কেন ফুটবল থেকে নিষিদ্ধ হয়েছিল লিভারপুল

স্কটিশ ফুটবল কোচ বিল শ্যাঙ্কলিকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ফুটবল মানে কী? খুব সোজাসাপটা জবাব দিয়েছিলেন তিনি। ‘অনেকের কাছেই ফুটবল বাঁচা-মরার এক লড়াই। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, এটা তার থেকেও বেশি কিছু।’ সমর্থকদের কাছে ফুটবল জীবন-মরণের থেকেও বড় কিছু। কিন্তু বিল শ্যাঙ্কলির রূপক অর্থে বলা কথাটা যখন আক্ষরিক অর্থেই সত্যে পরিণত হয়, তখন ফুটবল মাঠ পরিণত হয় রণক্ষেত্রে।

আশির দশক ছিল ইংলিশ ফুটবলের জন্য এক বিভীষিকাময় দশক। ষাটের দশকে বিশ্বকাপ জেতার পর ফুটবলের পালে যে হাওয়া লেগেছিল, তার ওপর ভিত্তি করেই সত্তর আর আশির দশকে গড়ে উঠেছিল ইউরোপিয়ান ফুটবলের আধিপত্য। কিন্তু পাঁচ বছরের মধ্যেই পরপর দুটি ঘটনা শুধু ইংলিশ ফুটবল নয়, থমকে দিয়েছিল পুরো বিশ্ব ফুটবলকে। ফুটবল এতটাই ঘৃণা করা শুরু করেছিল ইংলিশরা যে পত্রিকার প্রথম পাতায় লেখা লেখা হয়েছে, ‘ফুটবল বস্তির খেলা, এটা বস্তিবাসীরাই খেলে।’

১৯৮৫ সাল। ইউরোপজুড়ে তখন ইতালি আর ইংল্যান্ডের জয়জয়কার। ইউরোপিয়ান ফুটবল তখনো অবশ্য এত জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। চারদিকে লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন; হাত বাড়ালেই টাকার ঝনঝনানি, কোনোটাই তখনো প্রবেশ করেনি ফুটবলে। বরং সমর্থক থেকে শুরু করে খেলোয়াড়, সবার কাছে ফুটবল ছিল প্যাশনের আরেক রূপ। বর্তমানের চ্যাম্পিয়নস লিগ তখন পরিচিত ছিল ইউরোপিয়ান কাপ নামে। সেই ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনালের মুখোমুখি হয়েছিল লিভারপুল আর জুভেন্টাস। ঘুণাক্ষরেও কেউ ভাবেনি ইউরোপিয়ান দুই পরাশক্তির লড়াইয়ে হেইসেল স্টেডিয়াম পরিণত হবে সত্যিকারের রণক্ষেত্রে।

সেবারের ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনালের জন্য ভেন্যু হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল ব্রাসেলসের হেইসেল স্টেডিয়াম। অথচ মাঠের দিকে তাকিয়ে বোঝার উপায় ছিল না, এই মাঠ বেলজিয়ামের জাতীয় স্টেডিয়াম। ভঙ্গুর গ্যালারি, বাইরের দেয়ালে ফাটল; ৫৫ বছরের ইতিহাসে একবারও যে মাঠ সংস্কারে হাত দেওয়া হয়নি, তা যে কেউ এক দেখায় বলে দিতে পারে। বাইরের ফাটল এতটাই বিশাল ছিল যে সেখান দিয়ে অনায়াসে কোনো মানুষ ঢুকে খেলা দেখতে পারবে। এত এত অভিযোগ সত্ত্বেও ইউয়েফা ’৮৫ ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনালের ভেন্যু হিসেবে নির্বাচন করে হেইসেলকেই।

ফাইনালের আগে মাঠের অবস্থা দেখে হতভম্ব হয়ে যান দুই দলের হর্তাকর্তারা। গত ইউরোপিয়ান কাপের হাইভোল্টেজ সেমি-ফাইনালে জুভেন্টাসকে হারিয়ে ফাইনালে উঠেছিল লিভারপুল। সে ম্যাচের উত্তেজনা থেকেই আঁচ করা গিয়েছিল, এই ম্যাচ রণক্ষেত্রে পরিণত হবেই। একে তো ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনাল, সঙ্গে ইংল্যান্ড আর ইতালির সেরা দুই দল। দুই দলের সমর্থকেরা যে কেউ কাউকে ছাড় দেবে না, তা জানাই ছিল। কিন্তু ইউয়েফার তাতে থোড়াই কেয়ার। বার্সা, রিয়াল ফাইনালের জন্য নিজেদের মাঠ প্রস্তুত করে দিলেও সাড়া দেয়নি তারা। বরং নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল থেকে দুই দলকে পাঠিয়েছে ভঙ্গুর এক মাঠে, বছরের সবচেয়ে হাইভোল্টেজ ম্যাচে মুখোমুখি হতে।

