ডিআরএস, আল্ট্রাএজ কীভাবে কাজ করে

প্রতিনিয়তই নানা প্রযুক্তি যুক্ত হচ্ছে ক্রিকেটে। সাধারণ ক্রিকেট ম্যাচের চেয়েও বেশি আকর্ষণীয় করে তোলে এর প্রযুক্তি। দর্শকদের ক্রিকেট দেখার অভিজ্ঞতা আরও ভালো করতে অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তি ব্যবহার করে সম্প্রচারকারীরা। চলো, সেসব প্রযুক্তিগুলো সম্পর্কে একটু জানা যাক।

ডিআরএসফাইল ছবি

১. ডিআরএস

বিপিএলে ডিআরএসের আবেদন করছেন আল আমিন হোসেন
ছবি: প্রথম আলো

ক্রিকেটে আম্পায়ারের দেওয়া সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সেই সিদ্ধান্ত আবার ভালোভাবে দেখার একটা পদ্ধতি হলো ডিআরএস। এতে বেশ কিছু আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। যেমন—

বল ট্র্যাকিং: একটা বল পিচের কোথায় পড়ছে এবং কোন দিকে যাচ্ছে, তা খুব ভালোভাবে দেখা যায় এই প্রযুক্তির সাহায্যে। এর মাধ্যমে আম্পায়াররা এলবিডব্লিউয়ের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। হাই-ডেফিনেশন ক্যামেরা ব্যবহার করে বলের গতিপথ অনুসরণ করা হয়। ধরো, একটা বল পিচে পড়ে একজন ব্যাটসম্যানের পায়ে লাগল। তখন এই বল ট্র্যাকিং পদ্ধতি ব্যবহার করে দেখা হয়, ব্যাটসম্যানের পা ওখানে না থাকলে বলটা গিয়ে স্ট্যাম্পে লাগত কি না। যদি স্ট্যাম্পে লাগে, তাহলে ব্যাটসম্যান আউট হবেন।

স্নিকোমিটার: ডিআরএস পদ্ধতির আরেকটা প্রযুক্তি হলো স্নিকোমিটার। এর সাহায্যে বোঝা যায়, বল ব্যাটে লেগেছে কি না। যদি ব্যাটের কাছাকাছি আসার সময় কোনো শব্দ হয়, তাহলে স্নিকোমিটার সেটা ধরে ফেলে এবং টিভি রিপ্লেতে দেখা যায়। ফলে আম্পায়াররা ক্যাচ আউটের সিদ্ধান্ত আরও ভালোভাবে নিতে পারেন। এটা ১৯৯৯ সালে প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল।

ফ্রন্ট-ফুট টেকনোলজি: বোলার যখন বল করে, তখন তার পায়ের অবস্থান দেখা হয় এই প্রযুক্তির সাহায্যে। একটা নির্দিষ্ট দাগের মধ্যে থেকে বোলারকে বল করতে হয়। বোলারের পা যদি পুরোপুরি দাগের বাইরে চলে যায়, তা হলে নো-বল ডাকা যায়। নো-বলে কোনো ব্যাটসম্যান আউট হলে সেটা আউট বলে ধরা হয় না।

স্মার্ট বেল: এগুলো স্টাম্পের ওপরে লাগানো ছোট ছোট লাইটযুক্ত বেল। যখন বল স্টাম্পে লাগে, তখন এই বেইলগুলো জ্বলে ওঠে। এর ফলে রান-আউটের সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হয়।

এইসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে আম্পায়াররা আরও নির্ভুলভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কোনো ভুল হলে দল রিভিউ নিয়ে সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার সুযোগ পায়।

২. আলট্রা-এজ প্রযুক্তি

স্নিকোমিটারের মতো এই প্রযুক্তির সাহায্যেও দেখা হয়, ব্যাটে বল স্পর্শ করেছে কি না। অনেক সময় ক্যাচ নিয়ে সন্দেহ থাকে যে বলটা আসলেই ব্যাট ছুঁয়েছিল কিনা। তখন এই আলট্রা-এজ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এতে বিশেষ মাইক্রোফোন ব্যবহার করা হয়, যা ব্যাটের কাছাকাছি কোনো হালকা শব্দও ধরতে পারে। এই প্রযুক্তি ব্যবহারের সময় টিভির পর্দায় গ্রাফের মতো একটা লাইন দেখা যায়। যদি বল ব্যাটে লাগে, তাহলে সেই লাইনে অনেক স্পাইক দেখা যায়। স্নিকোমিটারের সঙ্গে একটু পার্থক্য রয়েছে। স্নিকোমিটারে শুধু সাউন্ড অ্যানালাইসিস করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, কিন্তু আল্ট্রা-এজে হাই সেন্সিটিভ মাইক্রোফোন ও ভিডিওর সাহায্যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সহজ ভাষায় বললে, স্নিকোমিটারের আধুনিক রূপ হলো আল্ট্রা-এজ। এখন এই আল্ট্রা-এজ প্রযুক্তিই ব্যবহৃত হয়।

৩. স্পাইডার ক্যামেরা

স্পাইডার ক্যামেরাগুলো তারের সাহায্যে মাঠের ওপরে ঝোলানো থাকে। এটা ওপর থেকে ড্রোনের মতো খুব পরিষ্কার ছবি তুলতে পারে। এই ক্যামেরার বিশেষত্ব হলো, এটা মাঠের বিভিন্ন দিক থেকে ছবি নিতে পারে। ফলে যারা টিভির পর্দায় খেলা দেখো, তারা একদম কাছ থেকে প্রতিটি খেলোয়াড়কে আলাদাভাবে দেখতে পারো। এতে মনে হয়, তুমি মাঠের ভেতরে দাঁড়িয়েই খেলা দেখছ!

