ভারতের মহাকাশযানের কারণে যে কৌতুকটি বাতিল হলো

দুই বন্ধুর মধ্যে কথা হচ্ছে।

—জানিস, সামনের ১৫ তারিখে নাকি চাঁদে রকেট পাঠানো হবে।

—যাহ, তুই মিথ্যা কথা বলছিস।

—কেন?

—সামনের ১৫ তারিখ তো অমাবস্যা। অন্ধকারে রকেট পাঠাবে কী করে?

তুমি নিশ্চয়ই এ রকম কৌতুক শুনেছ। এই কৌতুকগুলো মানুষের বোকামি তুলে ধরে। একজনের বোকামি দেখে অন্যদের হাসি পায়। রাজনীতিবিদদের বোকামি নিয়ে এর কাছাকাছি আরেকটি কৌতুক আছে। রাশিয়ার একজন বিজ্ঞানী একজন রাষ্ট্রনেতার কাছে গিয়ে বলছেন, ‘ভারত তো চাঁদে রকেট পাঠিয়েছে। আমরাও চাঁদে রকেট পাঠাই।’ নেতার মনে খুব অহংকার। তিনি সব সময় ভারতের চেয়ে নিজ দেশকে এগিয়ে রাখতে চান। দুই দেশের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে। তো তিনি বিজ্ঞানীকে বললেন, ‘ভারত চাঁদে রকেট পাঠিয়েছে? আমরা তাহলে সূর্যে রকেট পাঠাব।’

কৌতুকের বিজ্ঞানী এ সময় অসুবিধার কথা তুলে ধরতেন। বলতেন, চাঁদের কোনো আলো নেই। কোনো তাপ নেই। তাই চাঁদে রকেট পাঠানো যায়। সূর্য তো উত্তপ্ত। সূর্যের কাছে কোনো রকেট পাঠানো যাবে না। কৌতুকে নেতার উত্তর থাকত, ‘তোমাকে দিনের বেলায় রকেট পাঠাতে কে বলেছে? আমরা সূর্যে রকেট পাঠাব রাতে।’

কিছুদিন আগেও আমরা এই কৌতুকে হাসতাম। রকেট পাঠানোর জন্য দেশগুলো চাঁদ বা কোনো গ্রহকে বেছে নিত। আমরা ভাবতাম, সূর্যের দিকে কোনো রকেট পাঠানো যায় না। কারণ, সূর্য খুব উত্তপ্ত। তবে আমাদের ধারণা সঠিক নয়। সূর্যের দিকে রকেট পাঠানো হয় অনেক দিন ধরেই। সম্প্রতি ভারত এই দলে যুক্ত হয়েছে।

সূর্যের চারপাশে ভ্রমণ ও গবেষণার জন্য আদিত্য এল-১ নামের একটি মহাকাশযান পাঠিয়েছে ভারত। ‘পোলার স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকেল’ (পিএসএলভি) নামের ভারতীয় রকেটে চেপে মহাকাশযানটি যাত্রা করেছে সূর্যের দিকে। মহাকাশযানটি গত ২ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সময় বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটা সতীশ ধাওয়ান মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্রের লঞ্চিং প্যাড থেকে উড্ডয়ন করে।

কিছুদিন আগে ভারত চাঁদে নেমেছে। এই সাফল্যের উদ্‌যাপন শেষ হতে না হতেই সূর্যের দিকে যাত্রা করেছে তারা। ভারতের মহাকাশযানটি ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্ট ১-এ যাবে।

ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্ট হলো মহাকাশে নিরাপদ পার্কিং স্পট। বড় কোনো বস্তুকে ঘিরে ছোট কোনো বস্তু যখন ঘুরতে থাকে, তখন বড় বস্তুটির দিকে মহাকর্ষীয় টান অনুভব করে। পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানে কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় এ রকম হয় না। এসব জায়গায় পৃথিবী ও সূর্যের মহাকর্ষ একে অন্যকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। এই জায়গার মহাকর্ষীয় টান একদম ভারসাম্যপূর্ণ থাকে। এগুলোকে বলে ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্ট। পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানে পাঁচটি ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্ট আছে। এগুলোকে যথাক্রমে এল১, এল২, এল৩, এল৪ ও এল৫ ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্ট বলা হয়।

