দি হেয়ার সঙ্গে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হেঁয়ালি

ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ডাগআউটে মোট ২৭ বছর কাটিয়েছেন স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন। এই ২৭ বছরের ইউনাইটেড ক্যারিয়ারে কয়দিন তাঁকে মাঠে দেখা যায়নি জানো? মাত্র তিন দিন। কোন তিন দিন? প্রথম দিন ছিল তাঁর ভাইয়ে‍র স্ত্রীর অন্তেষ্টিক্রিয়া, দ্বিতীয় দিন ছিল তাঁর ছেলের বিয়ে। আর তৃতীয় দিন? সেদিন তিনি গিয়েছিলেন স্পেনের এক তরুণ গোলরক্ষকের খেলা দেখতে। অদ্ভুত শোনাচ্ছে, তাই না? একটা তরুণ গোলরক্ষকের জন্য এত ঝক্কিঝামেলা কেন পোহাতে যাবেন তাঁর মতো কিংবদন্তি একজন কোচ? কারণ, পাকা জহুরি কখনো নিজের চোখে না দেখে হিরে কেনেন না।

২০১১ সাল। অর্ধযুগ ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের গোলবার সামলানোর পর অবশেষে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন এডউইন ভ্যান ডার স্যার। ৪২ বছর বয়সী গোলরক্ষককে হারিয়ে ফেলার চিন্তায় ঘুম হারাম ইউনাইটেড সমর্থকদের। স্যার অ্যালেক্স আশ্বাস দিলেন, চিন্তার কিছু নেই, আমি একজনকে দেখে রেখেছি। সেই একজন হলেন অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের ২০ বছর বয়সী গোলরক্ষক দাভিদ দি হেয়া। জহুরির চোখে আটকে যাওয়া সেরা হিরে।

ইউনাইটেডে মানিয়ে নিতে বেশ বেগ পোহাতে হয়েছিল দি হেয়াকে। প্রথম প্রথম হাস্যকর সব ভুল করতেন, সোজা বল আটকাতে গিয়ে সবটা গুলিয়ে ফেলতেন। দর্শকদের দুয়ো পর্যন্ত শুনতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু স্যার অ্যালেক্স সঙ্গে ছিলেন। ছিলেন বলেই এক মৌসুমের মধ্যে নিজেকে সামলে নিলেন দি হেয়া, শুরু করলেন নিজের জাত চেনানো। স্যার অ্যালেক্সের শেষ প্রিমিয়ার লিগ জয়ের সবচেয়ে বড় অংশীদার হয়ে রইলেন তিনি। পথটা তৈরি করে দিয়েছিলেন স্যার অ্যালেক্সই, বাকিটা গড়েছেন দি হেয়া। কে জানত, সে পথ এক যুগ ধরে চলবে?

দি হেয়ার ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড–যাত্রা শেষ হয়ে যেতে পারত ২০১৫ সালেই। ইকার ক্যাসিয়াসের বিদায়ের পর রিয়াল মাদ্রিদের নজরে পড়েছিলেন স্প্যানিশ নাম্বার ওয়ান। সেটাই স্বাভাবিক। স্পেনের সেরা গোলরক্ষকের আঁতুড়ঘর বরাবরই রিয়াল মাদ্রিদ। কথা ছিল রিয়াল মাদ্রিদ কিনবে দি হেয়াকে আর তাঁর বদলে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে যোগ দেবেন কেইলর নাভাস। সঙ্গে বাড়তি সাত মিলিয়ন পাউন্ড অতিরিক্ত দেবে রিয়াল মাদ্রিদ।

দুই দল সম্মত, দুই খেলোয়াড়ও নিমরাজি। সবকিছু এতটাই নিশ্চিত ছিল যে নাভাস মাদ্রিদ থেকে ম্যানচেস্টারের টিকিট কেটে বিমানবন্দর পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন। অশ্রুভেজা চোখে নাভাস যখন অপেক্ষা করছেন ফ্লাইটের, তখনই ফোন এল তাঁর কাছে। জানানো হলো, এই দলবদল হচ্ছে না। শেষ মুহূর্তের হাস্যকর এক ফ্যাক্স মেশিন–কাণ্ডে বন্ধ হয়ে গিয়েছে দলবদল।

দলবদলের মৌসুমের শেষ হতে মাত্র ঘণ্টাখানেক বাকি। লা লিগার নিয়ম অনুযায়ী দলবদলের সব কাগজপত্র ফ্যাক্স বাবদ তাদের কাছে পাঠাতে হবে। রিয়াল মাদ্রিদের সব কাজ সম্পন্ন, অপেক্ষা শুধু ইউনাইটেড প্রান্তের কাগজপত্রের। শেষ মুহূর্তে সেই কাগজ পাঠাতে গিয়েই গোল বাধে রেড ডেভিলদের। নষ্ট হয়ে যায় তাদের ক্লাবের ফ্যাক্স মেশিন। যতক্ষণে ঠিকঠাক করে পাঠানো হলো, ততক্ষণে স্পেনের দলবদলের মৌসুম শেষ। সম্পন্ন হওয়া একটা চুক্তি ভেসে গেল জলে।

