বিশ্বকাপের নতুন তারা

প্রতি বিশ্বকাপেই ফুটবলপ্রেমীরা আগ্রহ নিয়ে বসে থাকেন নতুন কোনো তারকার উত্থান দেখতে। পেলে থেকে মেসি-রোনালদো, এমনকি হালের এমবাপ্পে—বেশির ভাগ ফুটবল তারকার দ্যুতি ছড়ানোর শুরুটা কিশোর বয়সে, কোনো এক বিশ্বকাপের মঞ্চে খেলতে এসেই। জমে ওঠা এবারের কাতার বিশ্বকাপও এর ব্যতিক্রম নয়। ইতিমধ্যে প্রথমবার বিশ্বকাপ খেলতে এসেছেন দলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে অনেক তরুণ ফুটবলার। আগামী দিনের তারকা হিসেবে বিবেচনা করা এমন ফুটবলারদের নিয়েই এ লেখা।

জুড বেলিংহাম (ইংল্যান্ড)

কৈশোরের আভা এখনো চেহারায় রয়েছে বেলিংহামের কিন্তু এখনই তারকাখ্যাতি পেয়ে গেছেন এই ইংলিশ ফুটবলার। মাত্র ১৯ বছর বয়সে ইংল্যান্ড দলের মিডফিল্ডের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। জার্মান লিগে ডর্টমুন্ডের হয়ে দারুণ এক মৌসুম কাটাতে থাকা বেলিংহাম তাঁর ফর্ম নিয়ে এসেছেন বিশ্বকাপেও। বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমেই গোল করেছেন ইরানের বিপক্ষে। ফল হিসেবে বিশ্বকাপের রেকর্ড বুকে দ্বিতীয় কনিষ্ঠ ইংরেজ গোলদাতা হিসেবে নাম লেখা হয়ে গেছে। মূলত নাম্বার এইট হিসেবে খেলা বেলিংহাম মাঝমাঠের দায়িত্ব সামলান বেশ ভালোভাবে। ট্যাকল করে বল কেড়ে নেওয়া থেকে শুরু করে ড্রিবলিং করে বল নিয়ে এগোনো—গোলের সুযোগ তৈরি করা, এমনকি গোল করায়ও দারুণ পটু এই অলরাউন্ড ফুটবলার। ফুটবল বিশ্বে গুঞ্জন চলছে—আগামী ট্রান্সফার মৌসুমে তাঁর দাম উঠতে পারে ১০০ মিলিয়ন ইউরো!

জামাল মুসিয়ালা (জার্মানি)

মাত্র ১৭ বছর বয়সেই বায়ার্ন মিউনিখের মতো দলে অভিষেক হওয়া মুসিয়ালাকে উঠতি তারকার তকমা দেওয়া হয়েছে আরও বছরখানেক আগে। জার্মানিতে জন্ম নিলেও মাত্র সাত বছর বয়সে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমিয়েছিলেন তিনি পরিবারের হাত ধরে। ইংল্যান্ডে বড় হওয়ার সুবাদে খেলেছেন ইংল্যান্ডের অনূর্ধ্ব-২১ দলের হয়েও! কিন্তু সাবেক জার্মান কোচ জোয়াকিম লোর কথায় রাজি হয়ে ইংল্যান্ড ছেড়ে শেষমেশ জার্মানির জার্সিই গায়ে জড়িয়েছেন মুসিয়ালা। তারপর এই ১৯ বছর বয়সেই জার্মান দলের নিয়মিত খেলোয়াড় তিনি। হালকা–পাতলা গড়নের জামাল দলের প্লেমেকারের ভূমিকায় খেলে থাকেন। নাম্বার টেন হিসেবে দলের আক্রমণ তৈরি করার মূল সুতা তাঁর পায়েই থাকে। বায়ার্ন মিউনিখের অপরিহার্য সদস্য হওয়ার পর জার্মানির বিশ্বকাপ–যাত্রায়ও জামাল মুসিয়ালা তাই মুলার-নয়্যারদের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নন।

ইউসুফা মুকোকো (জার্মানি)

জামাল মুসিয়ালা যদি হন জার্মানির আক্রমণ তৈরির কেন্দ্রবিন্দু, তাহলে সেই আক্রমণকে গোলে রূপান্তর করার অস্ত্র হবেন ইউসুফ মুকোকো। এবারের বিশ্বকাপের সবচেয়ে তরুণ ফুটবলার হিসেবে নাম লিখিয়েছেন ডর্টমুন্ডের এই তারকা। মাত্র ১৮ বছর বয়স তাঁর। ডর্টমুন্ডের জুনিয়র টিমে গোলের প্রায় সব রেকর্ড নিজের নামে লিখিয়ে সিনিয়র দলের জার্সি গায়ে চাপিয়েছিলেন মুকোকো। সিনিয়র দলে এসেও গোল করার ধার কমেনি তাঁর। এই মৌসুমে বুন্দেসলিগায় ৬ গোল করে বিশ্বকাপে এসেছেন ছোটখাটো গড়নের এই স্ট্রাইকার। মিরোস্লাভ ক্লোসা, টমাস মুলারদের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে মউকোকোকে সার্টিফিকেট দিচ্ছেন পণ্ডিত-সমর্থক সবাই।