৪. স্পিড গান

ফার্স্ট বোলাররা কত জোরে একটা বল ছুড়ে মারছে, তা দেখতে নিশ্চয়ই ভালো লাগে। বলের গতি ঘণ্টায় ১৫০ ছাড়িয়ে গেলে বলটা অনেকেই চোখ বড় বড় করে দেখি। ধারাভাষ্যকারদের কণ্ঠেও শোনা যায় বোলারের প্রশংসা। কিন্তু বলের গতি যে ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটার হলো, তা কীভাবে বোঝা যায়? এই গতি মাপার জন্যই ব্যবহার করা স্পিড গান। পাকিস্তানের সাবেক পেসার শোয়েব আখতার ২০০৩ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ১৬১.৩ কিলোমিটার ঘণ্টায় একটা বল করেছিলেন। সেটি এখন পর্যন্ত একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ইতিহাসে অন্যতম দ্রুততম বল।

৫. পিচ ভিশন

একজন বোলার কেমন বল করছেন, তা বোঝা যায় পিচ ভিশন নামে এই নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে। এই প্রযুক্তির সাহায্যে প্রত্যেকটা বলের লম্বালম্বি দূরত্ব এবং বলটার বাউন্স (কতটা লাফিয়ে উঠছে) ট্র্যাক করা যায়। ফলে বোলাররা যখন অনুশীলন করেন, তখন তাঁরা কোথায় বল ফেললে বেশি সুবিধা পাবে এবং তাদের কৌশল কেমন হওয়া উচিত, তা বুঝতে পারেন। শুধু অনুশীলন নয়, খেলার সময়ও একজন বোলারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য এই প্রযুক্তি খুব দরকারি। সহজভাবে বললে, পিচ ভিশন বোলারদের বোলিং আরও নিখুঁত করতে এবং ভালো পরিকল্পনা করতে সাহায্য করে।

৬. বাগি ক্যামেরা

মাঠের বাউন্ডারির পাশ দিয়ে একটা নিশ্চয়ই ছুটে যেতে দেখেছ। চার হলে এই ক্যামেরা বেশি দেখা যায়। এটা খুব উন্নতমানের ক্যামেরা। অ্যাথলেটিক্সের জগতে এই ক্যামেরা বেশি ব্যবহৃত হয়। তবে এখন ক্রিকেটেও অহরহ এর দেখা মিলছে। একটা চাকার সাহায্যে মাঠের চারপাশ দিয়ে এই ক্যামেরা ছুটে চলে। সহজভাবে বললে, বাগি ক্যামেরা একটা ছোট গাড়ির মতো ক্যামেরা, যা মাঠের খেলোয়াড়দের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে খেলা দেখায়।

৭. ৩৬০° ক্যামেরা

তোমরা কি কখনো একটা শট বিভিন্ন দিক থেকে দেখেছ? ৩৬০° ক্যামেরার সাহায্যে মাঠের সব দিকের ছবি একসঙ্গে নেওয়া যায়। ২০২১ সালে প্রথম এই ক্যামেরা ব্যবহৃত হয়। ধরো, বিরাট কোহলি দারুণ একটা কভার ড্রাইভ মারল। এই ক্যামেরাগুলোর সাহায্যে তোমরা সেই অসাধারণ মুহূর্তগুলো সব দিক থেকে দেখতে পারবে। স্টেডিয়ামের চারপাশে ১০০টিরও বেশি ক্যামেরা লাগানো থাকে। ফলে একটা বিশেষ মুহূর্তের ছবি বা ভিডিও ওপর-নিচ, ডান-বাম সব দিক থেকে দেখতে পারবে।

৮. এলইডি স্ট্যাম্প ও বেল

ক্রিকেটে এখন এলইডি স্ট্যাম্প ও বেল ব্যবহার করা হয়। মানে বল স্ট্যাম্পে লাগলেই বেল পড়ে যাবে এবং সঙ্গে সঙ্গে স্ট্যাম্প ও বেলের লাইটগুলো জ্বলে উঠবে। উইকেটের ক্ষেত্রে স্ট্যাম্প থেকে বেল না পড়লে আউট হিসেবে ধরা হয় না। তাই এই প্রযুক্তি উইকেটের চেয়ে রান আউট বা স্টাম্পিংয়ে বেশি প্রযোজ্য। রান আউটের ক্ষেত্রে আগে অনেক সময় বোঝা যেত না যে বেল কখন পড়েছে। কিন্তু এই এলইডি লাইটের কারণে এখন টিভি রিপ্লেতে খুব পরিষ্কারভাবে দেখা যায় যে কখন বেল স্ট্যাম্প থেকে আলাদা হয়েছে।

শেষ কথা হলো, প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ক্রিকেট খেলাও বদলে যাচ্ছে। ডিআরএস, স্পাইডার ক্যামেরা, ৩৬০° ক্যামেরার মতো প্রযুক্তিগুলোর কারণে ক্রিকেট আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। প্রযুক্তির সাহায্যে ক্রিকেট প্রবেশ করেছে একটা নতুন যুগে।

আরও পড়ুন