ভেস্তে যাওয়া দলবদল নিয়ে আবারও গুঞ্জন উঠেছিল বটে। কিন্তু নিজ নিজ দলের হয়ে দুই গোলরক্ষকেরই অসাধারণ পারফরম্যান্স জল ঢেলে দেয় সে গুঞ্জনে। নিজেদের গোলরক্ষকদের নিয়ে বেশ খুশিই ছিল দুই দল। তাই জল আর গড়ায়নি বেশি দূর। বরং ভালো গোলকিপিংয়ের সুবাদে ইউনাইটেড থেকে নতুন চুক্তির প্রস্তাব পান দি হেয়া। তাই মনস্থির করেন, রেড ডেভিলদের সঙ্গেই থাকবেন।

ডেভিড ডি গিয়া

২০১২ থেকে ২০১৮—ছয় মৌসুম দি হেয়া ছিলেন ইউনাইটেডের রক্ষাকবচ। স্যার অ্যালেক্স চলে যাওয়ার পর বিশাল এক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায় রেড ডেভিলরা। আক্রমণ থেকে রক্ষণ—সবটা ঢেলে সাজাতে হয় তাদের। ঢেলে সাজানোর পুরো প্রক্রিয়ায় ইউনাইটেডকে একা রক্ষা করেছেন দি হেয়া। ম্যাচপ্রতি ১০–১২টা সেভ ছিল নিত্যনৈমিত্যিক ব্যাপার। কিন্তু তাঁর অবদানের মূল্য দিতে পারেননি আক্রমণভাগের কোনো খেলোয়াড়।

দি হেয়ার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্ট ২০১৮ সাল। নির্দিষ্ট করে বললে ২০১৮ বিশ্বকাপ। প্রথমবারের মতো মূল গোলরক্ষক হিসেবে বড় টুর্নামেন্ট খেলার সুযোগ। দি হেয়ার ফর্ম যেভাবে কথা বলছিল, তাতে অনেকে ধরেই নিয়েছিলেন, স্বপ্নের মতো একটা বিশ্বকাপ কাটাবেন তিনি। কিন্তু বিশ্বকাপের আগেই নড়বড়ে হয়ে গেল স্প্যানিশ ড্রেসিংরুম, পদত্যাগ করলেন কোচ হুলেন লোপেতেগি। যার প্রভাব পড়ল পুরো দলের ওপর। প্রথম ম্যাচেই রোনালদোর বিপক্ষে তিন গোল হজম করলেন দি হেয়া। তুঙ্গে থাকা আত্মবিশ্বাসকে নিয়ে গেলেন তলানিতে। অতঃপর? ভুলে যাওয়ার মতো একটি বিশ্বকাপ। সব সমস্যার সূচনা যেন এখান থেকেই।

বিশ্বকাপ দিয়ে হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে অনেকটা সময় বয়ে যায়। গোলরক্ষক হিসেবে দি হেয়ার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার যে রিফ্লেক্স, সেটাই রাতারাতি হারিয়ে বসেন তিনি। ফলশ্রুতিতে ছয় মাসের মধ্যে দলে তাঁর অবস্থান নিয়ে উঠতে থাকে প্রশ্ন। কিন্তু কোচ ওলে গুনার শুলসার বরাবরই ছিলেন তাঁর ভক্ত। তাই তো বাজে পারফরম্যান্সের পরও দি হেয়ার ওপর থেকে বিন্দুমাত্র ভরসা হারাননি তিনি। বরং নতুন চুক্তিতে ইউনাইটেডের সবচেয়ে বেতনধারী খেলোয়াড়ে পরিণত হন দি হেয়া। কিন্তু তাঁর ক্যারিয়ার যেন আটকে যায় সেখানেই। দি হেয়া সেই আত্মবিশ্বাসই আর খুঁজে পাননি কখনো।

করোনাকালীন বিরতি গোলবারের নিচে দি হেয়ার স্কিল ফেরাতে সাহায্য করলেও তত দিনে অনেক পিছিয়ে পড়েছিলেন তিনি। আধুনিক ফুটবলের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছিলেন না একটুও। গত কয়েক বছরে ফুটবলে গোলরক্ষকদের কাজে বিশাল এক পরিবর্তন এসেছে। একটা সময় ছিল যখন গোলরক্ষক মানেই শুধু গোলবারের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা আর বল সেভ করা। কিন্তু সময় বদলেছে। এখন গোলরক্ষকদের শুধু গোলবারের নিচে দাঁড়িয়ে থাকলেই চলে না, বরং সময়ে–অসময়ে এগিয়ে এসে দলের বিল্ডআপে সাহায্য করতে হয়। পজেশনাল ফুটবলের যুগে গোলরক্ষককেই ধরা হয় আক্রমণের সূচনা হিসেবে। এই জায়গাতেই বেশ পিছিয়ে দি হেয়া। বল পায়ে তাঁর দক্ষতা শূন্যের কোঠায়। পায়ে বল এলেই যেন আতঙ্কে থাকেন তিনি, ব্যস্ত হয়ে পড়েন আশেপাশের কারও পায়ে দিতে। যে কারণে তাঁর সামনে সব সময় ডিফেন্ডারদের আনাগোনা থাকা লাগে। ওলে গুনার মানিয়ে নিলেও টেন হাগ আর মানতে রাজি নন। তাই তো নতুন চুক্তি দিতে বড্ড আপত্তি ছিল তাঁর। আর সেখান থেকেই সমস্যার শুরু।