ভারতের মহাকাশযানটির সূর্যে অবতরণ করার কোনো সম্ভাবনাও নেই। চাঁদের মতো সূর্যপৃষ্ঠে অবতরণ করা যায় না। আদিত্য এল-১-এর উদ্দেশ্যও তা নয়।

সূর্যের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা প্রায় ছয় হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস। সূর্যের বায়ুমণ্ডল পৃষ্ঠের কয়েক হাজার কিলোমিটার ওপরে অবস্থিত। এটি করোনা অঞ্চল নামে পরিচিত। মজার ব্যাপার হলো, করোনা অঞ্চলের তাপমাত্রা সূর্যের পৃষ্ঠের চেয়ে কয়েক শ গুণ বেশি। কোথাও কোথাও ১০ লাখ ডিগ্রি সেলসিয়াস। স্বাভাবিকভাবে এমন হওয়ার কথা নয়। ধরো, জ্বলন্ত চুলার কাছে থাকলে আমাদের তাপ লাগে। তুমি চুলা থেকে যত দূরে সরে যাবে, তোমার তত কম গরম লাগবে। কিন্তু সূর্যে দেখা যাচ্ছে বিপরীত চিত্র। সূর্যপৃষ্ঠ থেকে সূর্যের বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বেশি।

পৃষ্ঠ বা বায়ুমণ্ডলের উচ্চ তাপমাত্রার কাছে গিয়ে টিকে থাকার কোনো প্রযুক্তি পৃথিবীতে এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। সূর্যের কাছে যেতে হলে বায়ুমণ্ডল পার হতে হবে। কোনো মহাকাশযানের পক্ষে এত কাছে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই ভারতের মহাকাশযানটি নির্দিষ্ট দূরত্বে থেকে পর্যবেক্ষণ করবে। তথ্য সংগ্রহ করবে সূর্যের বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন স্তর সম্পর্কে। এ ছাড়া সৌরঝড় ও করোনার স্তরও পর্যবেক্ষণ করবে মহাকাশযানটি।

সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যকার একটি কক্ষপথ ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্ট ১। এটি ১৫ লাখ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই পথ পাড়ি দিতে আদিত্য এল-১-এর সময় লাগবে ১২৫ দিন। এরপর তথ্য সংগ্রহ করে পাঠানো শুরু করবে। সে পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। এই কক্ষপথে মহাকাশযান পৌঁছানোর ক্ষেত্রে ভারতই প্রথম নয়, আগে থেকেই বেশ কয়েকটি সোলার অবজারভেটরি রয়েছে এই কক্ষপথে। যেমন পার্কার, উইন্ড, সোহো ইত্যাদি।

এর মধ্যে পার্কারের যাত্রা শুরু হয়েছে ২০১৮ সালের ১২ আগস্ট। পার্কার একটি তদন্তকারী আকাশযান (space probe)। সূর্যের চারপাশে ঘুরতে থাকা পার্কার সূর্যের কাছাকাছি গেলে সতর্কসংকেত বাজে এবং পার্কার সরে আসে। তবে কিছুকাল পরে সূর্যের বাইরের আবরণ করোনা অঞ্চলে ঝাপ দিবে পার্কার। ২০২৫ সালে পার্কারের সূর্যসমাধি হবে।

এখন প্রশ্ন হলো, সূর্যে রকেট পাঠানো নিয়ে কৌতুকটি কী আর ধোপে টিকবে? কৌতুকটি কেউ বললে তো আর হাসা যাবে না। যে বলবে, তাকে শুধরে দেওয়া যেতে পারে। চাঁদে অবতরণের মতো সূর্যের দিকেও রকেট পাঠানো মানুষের প্রযুক্তিগত সাফল্য।