্বার্থ ত্যাগ বা নিবেদনই বুঝে থাকি, অন্য কোনো ত্যাগ নয়।

বোকার স্বর্গ

নির্বোধ প্রায় সর্বদাই বোকার স্বর্গে বাস করে। বুদ্ধিমানেরা বাস করে মাঝেমধ্যে। বোকার স্বর্গে বাস করা নিয়ে নির্বোধের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। তবে বুদ্ধিমানের আছে। বোকার স্বর্গে থাকার ব্যাপারটা বুদ্ধিমানেরা একসময় টের পেয়ে যায় এবং আফসোস করে বলে, এদ্দিন কী ভুলটাই না করেছি, না বুঝে বোকার স্বর্গে বাস করেছি।

বোকার স্বর্গ একটি বাগ্‌ধারা এবং এটি ইংরেজি ‘ফুলস প্যারাডাইজ’ বাগ্‌ধারার সরাসরি অনুবাদ। এদিক থেকে বিচার করলে দেখা যাবে বাঙালি মাত্র আড়াই শ বছর ধরে, অর্থাৎ ইংরেজরা এ দেশে আসার পর থেকে বোকার স্বর্গে বাস করার অধিকার ভোগ করছে।

ফুলস প্যারাডাইজ বা বোকার স্বর্গ বাগ্‌ধারাটি তৈরির পেছনে একটি ইতিহাস রয়েছে। মৃত্যুর পর বিকৃত মস্তিষ্ক ব্যক্তিদের আত্মার পরিণতি প্রসঙ্গে মধ্যযুগের খ্িরষ্টান ধর্মযাজকেরা মত দিয়েছিলেন যে অপরিণত বুদ্ধির বা বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ জীবনে যেসব ভুল করে থাকে, তার জন্য তাদের কোনো পাপ হবে না। কারণ, বুদ্ধি না থাকার দরুনই তারা ভুলগুলো করে থাকে। অন্যদিকে, ঈশ্বর নিজেই যেহেতু তাদের এ অবস্থায় ফেলেছেন, সে জন্য মৃত্যুর পর তাদের আত্মার বিচারও হবে না।

তা ছাড়া স্বর্গ যেহেতু কেবলই পুণ্যবানদের জন্য, সে কারণে ওই সব আত্ম কোনো দিন স্বর্গে প্রবেশ করতে পারবে না। আবার নরকেও তাদের যেতে হবে না এ জন্য যে তারা পাপ করেছে না বুঝেই। অতএব, তাদের আত্মার যেমন বিচার হবে না, তেমনি তাদের আত্মার স্থান হবে স্বর্গ ও নরকের বাইরে ভিন্ন একটি স্থানে। রসিক মানুষ এই স্থানের যে নাম দেয়, ইংরেজিতে সেটাই ফুলস প্যারাডাইজ, বাংলায় বোকার স্বর্গ।

অর্থ বদলে গিয়ে ফুলস প্যারাডাইজ একসময় বাগ্‌ধারায় পরিণত হয়। অর্থ দাঁড়ায় অবাস্তব সুখকল্পনার মধ্যে থাকা বা কল্পিত সুখে বিভোর থাকা। বাংলা বোকার স্বর্গ বাগ্‌ধারার অর্থও তা-ই।

অস্ত্রশস্ত্র

একক শব্দের জায়গায় জোড়া শব্দের ব্যবহার বাংলা ভাষার এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্টে্যর মারপ্যাঁচে পড়ে অনেক জোড়া শব্দের দ্বিতীয় শব্দটি সম্পূর্ণ স্বাধীন হওয়া সত্ত্বেও প্রথম শব্দটির বহুবচন হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে। ফলে, কালক্রমে দ্বিতীয় শব্দটির স্বাধীন প্রয়োগ লোকমুখ থেকে হারিয়ে যায়। প্রথম শব্দের সঙ্গে না থাকলে দ্বিতীয় শব্দটিকে আর আলাদা করে চেনা যায় না।

ঠিক এ রকম ব্যাপারই ঘটেছে অস্ত্রশস্ত্র শব্দের শস্ত্রের বেলায়। শস্ত্রও যে একটি স্বাধীন শব্দ এবং সেও যে সমাসবদ্ধ পদ শস্ত্রপানি হয়ে শব্দের আগে বসতে পারে, সে কথা আমরা প্রায় ভুলে যেতে বসেছি।

অস্ত্র ও শস্ত্র দুটো আলাদা শব্দ। দুটোর অর্থ আলাদা, কিন্তু কাজ একই। এই একই ধরনের কাজ করার কারণে শস্ত্র শব্দটি অস্ত্র শব্দের অনুগামী হতে বাধ্য হয়েছে।

অস্ত্র শব্দের অর্থ হলো যা নিক্ষেপ করে আঘাত করা হয়। যেমন: বাণ, বর্শা ইত্যাদি। এদিক থেকে কামান, বন্দুকও অস্ত্র। অন্যদিকে, শস্ত্র শব্দের অর্থ হলো যা হতে ধরে রেখে আঘাত করতে হয়। যেমন: তরবারি, গদা, ছুরি, চাকু ইত্যাদি।

মারপ্যাঁচ

অন্যের কথার মারপ্যাঁচে আমরা নিজেরা বশীভূত হই। আবার নিজের কথার মারপ্যাঁচে অন্যকে কাবু করি। এতে ভয়ের কিছু নেই। কিন্তু মারপ্যাঁচ শব্দের মূলে যা আছে, তার কবলে পড়লে ভীত হতেই হবে।

মার ও প্যাঁচ, এই দুটি শব্দ মিলে তৈরি হয়েছে বাংলা ভাষার মারপ্যাঁচ। বাংলায় চার রকমের অর্থওয়ালা মার শব্দ রয়েছে। একটি মার শব্দের অর্থ হলো মৃত্যু। আরেক মার হলো ভারতীয় পুরাণের প্রেমের দেবতার ভিন্ন এক নাম। অন্য এক মার হলো বৌদ্ধধর্মে বর্ণিত তপস্যাবিঘ্নকারী চরিত্র, অর্থাৎ বৌদ্ধধর্মের শয়তান। চতুর্থ মার শব্দটি বহুল প্রচলিত। এটি সেই চিরপরিচিত মার, মাথায় বাড়ি মারা থেকে পকেট মারার কাজ পর্যন্ত যার ক্রিয়ায় সাধিত হয়।

মারপ্যাঁচ শব্দের যে মার, সেই মার বাংলায় আলাদাভাবে ব্যবহৃত হয় না। এই মার শব্দটি ফারসি ভাষার, অর্থ হলো সাপ। প্যাঁচ শব্দটিও ফারসির, পেচ শব্দের বাংলা রূপান্তর। প্যাঁচ শব্দের জুতসই অর্থের জন্য অভিধান না খুলে একটা স্ক্রু বা একটা জিলিপি দেখে নেওয়া ভালো।

দুটি ফারসি শব্দের জোটবাঁধা ফারসি মারপেচ শব্দের অর্থ হলো সাপের কুণ্ডলী আর বাংলা মারপ্যাঁচ শব্দের অর্থ কূটকৌশল, ফন্দিফিকির ইত্যাদি।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল