নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অজেয় অস্ট্রেলিয়া

১৫তম ওভারের খেলা চলছে। ১৭৩ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করছেন ভারতীয় অধিনায়ক হারমানপ্রীত কর আর রিচা ঘোষ। ৩০ বলে প্রয়োজন ৪৯ রান, টি–টোয়েন্টি ক্রিকেটে যাকে এখন সহজই বলা চলে। অস্ট্রেলিয়ান লেগ স্পিনার জর্জিয়া ওয়ারহ্যামের করা প্রথম দুই বলেই চার মেরে সমীকরণকে আরও সহজ করে দেন হারমানপ্রীত। পাশাপাশি মাত্র ৩২ বলেই তুলে নেন অর্ধশতক। মনে হচ্ছিল, নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অষ্টম আসরের প্রথম সেমিফাইনালে পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দেবে ভারত। ঠিক তখনই ভারতের ওপর পাল্টা আঘাত হানে অজিরা। তবে ‘অজিরা’ না বলে যদি বলা হয় আঘাত হানে দুর্ভাগ্য, তাহলেও বোধ হয় খুব একটা ভুল হবে না।

ডিপ মিডউইকেট দিয়ে স্লগ সুইপ করেন হারমানপ্রীত। বেশ জোরের ওপর শট ছিল, ফলে ফিল্ডার অ্যাশলে গার্নারকে বলটা ধরতে হলো বেশ কষ্ট করে। এক রান শেষ করে দ্বিতীয় রানের জন্য ছুটলেন হারমানপ্রীত। গার্নার বলটা বেশ ভালোভাবেই থ্রো করলেও রানআউট করার জন্য তা যথেষ্ট মনে হচ্ছিল না। বাদ সাধল বেরসিক পপিং ক্রিজ। হারমানপ্রীত ব্যাট নামিয়ে দিয়েছিলেন বেশ আগেই, কিন্তু দাগের প্রায় এক ইঞ্চি আগে ব্যাটটা আটকে গেল তাঁর। ক্ষণিকের ওই ঘটনাই কাল হলো হারমানপ্রীত আর ভারতের জন্য। ব্যাট আটকে যাওয়ায় সময়মতো ক্রিজে ঢুকতে পারলেন না তিনি, অস্ট্রেলিয়ার উইকেটকিপার এলিসা হিলি ভেঙে দিলেন স্টাম্প। রানআউট হয়ে যান হারমানপ্রীত কর। এর সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায় টানা দ্বিতীয়বারের মতো ভারতের ফাইনাল খেলার স্বপ্ন। শেষ ওভার পর্যন্ত ভারত লড়াই করে গেলেও অস্ট্রেলিয়া ম্যাচটা জিতে নেয় ৫ রানে।

সেমিফাইনালে ভাগ্য সহায়তা করলেও, গোটা টুর্নামেন্টে দারুণ খেলে অস্ট্রেলিয়া। আসলে শুধু এই বিশ্বকাপ না, ২০০৯ সাল থেকে শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হওয়া আট আসরের ছয়টিতেই চ্যাম্পিয়ন তারা। ফলে নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ মানেই অস্ট্রেলিয়ার জয়জয়কার।

হারমানপ্রীতের সেই রানআউট

নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের এবারের আসর বসে দক্ষিণ আফ্রিকাতে। অস্ট্রেলিয়া তো বরাবরই ফেবারিট। পাশাপাশি গতবারের ফাইনালিস্ট ভারত, ইংল্যান্ড আর স্বাগতিক দল হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকাকেও শিরোপার দাবিদার বলেছিল অনেকে। দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে বিশ্বকাপে অংশ নেয় মোট ১০টি দল। প্রতি গ্রুপ থেকে দুটি করে দল খেলে সেমিফাইনালে। অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশ ছিল গ্রুপ এ–তে। আর গ্রুপ বি–তে ছিল ইংল্যান্ড, ভারত, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, পাকিস্তান আর আয়ারল্যান্ড।

গ্রুপ পর্বে অস্ট্রেলিয়াকে তেমন কোনো বাধার মুখেই পড়তে হয়নি, চার ম্যাচই বেশ বড় ব্যাবধানে জিতে সেমিফাইনালে পৌঁছায় মেগ ল্যানিংয়ের দল। তবে জমে ওঠে দ্বিতীয় স্থান দখলের লড়াই। ৪ ম্যাচের মধ্যে ২টি করে ম্যাচে জয় পায় দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড আর শ্রীলঙ্কা। শেষ পর্যন্ত রানরেটে এগিয়ে থাকায় গ্রুপ রানার্সআপ হয়ে সেমিফাইনালে পা রাখে স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকা।

গ্রুপ বি-তে অবশ্য এত নাটকীয়তা হয়নি। সব কটি ম্যাচ জিতে নিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয় ইংল্যান্ড, আর তিন ম্যাচে জয় নিয়ে গ্রুপ রানার্সআপ হয় ভারত।