টেন হাগ কোনোভাবেই তাঁর ধরনের সঙ্গে যায় না, এমন গোলরক্ষককে দলে রাখতে রাজি নন। অন্যদিকে টেন হাগের মনমতো হাতের কাছে ভালো গোলরক্ষকও নেই। সব দিক ভেবে দি হেয়াকে চুক্তি বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় ইউনাইটেড বোর্ড। যাতে তাঁর বেতন কমে হয়ে গিয়েছিল অর্ধেক, মৌখিকভাবে বলাও হয়েছিল, সামনে খেলার সুযোগও কমে যাবে। ৩২ বছর বয়সী দি হেয়ার হাতে তখন সৌদি আরবের প্রস্তাবও রয়েছে। কিন্তু দলের কথা ভেবে সে চুক্তিতে সম্মত হন তিনি। কাগজপত্র তৈরি করতে বলেন দলকে। সেটাও জুন মাসের শুরুর দিকে কথা।

এর মধ্যেই গুঞ্জন রটে, চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল খেলা গোলরক্ষক আন্দ্রে ওনানাকে ছেড়ে দিচ্ছে ইন্টার। তাঁকে দলে ভেরাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন টেন হাগ। দলকে বলেন, দি হেয়ার সঙ্গে চুক্তি না বাড়াতে। কোচের কথা মেনে দলও দি হেয়াকে জানিয়ে দেয়, নতুন কোনো চুক্তি হচ্ছে না। খবর শুনে আকাশ থেকে পড়েন দি হেয়া। পুরোনো চুক্তির মাত্র চার দিন বাকি, এর আগে হুট করে জানানো হলো নতুন চুক্তি হচ্ছে না। এটা কী রকম কথা? সেখানেই থেমে থাকেনি ইউনাইটেড বোর্ড। দি হেয়াকে তারা অনুরোধও করেছে, নতুন কারও সঙ্গে আগ বাড়িয়ে চুক্তি না করতে। কারণ, ওনানাকে কিনতে ব্যর্থ হলে তাঁকেই দলে চায় তারা।

যে খেলোয়াড় ১২ বছর ধরে আগলে রেখেছেন রেড ডেভিলদের গোলপোস্ট, দলের দুঃসময়ে রক্ষাকবচ হয়েছেন শতবার। স্যার অ্যালেক্সের নিজ হাতে তুলে আনা প্রস্ফুটিত ফুল, তাকেই কি না অর্ধচন্দ্র দেওয়া হলো ক্লাব থেকে? অর্ধচন্দ্র দেওয়ার পর অনুরোধও করা হয়েছে। আমাদের প্রয়োজন পড়লে এসো, কিন্তু কাজ শেষ হলে তোমায় আবারও অর্ধচন্দ্র দেব। ৫৪৫ ম্যাচ, ১৯০ ক্লিন শিট, ৮ শিরোপার পরও তাঁর বিদায়টা হলো একটা ইনস্টাগ্রাম পোস্ট দিয়ে। কোচের মন রক্ষা করতে গিয়ে এক যুগ ধরে দলকে দিয়ে আসা খেলোয়াড়ের কথাই যেন বেমালুম ভুলে গেল ইউনাইটেড বোর্ড। দি হেয়া সরাসরি কিছু বলেননি, তবে চাপা ক্ষোভটা প্রকাশ পেয়েছে তাঁর সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে। বিয়ে করে ছুটির সময়টা নিজের মতো করে কাটাচ্ছেন তিনি। অজানা ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনা নয়, বরং জীবনটা নতুন করে গোছানোর ইচ্ছে এখন তাঁর মনে।

দাভিদ দি হেয়ার বিদায়ের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ইতি টানা হলো স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন–যুগের। সরাসরি স্যার অ্যালেক্সের অধীনে খেলেছেন এমন কেউই আর রইলেন না ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে। ২০১২-১৩ মৌসুমে শেষবারের মতো প্রিমিয়ার লিগ শিরোপার দেখা পেয়েছিল রেড ডেভিলরা, দি হেয়ার বিদায়ের মধ্য দিয়ে ইতি টানা হলো সেই স্বপ্নযাত্রার। টেন হাগ তাঁর নতুন সেনানীদের নিয়ে কী করবেন, তার উত্তর সময়ের কাছে। কিন্তু দাভিদ দি হেয়ার সঙ্গে যা হলো, তাতে আর কেউ ইউনাইটেডের প্রতি নিজের আনুগত্য বজায় রাখবেন কি না, সে প্রশ্ন থাকবেই।