মূল ঘটনায় যাওয়ার আগে স্টেডিয়ামের অবস্থানটা বোঝা বেশ জরুরি। ইউয়েফার নিয়ম অনুযায়ী ফাইনালের টিকিট দুই দলের জন্য সমান হারে বরাদ্দ থাকে। সে অনুযায়ী হেইসেল স্টেডিয়ামের ৬০ হাজার দর্শকের মধ্যে ২৫-২৫ করে ৫০ হাজার টিকিট বরাদ্দ থাকার কথা ছিল দুই দলের সমর্থকদের জন্য। কিন্তু আগের মৌসুমের ফাইনালে লিভারপুল সমর্থকদের আগ্রাসী আচরণের কারণে ইউয়েফা প্রায় ৫ হাজার টিকিট কম বরাদ্দ করে অলরেড সমর্থকদের জন্য। মাঠের দুই প্রান্তে ঠিক করা হয় দুই দলের সমর্থকদের বসার স্থান। জুভেন্টাস সমর্থকদের জন্য বরাদ্দ ছিল M, N ও O জোন এবং লিভারপুলের জন্য X ও Y জোন। Z জোন বরাদ্দ ছিল নিরপেক্ষ সমর্থকদের জন্য। আর আটঘাট বেঁধে সেই Z জোন দখল করে ব্রাসেলসে থাকা ইতালিয়ানরা। আগের মৌসুমেই রোমের মাটিতে রোমাকে হারিয়ে ইউরোপিয়ান কাপ জিতে ইতালিয়ান সমর্থকদের পিটিয়েছিলেন লিভারপুল সমর্থকেরা। সে কথা ভুলে যাননি তাঁরা। মনের চাপা ক্ষোভ নিয়েই সেই জায়গার দখল নিয়েছিলেন তাঁরা।

২৯ মে, ১৯৮৫; বিকেল পাঁচটা। ইতালিয়ান আর ইংলিশ সমর্থকদের কল্যাণে তিল ধারণের স্থান নেই হেইসেল স্টেডিয়ামে। মাঠে ৬০ হাজার দর্শক ধারণের ক্ষমতা থাকলেও ততক্ষণে ৭০ হাজারের বেশি মানুষ ছড়িয়ে ছিলেন মাঠের আনাচকানাচে। সন্ধ্যা সাতটায় শুরু হলো ওয়ার্ম-আপ। আর সেই সঙ্গে দুই দলের সমর্থকদের বুনো সমর্থন। অল রেড সমর্থকেরা একের পর এক ফ্লেয়ার, বোতল, ইটের টুকরা ছুড়তে থাকে Z জোনে। আধা ঘণ্টার মধ্যেই X ও Z জোনের বেড়া ভেঙে ফেলে হুলিগানরা। ম্যাচ শুরুর আগেই রণক্ষেত্রে পরিণত হয় মাঠের X ও Z জোন।

লিভারপুল সমর্থকদের তাড়া খেয়ে পেছাতে থাকে জুভেন্টাস সমর্থকেরা। পেছাতে পেছাতে যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকার অবস্থা, তখন তাড়াও চড়াও হয় লিভারপুল সমর্থকদের ওপর। দুই পক্ষের হাতাহাতিতে আচমকাই ভেঙে পড়ে Z জোনের কংক্রিটের দেয়াল। মাঠেই প্রাণ হারান ৩৯ জন দর্শক। যার মধ্যে ছিলেন ৩২ জন ইতালিয়ান, ৪ জন বেলজিয়ান, ২ জন ফ্রেঞ্চ ও ১ জন নর্দান আয়ারল্যান্ডের নাগরিক। আহত হন প্রায় ৬০০ জন সমর্থক। এতক্ষণে হুঁশ ফেরে পুলিশের। শুরু হয় লাঠিচার্জ আর গ্রেপ্তার। খুনের দায়ে গ্রেপ্তার হন ৩৪ জন, যাঁদের মধ্যে ১৪ জন ছিলেন লিভারপুলের সমর্থক।