এদিকে ভুলে যাওয়ার মতোই একটা বিশ্বকাপ কাটিয়েছে বাংলাদেশ। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে চ্যাম্পিয়ন হওয়া দলটির কাছে প্রত্যাশা ছিল ভালো পারফরম্যান্সের। দলে সুযোগ পান সদ্য সমাপ্ত হওয়া নারী অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ভালো পারফর্ম করা স্বর্ণা আক্তার আর দিশা বিশ্বাসও। তবে বরাবরের মতো এবারও হতাশাই সঙ্গী হয়েছে বাংলাদেশের। একটি ম্যাচও জিততে না পারায় ২০১৪ সাল থেকে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মূল পর্বে এখনো জয়হীন বাংলাদেশ।

অস্ট্রেলিয়ার আনন্দ আর দক্ষিণ আফ্রিকার হতাশা

প্রথম সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার জয়ের কথা তো বলেছি। জমজমাট হয়েছে দ্বিতীয় সেমিফাইনালও। প্রথমে ব্যাটিং করে ২০ ওভারে ১৬৪ রান সংগ্রহ করে স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকা। জবাবে ব্যাটিংয়ে নেমে দারুণ সূচনা পায় ইংল্যান্ড। উদ্বোধনী জুটি থেকে আসে ৫৩ রান। খেলার এ অবস্থায় দক্ষিণ আফ্রিকার সাবনিম ইসমাইলের জোড়া আঘাতে কিছুটা চাপে পড়ে ইংল্যান্ড। তবে ইংলিশ অধিনায়ক হেদার নাইট আর ন্যাট ব্রান্ট রানের চাকা সচল রাখায় ম্যাচ থেকে কখনোই ছিটকে পড়েনি তারা। শেষ ওভারে জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল ১৩ রান। বল হাতে তুলে নেন স্বাগতিক দলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বোলার সাবনিম ইসমাইল। চাপের মুখে দারুণ করেন তিনি, ওভারটি থেকে আসে মাত্র ৬ রান। এবং পুরুষ ও নারী ক্রিকেট মিলিয়ে প্রথমবারের মতো কোনো আইসিসি টুর্নামেন্টের ফাইনালে ওঠে দক্ষিণ আফ্রিকা।

প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনালে পা রাখা দক্ষিণ আফ্রিকার সামনে পাঁচবার আর টানা দুইবার বিশ্বকাপ জেতা অস্ট্রেলিয়া। টসে জিতে ব্যাট করতে নেমে ভালো সূচনাই পায় অস্ট্রেলিয়া। তবে সমস্যা হয় রানরেটে। উইকেট না হারালেও বেথ মুনি ছাড়া টি–টোয়েন্টি–সুলভ ব্যাটিং করতে পারেননি কেউই। ফলে ২০ ওভার শেষে ১৫৬ রানে থেমে যায় অস্ট্রেলিয়ার ইনিংস। বেথ মুনির ৫৩ বলে ৭০ রান ছাড়া ভালো ব্যাটিং করতে পারেননি আর কেউই।

লক্ষ্য হাতের নাগালে। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম ফাইনাল। শিরোপা জেতার জন্য এর চেয়ে ভালো মঞ্চ আর কিছুই হতে পারে না। এই চাপেই বোধ হয় ভেঙে পড়ে প্রোটিয়ারা। উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান লরা উলভার্ট ছাড়া কেউই থিতু হতে পারেননি ক্রিজে। এক প্রান্ত আগলে রেখে তিনি ৪৮ বলে ৬১ রান করলেও সঙ্গীর অভাব বোধ করেছেন ইনিংসের শেষ পর্যন্ত। ২০ ওভার শেষে ৬ উইকেটে ১৩৭ রান করতে সক্ষম হয় দক্ষিণ আফ্রিকা, আর ষষ্ঠবারের মতো শিরোপা জয় করে অস্ট্রেলিয়া।

টুর্নামেন্ট সেরা অ্যাশলে গার্ডনার

পুরুষ ক্রিকেট হোক বা নারী ক্রিকেট—বিশ্বকাপ এলেই যে জ্বলে ওঠে অস্ট্রেলিয়া, সেটা প্রমাণ হলো আবারও। এই জয়ের মাধ্যমে একমাত্র অধিনায়ক হিসেবে ছয়টি বিশ্বকাপ জেতার বিরল কৃতিত্ব অর্জন করেন অজি অধিনায়ক মেগ ল্যানিং।

নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পরের আসর বসবে ২০২৪ সালে, আয়োজন করবে বাংলাদেশ। সে বিশ্বকাপেও দাপট দেখাবে অস্ট্রেলিয়া, ফাইনাল শেষে দলের সবার কণ্ঠে ফুটে উঠল এই কথাই।