টি-টোয়েন্টিতে নতুন বাংলাদেশ

‘কয়েকজন সম্ভাবনাময় পেসার থাকলেও, বোলিংয়ে স্পিনাররাই বাংলাদেশের মূল শক্তি।’

‘টি-টোয়েন্টিতে খুব একটা ভালো দল নয় বাংলাদেশ।’

বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলকে নিয়ে এ দুটি কথায় একমত হবেন অনেকেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্পিনারদের ঘিরে সাজানো হয় বাংলাদেশের বোলিং আক্রমণ। স্পিন–সহায়ক পিচে এ কৌশলে উপমহাদেশের অনেক দলই খেলে। পার্থক্য হলো, পেস বোলিংয়ের ভালো বিকল্প থাকে অন্য দলগুলোতে। এখানে পিছিয়ে যেত বাংলাদেশ। তিন ফরম্যাটের জন্য খুব ভালো পেস বোলিং বিকল্প কখনো ছিল না দলটির। আর টি-টোয়েন্টিতে আমাদের দুর্বলতার কথা তো আর নতুন কিছু নয়।

তবে বাংলাদেশ দল প্রমাণ করেছে এগুলো এখন অতীত। পেস বোলিংয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই ধারাবাহিকভাবে উন্নতি করছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। মাশরাফি বিন মুর্তজার হাত ধরে যে পেসনির্ভর বোলিং আক্রমণের স্বপ্ন দেখেছিল বাংলাদেশ, তা পূর্ণতা পেয়েছে গত দুই বছরে। তাসকিন আর মোস্তাফিজ—দুজনেরই অভিষেক হয়েছিল অমিত সম্ভাবনা নিয়ে। মোস্তাফিজ দলে টিকে গেলেও নানা চড়াই-উতরাই পাড়ি দিতে হয়েছে তাসকিনকে। ফর্মহীনতার কারণে একপর্যায়ে জায়গা হারিয়েছেন দল থেকে, চোটের কারণে জায়গা হয়নি ২০১৯ বিশ্বকাপ দলে।

সেই তাসকিন কোভিড মহামারির পর ফিরে এলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপে। আগের চেয়ে আরও পরিণত, আরও ধারাবাহিক হয়ে। দারুণ পারফরম্যান্স দিয়ে তিনি বনে গেছেন পেস বোলিং ইউনিটের নেতা। একসঙ্গে বাংলাদেশের পেসারদের দেখলে টেলিভিশনের ধারাভাষ্যকারেরাও এখন বলে ওঠেন, ‘তাসকিন অ্যান্ড কোং’। টেস্ট দলের নিয়মিত মুখ ইবাদত হোসেনও বুঝে গেছেন সাদা বলে বোলিং করার তরিকা। পাশাপাশি তরুণ হাসান মাহমুদ আর শরীফুলের অন্তর্ভুক্তি বাড়িয়েছে দলের ভারসাম্য। গত এক বছরে পাওয়া গেছে এর প্রমাণও। আয়ারল্যান্ড সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে প্রথমবারের মতো প্রতিপক্ষের ১০ উইকেট তুলে নিয়েছেন বাংলাদেশের পেসাররা। ফলে স্পিনের সঙ্গে পেস বোলিংয়েও বাংলাদেশ এখন সমান শক্তিশালী—এ কথা বললে ভুল হবে না।

তাওহীদ হৃদয়ের ব্যাটে নতুন আশা দেখছে বাংলাদেশ
ছবি: শামসুল হক

পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে টি-টোয়েন্টি দলেও। এর প্রমাণ পাওয়া গেছে ইংল্যান্ড সিরিজে। ঘরের মাঠে ওয়ানডেতে বরাবরই দুর্দান্ত খেলা বাংলাদেশ হেরে যায় ওয়ানডে সিরিজে। আর সবাইকে চমকে দিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের হোয়াইটওয়াশ করে বসে টি-টোয়েন্টি সিরিজে। তখন থেকে গুঞ্জন শুরু টি-টোয়েন্টি দলকে ঘিরে।

ক্রিকেটের ছোট এই ফরম্যাটে কখনো ভালো খেলেনি বাংলাদেশ। ২০০৭ সাল থেকে খেলা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নেই বলার মতো কোনো সাফল্য। ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর বোর্ড তাই সিদ্ধান্ত নেয় দলটাকে ঢেলে সাজানোর। দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় সাকিব আল হাসানের হাতে। দলটির বদলে যাওয়ার শুরু এর পর থেকেই।

টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল রানরেট নিয়ে। বর্তমান যুগে যেখানে টি-টোয়েন্টিতে দলগুলো নিয়মিত ২০০+ রান করছে, সেখানে বাংলাদেশ হিমশিম খেত ১৫০ তুলতেই। এ অভিযোগ ঘোচাতে আট বছর পর দলে ডাক পান ওপেনার রনি তালুকদার, অভিষেক হয় তাওহীদ হৃদয়ের। তাওহীদ হৃদয়ের ক্রিকেটার হওয়ার গল্পটা একটু অদ্ভুত। অদ্ভুত না বলে হৃদয়বিদারক বললেও ভুল হয় না।

