শ্রেষ্ঠ নয় ঘণ্টা

অলংকরণ: মাহফুজ রহমান
অলংকরণ: মাহফুজ রহমান

ক্রিকেটপাগল হিসেবে ভালো সুনাম থাকায় স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখাটা রীতিমতো স্বপ্ন ছিল আমার কাছে। প্রথমবার স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখার অভিজ্ঞতাটাও যে তাই অতি রোমাঞ্চকর হবে আমার জন্য, সেটা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না।

২০১২ সাল। পিএসসি নামের বুলডোজারের বছর ছিল সেটা। স্কুলে মডেল টেস্ট চলাকালে একদিন পত্রিকায় চোখে পড়ল, বাংলাদেশ বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের ফিকশ্চার। আমার মাথায় তখন খেলা দেখতে যাওয়ার পরিকল্পনার ঝড় বইছে। আমি মামাকে ফোন করে টিকিট জোগাড়ের কথা বললাম। মামা বললেন, চেষ্টা করে দেখবেন।

তারপর নভেম্বর মাসটা গেল পরীক্ষা দিতে দিতে। মডেল টেস্ট, পিএসসি—সব শেষ করে যখন অলস সময় কাটাচ্ছি, তখন একদিন মামা ফোন দিয়ে বললেন, টিকিট পাওয়া গেছে। আমার তো তখন খুশিতে গ্যাংনাম স্টাইলে নাচার মতো অবস্থা। তারপর শুরু হলো খেলা দেখতে যাওয়ার প্রস্তুতি। পতাকা কেনা, পোস্টার বানানো, অমুকতমুক করে পুরো হুলুস্থুল কাণ্ড! একদম উত্সবের আমেজ। পোস্টারে কী লিখব, সেটা জিজ্ঞেস করতে করতেই ভাইয়াকে রীতিমতো অতিষ্ঠ করে ফেলেছিলাম।

৮ ডিসেম্বর, ২০১২। এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। আমাদের খেলা দেখতে যাওয়ার দিন। পাঁচটি ওয়ানডে ম্যাচের সিরিজের শেষ ওয়ানডে দেখতে গিয়েছিলাম। মামাই নিয়ে গিয়েছিলেন আমাকে। সঙ্গে খালাতো ভাই। সিরিজের প্রথম দুটি ম্যাচ হয়েছিল খুলনায়।  দুটিতেই জিতেছে বাংলাদেশ। আর ঢাকায় পরের দুটি ম্যাচ জিতেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এখন শেষ ম্যাচের ওপর নির্ভর করছে সিরিজের ফলাফল। চরম উত্তেজনাপূর্ণ খেলা।

খেলা শুরু হওয়ার আধা ঘণ্টা আগে গ্যালারিতে সিট খুঁজে নিয়ে বসলাম। প্রথম ইনিংসে টস জিতে বাংলাদেশ বোলিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। বাংলাদেশ ভালো খেলছিল। ক্রিস গেইল আউট হওয়ার পর আমার সে কী নাচ! বাংলাদেশ একটা করে আউট করে আর পতাকা-পোস্টার নিয়ে আমাদের সে কী তুমুল লাফালাফি!

প্রথম ইনিংস শেষ হলো। মাঝের ৪০ মিনিটের বিরতি। এবার বাংলাদেশের ব্যাটিং। তামিম ইকবাল নেমেই প্রথমে দুটো চার মারলেন। তারপর এনামুল হক বিজয় নেমে পিটাপিটি করে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিলেন। সবচেয়ে       ভালো পার্টনারশিপ ছিল মাহমুদউল্লাহ আর মুশফিকুর রহিমের। যখন বাংলাদেশে ব্যাটিংয়ে তখন গ্যালারিতে  তুমুল হইচই। বাংলাদেশ ব্যাট করার সময় আমাদের  লাফালাফি যেন থামছিলই না। বাংলাদেশ জিততে তখন ২ রান লাগে ১১ বলে। হাতে তখনো দুই উইকেট।

ব্যাটিংয়ে ছিলেন নাসির হোসেন আর ইলিয়াস সানি। নাসির হোসেন আর ইলিয়াস সানি প্রান্ত বদল করে এক রান নিলেন। আমি ফোল্ডিং সিট নামিয়ে লাফ দেওয়ার প্রস্তুতির জন্য তার ওপর উঠে দাঁড়ালাম। বাংলাদেশের জিততে আর এক রান লাগে। ইলিয়াস সানি বল উড়িয়ে মারলেন। বল বাউন্ডারি লাইন স্পর্শ করেনি তখনো। নাসির হোসেন রান নিয়ে জয় উদ্যাপন করতে করতে ইলিয়াস সানির দিকে দৌড় দিলেন। আমিও দিলাম লাফ। তারপর নিশ্চিত পতন ধাম করে। ওমা! চেয়ার ফোল্ড হয়ে গেছে লাফ দেওয়ার পর। যাক ব্যথা নাহয় একটু পেলামই, বাংলাদেশ তো জিতেছে। মাঠের দিকে তাকিয়ে দেখি, সব প্লেয়ার ডাগআউট থেকে নাসির হোসেন আর ইলিয়াস সানির দিকে ছুটে যাচ্ছে। আহ্, কী সুন্দর দৃশ্য! কিন্তু কিছুক্ষণ পর দেখি, আম্পায়ার কী যেন বললেন, প্লেয়াররা ডাগআউটে ফিরে যাচ্ছেন আর নাসির হোসেন ও ইলিয়াস সানি আবার ব্যাটিং পজিশনে দাঁড়াচ্ছেন। ব্যাপার কী? আসলে ইলিয়াস সানি দৌড় শেষ না করেই জয়োল্লাস করতে নাসির হোসেনের দিকে ছুটে গিয়েছিলেন। আবার দুজন জায়গামতো দাঁড়ালেন। এবার নাসির হোসেন ভুল করলেন না। এমন জোরে মারলেন যে চৌধুরী জাফরউল্লাহ শরাফতের ভাষায়, ‘মাটি কামড়ে বল চলে গেল সীমানার বাইরেএএএ!’ প্লেয়ার আবার দৌড়ে ডাগআউট থেকে মাঠে ঢুকলেন—আবারও আমার সেই প্রিয় দৃশ্য! সৃষ্টিকর্তার কাছে হাজার হাজার কৃতজ্ঞতা যে তিনি আমাকে আমার প্রিয় দৃশ্য সরাসরি দেখার সুযোগ দুবার করে দিয়েছেন। তবে এবার আর চেয়ার থেকে লাফ দেওয়ার ভুলটা করলাম না। গ্যালারিতে দর্শকদের উল্লাস, চার-ছক্কা হলে বাংলাদেশ-বাংলাদেশ স্লোগান, পুরো গ্যালারির দর্শকেরা মিলে ঢেউ বানানো। বাংলাদেশ জেতার পর মিছিল করতে করতে বাসায় ফেরার প্রতিটা মুহূর্ত ছিল অসাধারণ। নয়টা ঘণ্টা যে কীভাবে কেটে গেল, তা বুঝতে পারলাম না।

বিজয়ের আনন্দ যে কত বড় আনন্দ, তা তুলনা দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়।

লেখক : শিক্ষার্থী, দশম শ্রেণি, ওয়াইডব্লিউসিএ উচ্চমাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, ঢাকা