আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল না থাকলেও কি বিশ্বকাপ ‘জমবে’?

অনেকেই বলে থাকেন, আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিল না থাকলে বিশ্বকাপ জমবে না। প্রকৃতপক্ষে বিশ্বকাপ কখনো আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল বা ফেবারিট টিম জমিয়ে তোলে না, বিশ্বকাপ জমিয়ে তোলে দ্বিতীয় সারির দল বা তথাকথিত ছোট দলগুলো! এবারের বিশ্বকাপটা কিন্তু শুরুতেই জমিয়ে তুলল সৌদি আরব। তাদের গ্রুপে শেষ পর্যন্ত বড় অঘটন না ঘটলেও এখন বিশ্বকাপটা জমে উঠেছে জাপান-মরক্কোর মতো দলের জন্য। গত রাতে দক্ষিণ কোরিয়া-ক্যামেরুনের চমক তাতে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে। ক্যামেরুন ছাড়া বাকি তিন দল এখন রাউন্ড অব সিক্সটিনে। সেখানে এই তিন দলের পাশাপাশি সেনেগাল বা অস্ট্রেলিয়াও জ্বলে উঠলে এবারের বিশ্বকাপ আরও জমবে, আরও উপভোগ্য হবে বলেই আমার মনে হয়।

গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন বা রানারআপ কে হবে, সেটা আমরা বিশ্বকাপ শুরুর আগেই মোটামুটি জানি। আমাদের সেই জানাই যদি শেষ পর্যন্ত ঠিক হতো, তাহলে বিশ্বকাপে কোনো উত্তেজনা আসত না। উত্তেজনাটা তখনই আসে, যখন সারা পৃথিবীর সেই আগে থেকে ঠিক করে রাখা বা জানা বিষয়টায় পরিবর্তন আসে। যখন তৃতীয় কোনো দল এসে তোমার-আমার বা সবার ধারণাকে ওলটপালট করে দেয়। গতবার দিয়েছিল ক্রোয়েশিয়া, অথচ এবার তাদের এখন পর্যন্ত সেই ফর্মে দেখা যাচ্ছে না। আবার সেই ফর্মে যে তারা ফিরবে না, এটাও বলা যাচ্ছে না। আর্জেন্টিনা বা স্পেন এবার চ্যাম্পিয়ন হবে বলা হচ্ছিল, অথচ এক ম্যাচের পরাজয়েই তাদের গ্রুপ থেকে ছিটকে পড়ার উপক্রম হলো। শেষ পর্যন্ত আবার তারা ছিটকে পড়লও না। এই অনিশ্চয়তাগুলোর জন্ম দেয় ছোট দলের জয় আর বিশ্বকাপটা হয়ে ওঠে সুন্দর।

এটা ঠিক যে তোমার প্রিয় দল যতক্ষণ থাকবে, ততক্ষণ তুমি উত্তেজনার সঙ্গে বুকভরা আশা নিয়েও খেলা দেখবে, ফলে তোমার আনন্দ বা কষ্টটা দ্বিগুণ হবে। কিন্তু তার জন্য চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দলের টিকে থাকাটা জরুরি না। ব্যঙ্গ করার জন্য, প্রতিদ্বন্দ্বীর হারে আত্মশ্লাঘা বা পৈশাচিক আনন্দ পাওয়ার জন্য, ‘ইগো’ বা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য তোমার হয়তো সাময়িকভাবে একটা চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দল দরকার, কিন্তু সত্যি বলতে এ বিষয়গুলোর সবই শেষ পর্যন্ত বাড়াবাড়ি-মারামারি-হানাহানি কিংবা বিদ্বেষে পরিণত হতে পারে। অন্য দলের পরাজিত হওয়াটা তাই তোমার মূল আনন্দে পরিণত না হওয়াই ভালো। নিজের প্রিয় দল জয় পেলে এমনিতেই তোমার আনন্দ হবে, সেই আনন্দটাই প্রকৃত আনন্দ হওয়া দরকার। ফলে ব্রাজিল সমর্থকদের ভাবার কোনো কারণ নেই যে আর্জেন্টিনা না থাকলে তাদের মজা কমবে। আর্জেন্টিনা সমর্থকদেরও আনন্দ কমবে না ব্রাজিলের বিদায়ে।

আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে ‘উত্তেজনা’ তুঙ্গে থাকে সবসময়ই