ম্যাচ শুরু হতে তখনো প্রায় মিনিট পনেরো বাকি। মাঠে নেমে আসেন ব্রাসেলসের মেয়র, বেলজিয়ামের প্রেসিডেন্ট। সবাই ভেবেই নিয়েছিলেন ম্যাচ স্থগিত হবে, সুস্থ মনে নতুন কোনো মঞ্চে নামবে ইউরোপিয়ান কাপের পর্দা। সবাইকে হতভম্ব করে তাঁরা রেফারিদের চাপ দিতে শুরু করেন ম্যাচ শুরু করতে। জোর করে দুই অধিনায়ক গ্যাতেনো সিরেয়া ও ফিল নিলকে পাঠানো হলো দর্শকদের শান্ত করতে। ঠিক যতটুকু জানালে খেলতে নামবে দুই দল, সেটুকুই জানানো হলো তাদের। মৃত্যুর খবর পুরোপুরি চেপে গেল ওপর মহল। নির্ধারিত সময়ের এক ঘণ্টা পর মাঠে গড়াল ম্যাচ। ৫৯ মিনিটে পেনাল্টি থেকে মিশেল প্লাতিনির একমাত্র গোলে প্রথমবারের মতো ইউরোপিয়ান কাপ জিতল জুভেন্টাস। কিন্তু সেই উল্লাস কখনোই বাসা বাঁধতে পারেনি বিয়াঙ্কোনারিদের মনে। তাই তো ৩৮ বছর পরে এসেও এই শিরোপা উদ্‌যাপন করে না তারা।

খেলোয়াড়দের কানে এই মৃত্যুর খবর পৌঁছায় পরদিন সকালে। ততক্ষণে প্লেনে করে নিজেদের বাড়িতে পৌঁছে গেছে দুই দল। পুলিশি নিরাপত্তায় ম্যাচ শেষ হওয়ার এক ঘণ্টার মাঝেই দুই দলকে নিজেদের দেশে পাঠিয়ে দেয় বেলজিয়াম সরকার। সর্বোচ্চ চেষ্টা ছিল মিডিয়ার কাছ থেকে এই ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার।

পরদিনই এক তদন্তে সম্পূর্ণ দোষ চাপিয়ে দেওয়া হয় লিভারপুল সমর্থকদের ঘাড়ে। দেড় বছরের তদন্ত শেষে ১৪ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দেন আদালত। আজীবন নিষিদ্ধ হন আটক ৩৪ জন সমর্থক। ইউরোপিয়ান ফুটবলে ইংলিশদের ঔদ্ধত্য আচরণ রুখতে ৫ বছরের জন্য ইউরোপ থেকে নিষিদ্ধ করা হয় ইংল্যান্ডকে। আর লিভারপুল দলকে ৬ বছরের জন্য। কিন্তু যাদের জন্য এই দুর্ঘটনা, সেই হেইসেল স্টেডিয়াম কর্তৃপক্ষ, নিয়মের বেড়াজাল কাটিয়ে তারা ঠিকই ছাড় পেয়ে যায়।

জুভেন্টাসের প্রথম ইউরোপ জয় হয়ে থাকে ফুটবলের এক রক্তাক্ত ইতিহাসের সাক্ষী। যে ইতিহাস ফুটবলের ভুলে যাওয়া এক গল্প। ৩৯টি প্রাণের বিনিময়ে বদলে গিয়েছিল ইউরোপিয়ান ফুটবলের গল্প। কড়াকড়ি শুরু হয়েছিল ফুটবলের প্রতিটি প্রান্তে, মাঠ থেকে শুরু করে দর্শক, সবাই নজরবন্দী। পান থেকে চুন খসলেই সবটা এখন ধরা পড়ে ক্যামেরায়। আজকে টাকার ঝনঝনানি, ক্যামেরা ফ্ল্যাশে টেকা মুশকিল ফুটবল মাঠে, সবটাই শুরু হয়েছিল এই হেইসেল থেকে। যে ইতিহাস লেখা হয়নি কোনো বইয়ে, বলা হয়নি কোনো গল্পে। ঘুণে ধরা, হাজারো ইতিহাসের ভিড়ে চেপে যাওয়া এক ইতিহাস, যা প্রতি মুহূর্তে শিক্ষা দেয়, কীভাবে কর্তৃপক্ষের অবহেলা আর হুলিগানিজম বদলে দিতে পারে সুন্দর এই খেলার চিত্র। কীভাবে ফুটবলের সবুজ মাঠ মুহূর্তেই পরিণত হতে পারে এক রক্তাক্ত প্রান্তরে।