করবেট আর পুতলি

জিম করবেটকে বলা হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঘ শিকারি। আমি মনে করি, পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত যত শিকারি এসেছেন, তাঁদের মধ্যে লেখক হিসেবে তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ। তবে তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয়, মানুষকে তিনি খুব ভালোবাসতেন। এই লেখাতেই আমরা সেই প্রমাণ পাব।

১৯১০ সাল। করবেট গেলেন মুক্তেশ্বরের বাঘিনীটাকে মারতে। পথের মাঝে দেখতে পেলেন, বছর আটেকের একটি মেয়ে তার কালোয়া নামের এক বলদ নিয়ে মহা ঝামেলায় পড়েছে। মেয়েটি বলদটাকে নিয়ে যেতে চায় মুক্তেশ্বর গ্রামে, কিন্তু বলদটা যেতে চায় ঠিক তার উল্টো দিকে। বলদটা নিয়ন্ত্রণে মেয়েটিকে সাহাঘ্য করার পর তার পেছনে পেছনে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলতে লাগলেন করবেট।

‘বলদটা কার?’ জানতে চাইলেন তিনি।

‘বাবার’, জবাব দিল মেয়েটি।

‘আর আমরা সেটাকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছি এখন?’

‘চাচার কাছে।’

‘কালোয়াকে চাচার দরকার কেন?’

‘তার জমি চাষ করার জন্য।’

‘চাচার বাড়িতে কি মাত্র একটা বলদই আছে?’

‘হ্যাঁ’, বলল মেয়েটি; ‘এখন তার মাত্র একটাই বলদ। কিন্তু তার দুটো বলদ ছিল।’

‘অন্যটা কোথায় গেছে?’ জানতে চেয়ে করবেট ভাবলেন, বলদটা সম্ভবত বিক্রি করা হয়েছে কোথাও ঋণ পরিশোধ করতে।

‘বলদটাকে গতকাল বাঘে মেরেছে’, জবাব দিল মেয়েটি। তারপর কয়েকবার পেছনে ফিরে ফিরে করবেটকে দেখার পর সাহস সঞ্চয় করে মেয়েটি জানতে চাইল, ‘তুমি বাঘটাকে মারতে এসেছ?’

‘হ্যাঁ’, বললেন করবেট, ‘মারার চেষ্টা করতে এসেছি।’

‘তাহলে বাঘ যেখানে বলদটাকে মেরেছে, সেখানে না থেকে তুমি চলে যাচ্ছ কেন?’

‘কারণ, আমরা কালোয়াকে চাচার কাছে নিয়ে যাচ্ছি।’ তাঁর জবাবে মেয়েটি খুশি হয়েছে লক্ষ করে করবেট আবার জানতে চাইলেন:

‘তুমি জানো না যে বাঘটা মানুষখেকো?’

‘জানি’, বলল মেয়েটি, ‘ওটা কুন্তির বাবা আর বংশী সিংয়ের মাকে খেয়েছে, আরও অনেক মানুষকে।’

‘তাহলে তোমার বাবা কালোয়ার সঙ্গে তোমাকে পাঠাল কেন? সে নিজে কেন আসেনি?’

‘তার ভবারি বুখার (ম্যালেরিয়া) হয়েছে যে।’

‘তোমার কোনো ভাই নেই?’

‘না। একটা ভাই ছিল, কিন্তু সে অনেক আগেই মারা গেছে।’

‘মা?’

‘হ্যাঁ, মা আছে; সে তো রান্না করছে।’

‘বোন?’

‘না, আমার কোনো বোন নেই।’ সুতরাং, ছোট্ট এই মেয়ের ওপর পড়েছে তার বাবার বলদ চাচার কাছে পৌঁছে দেওয়ার অতি বিপজ্জনক ভার। যে রাস্তা ধরে মেয়েটিকে যাতায়াত করতে হয়, সেই রাস্তায় দলবদ্ধভাবে ছাড়া মানুষ যাতায়াত করে না, আর গত চার ঘণ্টায় করবেট সেখানে একটা মানুষকেও চলাচল করতে দেখেননি।

ছোট একটা বাড়ির সামনে এসে গলা চড়িয়ে মেয়েটি তার চাচাকে বলল যে সে কালোয়াকে নিয়ে এসেছে।

‘আচ্ছা’, বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে এল একটা পুরুষের স্বর, ‘ওটাকে খুঁটিতে বেঁধে বাড়ি যা, পুতলি। আমি খাচ্ছি।’

এবার করবেট বললেন, ‘পুতলি, যে বাঘ তোমার চাচার বলদ খেয়েছে, আমি সেটাকে মারতে চাই, কিন্তু বাঘ কোথায় বলদটাকে মেরেছে, তা তো জানি না। তুমি কি জায়গাটা আমাকে দেখাবে?’

‘হ্যাঁ’, আগ্রহের সঙ্গে বলল মেয়েটি, ‘দেখাব তোমাকে।’

করবেট চললেন সামনে সামনে আর তাঁর পেছনে পুতলি। জায়গাটা দেখার পর পুতলিকে বাড়ি পৌঁছিয়ে দিলেন তিনি।

এখন কথা হলো, কেন একবার পুতলির পেছনে পেছনে আরেকবার পুতলির সামনে সামনে গিয়েছিলেন বিশ্ববিখ্যাত শিকারিটি। পুতলির সঙ্গে যখন মুক্তেশ্বর গ্রামের দিকে আসছিলেন, তখন করবেট ছিলেন পেছনে, আর যখন পুতলি তাঁকে নিয়ে যায় জায়গাটা দেখাতে, তখন তিনি ছিলেন সামনে। কারণ, সেই সময় বাঘিনীটা ওই অঞ্চলে থাকলে মুক্তেশ্বর গ্রামের দিকে তাঁরা আসার পথে সেটার থাকার কথা ছিল পেছনে, আর জায়গাটা দেখতে যাওয়ার সময় সামনে। এবং করবেট এমন করেছিলেন এ জন্য যে, বাঘিনীটা অতর্কিতে আক্রমণ চালালে পুতলির পরিবর্তে তিনি নিজেই যেন হন সেটার শিকার!

এই ঘটনার কয়েক দিন পরই করবেটের গুলিতে মারা পড়ল বাঘিনী।

গল্পের শেষে অসাধারণ ভাষায় জিম করবেট লিখেছেন, মানুষখেকো বাঘ মারায় একটা সন্তুষ্টি আছে। একটা অবশ্যকরণীয় কাজ করতে পারার সন্তুষ্টি। অত্যন্ত যোগ্যতাসম্পন্ন একটা প্রতিদ্বন্দ্বীকে তার নিজস্ব এলাকায় কৌশলের মারপ্যাঁচে পরাজিত করতে পারার সন্তুষ্টি। আর সবচেয়ে বড় সন্তুষ্টি হলো, এই পৃথিবীর অন্তত ছোট একটা অংশ সাহসী একটি ছোট্ট মেয়ের চলাচলের জন্য নিরাপদ করতে পারা।