শব্দের মজা

বাংলা ভাষায় এমন কিছু শব্দ রয়েছে, যেগুলোর মূল অর্থের সঙ্গে বর্তমান অর্থের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় না। আজ অভিধানের গল্প এই রকম কিছু শব্দ নিয়ে। প্রবীণ শব্দের প্রকৃত অর্থ কী, বিশদ বলতে আসলে কী বোঝায়, এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে আজকের গল্পে।

বিকাল

দুপুরের পর বিকাল বা বিকেল আসে। গরমের সময় শরীর জুড়াতে থাকে। ভালো লাগে। মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে উঠতে শুরু করে। ফুরিয়ে আসে দিনের কাজ। বিকাল হলো দিনের শেষ বেলাকার কাল। অন্য কথায়, অপরাহ্ন সূর্যাস্তের পূর্ববর্তী শেষ সময়টা। পাঁজি বা বাংলা পঞ্জিকায় বিকাল সময়টা তেমন ভালো নয়। হিন্দু ধর্মমতে বিকালটা শুভকর্মের জন্য খানিকটা নিষিদ্ধ কাল। কারণ, বিকাল শব্দের মূল অর্থ হলো বিরুদ্ধ কাল বা রাক্ষসী বেলা।

বিশদ

ব্যাখ্যা ও বিবরণের সঙ্গে বিশদ শব্দটির প্রগাঢ় সম্পর্ক। অনেক ক্ষেত্রেই বিশদ ব্যাখ্যা কিংবা বিশদ বিবরণ বা বর্ণনার প্রয়োজন হয়। বিশদ শব্দের বর্তমান অর্থ সুস্পষ্ট কিংবা পরিস্ফুট।

শব্দ হিসেবে বিশদ বেশ বিভ্রান্তিকর একটা শব্দ। কালে কালে শব্দটি বিভিন্ন অর্থ ধারণ করেছে। মধ্যযুগে বিশদ বলতে বোঝাত চিত্তপ্রসাদজনক বা রমণীয়। মনকে যা উৎফুল্ল করে মধ্যযুগে সেটাই ছিল বিশদ। তবে বিশদ শব্দের মূল অর্থ শুভ্র, সাদা, নির্মল।

বৃদ্ধ

প্রবীণ, বয়োজ্যেষ্ঠ, মুরব্বি মানুষকে আমরা বৃদ্ধ বলে জানি। প্রাচীন বা অভিজ্ঞ অর্থেও বৃদ্ধ শব্দের ব্যবহার লক্ষ করা যায়।

কত বছর বয়সের মানুষকে বৃদ্ধ বলা যাবে, সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়াটা বেশ মুশকিল। সাধারণ হিসেবে প্রৌঢ়ত্বের পরে আসে বার্ধক্য বা বৃদ্ধকাল। চিকিৎসাবিজ্ঞানে ৬০ বছর পার হওয়া মানুষকে এল্ডারলি, বাংলায় বয়সী বা বৃদ্ধ বলে ধরা হয়। তবে হিন্দুধর্মের স্মৃতিশাস্ত্রমতে, ৭০ বছরের ঊর্ধ্ব বয়স্ক ব্যক্তি হলেন বৃদ্ধ।

মজার ব্যাপার, বৃদ্ধ শব্দের অর্থ হলো বৃদ্ধিপ্রাপ্ত অর্থাৎ যা বৃদ্ধি পেয়েছে।

প্রবীণ

বাংলা ভাষায় প্রবীণ শব্দটি একদা নানান অর্থে ব্যবহার করা হতো। এ কালে শব্দটির ব্যবহার খুব সীমিত। সাধারণভাবে প্রবীণ শব্দের অর্থ বিজ্ঞ; নিপুণ; কুশলী; বহুদর্শী; বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন; বয়োবৃদ্ধ ইত্যাদি। তবে এত সব অর্থ থাকা সত্ত্বেও প্রবীণ শব্দের বর্তমান ব্যবহার শুধু বয়োবৃদ্ধ অর্থেই বেশি চলে। এখন নিপুণ ও কুশলী কোনো মধ্যবয়সী শিল্পীকে প্রবীণ আখ্যা দিলে তিনি মনে খুব আঘাত পাবেন এই ভেবে যে বুড়ো না হতেই তাঁকে বুড়ো বলা হলো। প্রবীণ এখন নবীনের বিপরীতার্থক শব্দমাত্র।