ভবিষ্যতে যাঁরা খেলাধুলাকে পেশা হিসেবে নিতে চান, তাঁদের সবারই চেষ্টা থাকে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) ভর্তি হওয়ার। ব্যতিক্রম ছিলেন না তাওহীদও। তবে ভাগ্য সহায় না হওয়ায় বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়া হয় না তাঁর। ঢাকায় থেকে কোনো বেসরকারি ক্লাবে ভর্তি হয়ে ক্রিকেট শেখাটা মফস্‌সলের যেকোনো ছেলের জন্য অনেকটা অবাস্তবই। খুব বেশি অবস্থাপন্ন না হলে এ খরচ কুলিয়ে ওঠা সম্ভব নয় বেশির ভাগ মানুষের জন্যই। কিন্তু তাওহীদ ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ক্রিকেটারই হবেন তিনি। বাবাকে না জানিয়ে জমি বন্ধক রাখলেন তাঁর মা। এলাকার এক বড় ভাইকে সঙ্গে নিয়ে ভর্তি হলেন বনশ্রীর একটি ক্রিকেট একাডেমিতে। ভর্তির কিছুদিন পরই বুঝতে পারেন, প্রতারণার শিকার হয়েছেন। যেখানে ভর্তি হয়েছেন, সে একাডেমিটা ভুয়া!

ওপেনিংয়ে ঝড় তুলেছেন লিটন দাস (বাঁয়ে) ও রনি তালুকদার
ছবি: শামসুল হক

এমন অবস্থায় হয়তো বেশির ভাগ মানুষই হতাশ হয়ে ফিরে যেতেন বাড়িতে। তাওহীদ ব্যতিক্রম এখানেই। নিজের ওপর আস্থা ছিল বলেই ঢাকা ছেড়ে যাননি, দাঁতে দাঁত চেপে খেলে গেছেন ক্রিকেট। এর ফলও পেয়েছেন তিনি। সুযোগ পেয়েছেন বাংলাদেশের বয়সভিত্তিক দলে, বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে জিতেছেন বিশ্বকাপ। এই কয়েক বছরে হয়েছেন আরও পরিণত। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষেক টি-টোয়েন্টি ম্যাচে খুব বড় ইনিংস খেলতে পারেননি, ১৭ বলে করেছেন ২৪ রান। কিন্তু এ ছোট ইনিংসে তাঁর ব্যাট থেকে ঝরে পড়েছে আত্মবিশ্বাস। দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে এটা তাঁর প্রথম ম্যাচ। এ ফর্ম তিনি ধরে রেখেছেন আয়ারল্যান্ড সিরিজেও। এক দিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অভিষেক ম্যাচে করেছেন ৯২ রান। অল্পের জন্য সেঞ্চুরি না পেলেও কোনো আফসোস ছিল না তাওহীদের। আফসোস নেই বাংলাদেশেরও, দেশটা যে পেয়ে গেছে নতুন তারকা।

শুধু তাওহীদই নয়, বাংলাদেশ নতুন করে পেয়েছে নাজমুল হোসেন শান্তকেও। ফর্মহীনতার কারণে গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়া— সমালোচিত হয়েছেন সবখানে। দল থেকে তাঁকে বাদ দেওয়ার দাবিও উঠেছিল বেশ কয়েকবার। কিন্তু বোর্ড আর অধিনায়ক আস্থা রেখেছিলেন তাঁর ওপর। এর প্রতিদানও দিয়েছেন শান্ত। বছরের শুরুতে অনুষ্ঠিত হওয়া বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক আর টুর্নামেন্ট সেরা হয়ে ইঙ্গিত দেন ফর্মে ফেরার। এ ফর্মটাই ধরে রাখেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। ম্যাচসেরা হন টি-টোয়েন্টি সিরিজে। কয়েক দিন আগে দলে যাঁর জায়গা নিয়ে প্রশ্ন উঠত, সেই শান্ত এখন তিন সংস্করণেই বাংলাদেশ দলের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আর দীর্ঘদিন পর দলে ফেরা রনি তালুকদারের মারকাটারি ব্যাটিং দেখে অনেকেই বলে উঠেছেন, ‘আরে! এমন এক ওপেনারের খোঁজেই তো ছিলাম আমরা!’

ওপেনিংয়ে ঝড় তুলেছেন লিটন দাস (বাঁয়ে) ও রনি তালুকদার

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ, আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি সিরিজ—সব মিলিয়ে টানা তিনটা সিরিজ জয় বাংলাদেশের। ঘরের মাঠে বাংলাদেশ অপ্রতিরোধ্য সব সময়। তবে এবারের জয়গুলো খেলোয়াড় থেকে শুরু করে আত্মবিশ্বাস দিয়েছে দর্শকদের, যে এই দলটা ভালো করতে পারবে দেশের বাইরেও। ছয় মাস পর থেকে শুরু হওয়া ওয়ানডে বিশ্বকাপের আগে যেটা খুব বেশি করে দরকার ছিল বাংলাদেশের।