চোখের সামনে কাঞ্চনজঙ্ঘা

অলংকরণ: আপন জোয়ার্দার

হেমন্তের মাঝামাঝি। হিমালয়ঘেঁষা আমাদের উত্তরে শীত তখন আভাস দিচ্ছে মাত্র। তারপরও হিমালয় দেখতে আমরা পাঁচজন বন্ধু পাড়ি জমালাম হিমালয়কন্যা পঞ্চগড়ে; দেশের সর্ব–উত্তরের স্থান তেঁতুলিয়ায়। হিমালয়ের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা তখন উঁকি মারছে সেখানে।

মাত্র দুই ঘণ্টার পরিকল্পনায় কীভাবে যে এত বড় যাত্রা করেছিলাম, সে কথা ভেবে এখন অবাক হই। এসএসসি শেষ, তাই লোভটা দুঃসাহসকে টেক্কা দিতে পেরেছিল। গায়ে টি–শার্ট আর ঘাড়ে স্কুলব্যাগসমেত যখন আমরা দিনাজপুর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরের ‘দশমাইলে’ নামলাম, তখন দুপুর ছুঁই ছুঁই। তারপরও আমরা কুড়িগ্রামের সন্তানেরা দিনাজপুরের চা চেখে দেখতে কার্পণ্য করলাম না। সেই সকাল সাতটায় বেরিয়েছি নাগেশ্বরী থেকে, তাই খিদেটাও বেশ চড়ে ছিল। আমি আর তামিম বিশেষভাবে চেখে দেখলাম দিনাজপুরের সন্দেশ।

এরপর বাস চলল পঞ্চগড়ের উদ্দেশে। কিন্তু মাঝপথে নামিয়ে দিল গাড়ি খারাপ হওয়ার কারণে। পরে আরেকটা ‘গেটলক’ নামক গেটখোলা বাসে পঞ্চগড়ে পৌঁছেছি বিকেল চারটায়।

সেই সকালে খেয়ে বেরিয়েছি, তাই খাবারের দোকান পেয়েই পাঁচটা ক্ষুধার্ত উদর মুহূর্তেই পূর্ণ করে নিলাম। তারপর একটা ভ্যানে করে চললাম হিমালয় পার্কে। বলা বাহুল্য, এদিকটায় রিকশা তেমন নেই, খালি ভ্যান আর ভ্যান। ভ্যানে চড়াও সে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। করতোয়া ব্রিজের ওপর যখন উঠেছি, তখন প্রায় পানিশূন্য করতোয়ায় গোধূলি নামছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত পার্কে ঘুরে এলাম পঞ্চগড় রেলস্টেশনে। আমাদের ‘বন্ধুর বন্ধু’ আসছে ঠাকুরগাঁও থেকে। রাত নয়টায় সে আমাদের নিয়ে চলল তার ফুফুর বাড়িতে। ফুফুর বাসায় যখন ঘুমালাম, তখন রাত দুইটা বাজে। পরদিন সকাল নয়টায় নাশতা করে বের হলাম মির্জাপুর শাহি জামে মসজিদের উদ্দেশে। ফুফু আমাদের যে আদর করেছেন, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। বন্ধুর বন্ধু জাহিদের আমাদের বন্ধু হতে বেশি সময় লাগেনি। মসজিদ দর্শন করে ‘ধাক্কামারা’ থেকে বাসে উঠলাম তেঁতুলিয়ার উদ্দেশে। সমতল ভূমির চা–বাগান দর্শন করতে করতে তেঁতুলিয়ায় পৌঁছালাম আমরা। চললাম ডাকবাংলোর দিকে মাথা গোঁজার জন্য। রীতিমতো পাহাড়ের ওপর সেটা। এক পাশে রয়েছে ছোটখাটো একটা ইকোপার্ক আর পাশ দিয়ে বয়ে চলছে মহানন্দা নদী। নদীর ওপারে ভারত। আর মাইল বিশেক দূরে নেপাল। ডাকবাংলোয় ঢুকে সব ক্লান্তি মুহূর্তেই ভুলে গেলাম। কিন্তু ডাকবাংলোয় জায়গা হলো না। কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে শুধু আমরাই আসিনি, আরও অনেকেই এসেছেন। পরে জায়গা হলো কিছু দূরের একটা বাসায়। যথারীতি গোসল করে বিকেলে বের হলাম।

এক ভ্যানওয়ালার সঙ্গে খাতির হয়েছিল বেশ, তিনি আমাদের পুরো তেঁতুলিয়া ঘুরে দেখালেন। রাতে হোটেলে খেলাম। এরপর চায়ের আড্ডায় এক অভিনব হিসাব মেলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম আমি আর জিদান। চয়ন করতে লাগল ভিডিও। পরে বাসায় ফিরে সকাল ছয়টায় অ্যালার্ম দেওয়া হলো।

সকাল ছয়টায় তড়িঘড়ি করে উঠে বুঝলাম, হিমালয়ের শীত কী জিনিস! মাঘের আগেই মাঘ চলে এসেছে এখানে। ভাগ্যিস ব্যাগভর্তি শীতের কাপড় ছিল! এরপর চললাম এত দূর ভ্রমণের প্রধান উদ্দেশ্য কাঞ্চনজঙ্ঘায়। যখন ধীরে ধীরে কুয়াশা কেটে কাঞ্চনজঙ্ঘার তুষারশুভ্র চূড়ায় প্রভাতের আলো পড়ছিল, তখন মনে হচ্ছিল, এখানে আসা বৃথা যায়নি। সত্যিই সে এক অপূর্ব দৃশ্য! সকালের কুয়াশার বুকে হালকা রোদ যেন ভ্রমণপিপাসু আমাদের মনকে একমুহূর্তে চাঙা করে দিল। মুহূর্তগুলো ক্যামেরাবন্দী করতে ভুললাম না। রাতে যখন মহানন্দার বুকে পা ঝুলিয়ে বসে ছিলাম, তখন কল্পনায় নিজেকে মনে হচ্ছিল বিভূতিভূষণের দুঃসাহসিক শঙ্কর। মনে হচ্ছিল, হাত বাড়ালেই আমি ছুঁতে পাব আকাশকে। পা বাড়ালেই চলে যাব মাত্র ২০ মাইল দূরের নেপালে।

যখন বাসায় ফিরছিলাম, তখন মনে হচ্ছিল, এসবই স্বপ্ন। কিন্তু ব্যাগে তেঁতুলিয়ার চা আর চা–পাতার দিকে তাকাতেই মনে হচ্ছিল, না, এ বাস্তব। তেঁতুলিয়ার মতোই সুন্দর ওখানকার মানুষের মন। পরিবার নিয়ে চাইলে তুমিও ঘুরে আসতে পারো তেঁতুলিয়ায়। হিমালয় তোমাকে হিমুর মতো নিরাশ করবে না।