তবে প্রবীণ শব্দটির শেষ কথা এখানেই নয়। প্রবীণ শব্দের মূল অর্থ হলো যিনি বীণাবাদনে প্রকৃষ্ট, অর্থাৎ যিনি নিপুণ ও কুশলী হাতে বীণা বাজাতে পারেন।

ব্যঙ্গ

উপহাস, ঠাট্টা, বিদ্রূপ বোঝাতে আমরা ব্যঙ্গ শব্দটি ব্যবহার করে থাকি। ব্যঙ্গ থেকে শব্দ তৈরি হয় ব্যঙ্গাত্মক, ব্যঙ্গার্থ, ব্যঙ্গোক্তি ইত্যাদি। এগুলোর সবই বিদ্রূপের, শ্লেষের, উপহাসের সঙ্গে জড়িত।

ব্যঙ্গ শব্দের মূল অর্থ কিন্তু মর্মান্তিক। ব্যঙ্গ শব্দের মূল অর্থ হলো বিকৃত অঙ্গ যার।

মমতা

দরদ, মায়া, স্নেহ ইত্যাদি বলতে মমতা শব্দটি ব্যবহার করা হয়। যাঁদের হৃদয়ে মায়ামমতা বলতে কিছু নেই, তাঁরা অতিশয় স্বার্থপর ব্যক্তি। দেখা যায়, মমতা শব্দটি অধিকাংশ সময়ে মায়ার সঙ্গে জোড়া লেগে থাকে।

বাংলায় মম বলে একটা শব্দ রয়েছে। শব্দটির ব্যবহার গানে আর কবিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মম শব্দের অর্থ আমার। আমাদের মুখের কথায় মমতার সঙ্গে মম শব্দের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। মম থেকেই মমতা শব্দটা তৈরি।

মমতা শব্দের মূল অর্থ মমভাব অর্থাৎ ‘এটা আমার’ এই রকম মনে করা অর্থাৎ চূড়ান্ত স্বার্থপরতা।

সুতরাং

সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলায় সুতরাং শব্দটির আগমন। তবে সংস্কৃতে যা সুতরাং বাংলায় তা নয়। সংস্কৃত থেকে বাংলায় এসে শব্দটির অর্থের পরিবর্তন ঘটেছে প্রচুর। বাংলায় সুতরাং বলতে আমরা বুঝি অতএব, কাজেই, অগত্যা, এই হেতু ইত্যাদি।

সুতরাং শব্দের মূল অর্থ অধিকতরভাবে, প্রচুর, অনন্ত, অতিশয় ইত্যাদি।

ঐশ্বর্য

শব্দের অর্থের গৌরবহানির প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো ঐশ্বর্য শব্দটি। বস্ত্তত ঐশ্বর্যের সঙ্গে মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ ঐশ্বর্য বলতে আমরা মানুষের বিষয়সম্পত্তির কথাই বুঝে থাকি। ঐশ্বর্য শব্দের বর্তমানে প্রচলিত অর্থ হলো ধনসম্পত্তি; বৈভব; প্রভাব-প্রতিপত্তি ইত্যাদি।

ঈশ্বর থেকে ঐশ্বর্য শব্দটি তৈরি। ঐশ্বর্য শব্দের মূল অর্থ ঈশ্বরের ভাব বা কর্ম; অলৌকিক গুণ বা শক্তি।

সামান্য

তুচ্ছ, নগণ্য, অল্প অর্থেই সামান্য শব্দের ব্যবহার বেশি। তবে সাধারণ, গুরুত্বহীন অর্থেও সামান্য শব্দটি ব্যবহৃত হয়। সামান্য শব্দের মূল অর্থের সঙ্গে বর্তমানে প্রচলিত অর্থের সামান্য সম্পর্কও নেই। সামান্য শব্দের মূল অর্থ হলো সমানতা, সমানভাব।