আজাদের মা কেন ১৪ বছর একদানা ভাত খাননি
আজ শহীদ আজাদের জন্মদিন। ১৯৪৬ সালের ১১ জুলাই তাঁর জন্ম।
আজাদ ছিলেন মা–বাবার একমাত্র সন্তান। তাঁর বাবা ছিলেন ভীষণ বড়লোক। বাড়িতে হরিণ ছিল, সরোবর ছিল, মসলার বাগান ছিল।
সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে আজাদ যখন পড়েন ক্লাস সিক্সে, তাঁর বাবা আরেকটা বিয়ে করলে মা প্রতিবাদস্বরূপ আজাদকে নিয়ে স্বামীর গৃহ ত্যাগ করে বস্তিঘরে আশ্রয় নেন। অনেক কষ্টে তিনি আজাদকে লেখাপড়া শেখান। আজাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে মাস্টার্স করেন।
১৯৭১ সাল। আজাদের বন্ধু ছিলেন জাহানারা ইমামের ছেলে রুমী, ক্রিকেটার জুয়েল, বাস্কেটবল খেলোয়াড় কাজী কামাল প্রমুখ। বন্ধুরা সবাই আগরতলায় গিয়ে মেজর খালেদ মোশাররফের ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে ঢাকায় ফিরেছেন। ঢাকায় তাঁরা গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করেন। ফার্মগেট অপারেশন, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল অপারেশন—পাকিস্তানি সৈন্যদের ত্রস্ত করে তুলেছেন তাঁরা। তাঁরা আজাদকে বললেন, ‘তুইও আমাদের সঙ্গে চল, অপারেশনে যাই। তোর বাবার বন্দুক ছিল, তুই তো বন্দুক চালাতে জানিসই।’
আজাদ মায়ের কাছে অনুমতি নেন। আজাদদের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় নেন। আজাদ বন্ধুদের সঙ্গে একটি-দুটি অপারেশনে গিয়েওছিলেন। ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট রাতে আজাদদের মগবাজারের বাড়ি ঘিরে ফেলে পাকিস্তানি সৈন্যরা। আজাদ, কাজী কামাল, জুয়েল, বাশাররা তখন খালি গায়ে ক্যারম খেলছিলেন। ভীষণ গরম পড়েছিল সেই রাতে। কাজী কামাল একজন সৈন্যের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে গুলি করতে করতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। ধরা পড়েন বাকিরা।
ধরা পড়েন জুয়েল। আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল। ’৭১ সালে তাঁর বয়স ছিল ২১ বছর। তিনি ছিলেন মারকুটে ক্রিকেটার। আজাদ বয়েজ আর মোহামেডান ক্লাবে খেলতেন। ধরা পড়ার আগে একটা অপারেশনে গুলিতে তাঁর হাতের একটা আঙুল জখম হয়েছিল। ভীষণ হাসিখুশি এক তরুণ ছিলেন জুয়েল। সবাইকে হাসাতে পারতেন। উইকেট কিপিংও করতেন মাঠে।
এলিফ্যান্ট রোডের বাসা থেকে ধরা পড়েন শাফী ইমাম রুমী। তাঁর বয়স ছিল ২০ বছর। তিনি ঢাকার ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতেও তিনি ভর্তি হন। তিনি যুদ্ধে যেতে চান, মা তাঁকে যেতে দেবেন না। কিন্তু রুমী নাছোড়। এটা কেমন স্বার্থপরতা যে দেশের মানুষ যখন মুক্তির জন্য লড়ছে আর মরছে, তখন তিনি যাবেন যুক্তরাষ্ট্রে? শেষে মা বললেন, ‘যা, তোকে দেশের জন্য কোরবান করে দিলাম।’ এই একটা কথা চিরকাল জাহানারা ইমামকে দগ্ধকরেছে, ‘আহা, সেদিন যদি বলতাম, যা, বিজয়ী হয়ে ফিরে আয়!’
ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষের বাড়ি থেকে ধরা পড়েন বদিউল আলম। ভীষণ ভালো ছাত্র ছিলেন। ১৯৬৪ সালে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষায় বোর্ডে চতুর্থ স্থান অধিকার করেছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালে পড়তেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে শেষ বর্ষে। এনএসএফ করতেন বলে বন্ধুরা তাঁকে নিতে চাননি আগরতলা যাত্রী দলে। তিনি পকেট থেকে ব্লেড বের করে নিজের আর ছাত্র ইউনিয়ন করা শহীদুল্লাহ খান বাদলের আঙুল কেটে রক্ত মিশিয়ে নেন। বলেন, ‘যা, আজ থেকে আমরা রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ হলাম। ফ্রম টুডে উই আর ব্লাড ব্রাদার্স।’ ভীষণ সাহসী যোদ্ধা ছিলেন বদি।
আলতাফ মাহমুদ ছিলেন সে সময়কার ভীষণ শক্তিশালী সুরকার ও সংগীত পরিচালক। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটির সুরকার। একাত্তর সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধের গান রেকর্ড করে পাঠাতেন ভারতে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। নিজের বাড়িতে অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছিলেন। তাঁর বাড়িতে পাকিস্তানি মিলিটারি হানা দেয় ভোরবেলা, ‘মিউজিক ডিরেক্টর সাব কৌন হ্যায়?’ তাঁকে দিয়ে কোদাল চালিয়ে নেয় তারা, উঠান খুঁড়ে অস্ত্র বের করায়। তাঁর কপালে বেয়নেট চালালে চোখের ওপরের চামড়া খুলে ঝুলে পড়ে চোখের ওপর।
আজাদকে ধরে প্রথমে নেওয়া হয় রমনা থানায়। আজাদের মা ছেলের সঙ্গে দেখা করতে যান থানায়। পাকিস্তানিদের দালালেরা বলে, ‘আপনার ছেলেকে সবকিছু স্বীকার করতে বলেন, ওকে আমরা ছাড়ানোর ব্যবস্থা করছি।’
আজাদের মা ছেলের সঙ্গে দেখা করে বলেন, ‘শক্ত হয়ে থেকো, বাবা। কোনো কিছু স্বীকার করবে না।’ ছেলে বলেন, ‘মা, কদিন ভাত খাই না, ভীষণ ভাত খেতে ইচ্ছা করছে, আমার জন্য ভাত এনো তো।’
মা ভাত রেঁধে টিফিন ক্যারিয়ারের বাটিতে সাজিয়ে নিয়ে থানায় আসেন। এসে দেখেন, ছেলে নেই। এই ছেলে আর কোনো দিনও ফিরে আসেননি। আর এই মা পরবর্তী ১৪টা বছর আর কোনো দিনও ভাত খাননি। তিনি বিছানায়ও শুতেন না। সব সময় মেঝেতে শুতেন। কারণ, তিনি দেখেছিলেন যে তাঁর ছেলে আজাদ রমনা থানায় শোবার জন্য বিছানা পাননি। এই মায়ের কবরটা জুরাইনে এখনো আছে। আমি আর আজাদের খালাতো ভাই ফেরদৌস আহমেদ জায়েদ সেই কবরে গিয়েছিলাম। সেখানে লেখা আছে: ‘মোসাম্মৎ সাফিয়া বেগম, শহীদ আজাদের মা’।