বাংলাদেশের করপোরেট প্রতিষ্ঠান আর মিডিয়া হাউসগুলো সব সময়ই আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলকে কেন্দ্র করে ‘উত্তেজনা’ তুঙ্গে রাখতে চায়। তার কারণ, এ দেশে এই দুই দলের সমর্থক সবচেয়ে বেশি। এই দুই দল যতক্ষণ আছে, ব্যবসায়িকভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোও ততক্ষণ লাভবান হয়। এদের বিদায় মানেই মৌসুমি ব্যবসায় ভাটা পড়ে যাওয়া। এ অবস্থা শুধু বাংলাদেশেই নয়। ল্যাটিন ফুটবলের সমর্থক আছে বিশ্বজুড়েই। ফলে ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফাও চায় এই দুই দল খেলুক শেষ পর্যন্ত। খেলা এখন শুধুই বিনোদনের জন্য নয়, এর সঙ্গে সারা বিশ্বেই বড় রকমের ব্যবসা জড়িত। ব্যবসা বিষয়টাও যেহেতু দোষের কিছু নয়, ফলে এই দুই দল নিয়ে মিডিয়া ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানের চাওয়াটাকেও নেতিবাচকভাবে দেখার দরকার নেই। যতক্ষণ না ব্যবসা খেলার স্পিরিট নষ্ট করছে, কাউকে অনৈতিক সুবিধা দিচ্ছে বা বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে, ততক্ষণ ব্যবসা চলতেই পারে! সেটা অন্য আলাপ, মূল কথা হলো, এই ব্যবসায়িক কারণেই একটি ধারণা তৈরি করে দেওয়া হয়েছে যে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল বা তাদের মতো বড় দল ছাড়া বিশ্বকাপ জমে ওঠে না।

আমি তো মনে করি, আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল বিদায় নিলেই বরং বাংলাদেশে খেলাটা বেশি শান্তিপূর্ণভাবে উপভোগ করা যায়! গত বিশ্বকাপের কথাই ধরো। আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল যতক্ষণ ছিল, ততক্ষণ দৃষ্টিটা খেলাতে যতখানি ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল দুই দলের সমর্থকদের দ্বন্দ্বেই। কিন্তু এই দুই দল বিদায় নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এদের সমর্থকেরা ভাই ভাই হয়ে গেলেন এবং বিশ্বকাপের পরের ম্যাচগুলো আরও ‘এক্সাইটমেন্ট’ নিয়ে দেখা শুরু করলেন! এত দিনের বিদ্বেষ আর খোঁচাখুঁচির বদলে ‘ক্রোয়েশিয়া কী করবে’, ‘তারুণ্যে ভরা ফ্রান্স কি পারবে শেষ পর্যন্ত কাপ নিতে’—এমন সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজাতেই মন দিয়েছিলেন সবাই। অন্যকে ‘পচানো’র কাজ না থাকায় ম্যাচ চলার সময়ও নজরটা সবাই খেলাতেই বেশি দিতে পেরেছিলেন।

এর মানে এই নয় যে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল বা বড় দলগুলোকে বাদ পড়তে হবে। বড় দলগুলোর খেলা দেখার মধ্যে তো আলাদা একটা মজা আছেই। শক্তিশালী দল যারা কেউ কারোর চেয়ে কম নয়, তাদের জমজমাট ম্যাচ তো বিশ্বকাপে লাগবেই। আর ছোট দল যতই অঘটন ঘটাক, বড় দলগুলোর ম্যাচের যে আকর্ষণ, তা থাকবে সব সময়ই। কিন্তু এই দলগুলোর মধ্যে কেউ কেউ বিদায় নিলেও বিশ্বকাপ বিশ্বকাপের মতোই থাকবে। প্রিয় দল না থাকলে কেউ কেউ হয়তো অতটা মনোযোগ দিয়ে আর খেলা না–ও দেখতে পারে। সেটা তার একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। প্রকৃত ফুটবলপ্রেমীরা কিন্তু প্রিয় দলের বিদায়ের পরও নজর রাখে বাকি ম্যাচগুলোতেও।

যাহোক, এবারের বিশ্বকাপের নকআউট পর্ব শুরু আজ। গ্রুপ পর্বেই যে চমক দেখা গেছে, সেই চমক যদি নকআউটেও চলতে থাকে, তাহলে বিশ্বকাপের কোনো ক্ষতি হবে না, বরং বিশ্বকাপ হবে আরও জমজমাট। ক্ষতি যা হওয়ার ফিফার হবে, মিডিয়ার হবে। ব্যবসায়িক সেই ক্ষতির কথা ব্যবসায়ীরাই ভাবুক, দর্শক হিসেবে আমরা ভাবব ইতিবাচক আনন্দের কথা।

সেই আনন্দের জন্য চমক চলুক শেষ ম্যাচ পর্যন্ত।