গাভি (স্পেন)

একঝাঁক তরুণ ফুটবলারদের নিয়ে বিশ্বকাপে আসা স্পেন দলের কনিষ্ঠতম সদস্য গাভি। বার্সেলোনার একাডেমি থেকে উঠে আসা গাভি দলটির নিয়মিত একাদশে থাকেন। বয়সের হিসাবে এখনো ১৮ চলছে তাঁর। ক্লাবের হয়ে নজরকাড়া পারফর্ম করার পর ডাক পেয়েছেন স্পেনের বিশ্বকাপ দলে। কিছুদিন আগে জিতেছেন তরুণ ফুটবলারদের শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার গোল্ডেন বয় অ্যাওয়ার্ড। পাসিং–নির্ভর স্পেন দলে তাঁর ভূমিকা সেন্ট্রাল মিডফিল্ডারের। দারুণ পাসিং আর সঙ্গে প্লেমেকিং করার ক্ষমতা—দুইয়ে মিলে গাভির মধ্যে স্পেনের কিংবদন্তি মিডফিল্ডার জাভি হার্নান্দেজের ছায়া দেখছেন অনেকে।

পেদ্রি (স্পেন)

স্পেন দলের একসময়কার প্রাণভোমরা জাভি-ইনিয়েস্তার আধুনিক প্রতিচ্ছবি ভাবা হচ্ছে গাভি-পেদ্রিকে। ১৮ বছরের গাভিকে নিয়ে আমরা আগেই কথা বলেছি, এবার বলা যাক পেদ্রিকে নিয়ে। গাভির মতোই বার্সেলোনার মূল দলের অপরিহার্য সদস্য এই ১৯ বছর বয়সী মিডফিল্ডার। গত ইউরোতে স্পেনের হয়ে অসাধারণ খেলার সুবাদে দলে পাকাপোক্ত হয়ে গেছেন পেদ্রি। এবারের বিশ্বকাপে পেদ্রির কাছে তাই স্প্যানিশদের প্রত্যাশাও বেশি। সেন্টার মিডে খেললেও পেদ্রির খেলার ধরন বেশ আক্রমণাত্মক। ড্রিবলিং, পাসিং এবং গোলের সুযোগ তৈরি করতে পারদর্শী তিনি। আগামীর তারকা হিসেবে খ্যাতি পাওয়া পেদ্রি ঠিক আগের মৌসুমেই জিতেছেন গোল্ডেন বয় অ্যাওয়ার্ড! এবার অপেক্ষা বিশ্বকাপে প্রথমবার তাঁর আলোকচ্ছটা দেখার।

এদুয়ার্দো কামাভিঙ্গা (ফ্রান্স)

অ্যাঙ্গোলার রিফিউজি ক্যাম্পে জন্ম নেওয়া কামাভিঙ্গা পরিবারের সঙ্গে শরণার্থী হিসেবে পাড়ি জমান ফ্রান্সে। তখন তাঁর মাত্র দুই বছর বয়স। ফ্রান্সে দারুণ কষ্টে বড় হতে হয়েছে তাঁকে। বেড়ে ওঠার সময়েই ধীরে ধীরে নিজের ফুটবলীয় সামর্থ্যের প্রমাণ রেখে জায়গা করে নেন ফরাসি বয়সভিত্তিক দলে। পাশাপাশি ক্লাবের জার্সিতে দুর্দান্ত খেলার সুবাদে নজরে আসেন স্প্যানিশ জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদের। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। অভাবের জীবন দূরে ঠেলে ২০ বছর বয়সী এই তরুণ ডাক পেয়েছেন ফ্রান্সের বিশ্বকাপ দলেও। কান্তে-পগবার ইনজুরির কারণে ফরাসিদের মাঝমাঠের অন্যতম ভরসা হিসেবে কামাভিঙ্গাকেই ভাবছেন দলটির কোচ দিদিয়ের দেশম। নতুন তারকাদের মধ্যে তাঁর নামটাও জ্বলজ্বল করছে এবার বিশ্বকাপে।

গাভারদিওল (ক্রোয়েশিয়া)

কম বয়সী তারকাদের মধ্যে গাভারদিওলের নাম বেশ জোরেশোরেই শোনা যাচ্ছে এবার। ক্রোয়েশিয়ার ২০ বছর বয়সী এই সেন্টারব্যাক এরই মধ্যে নিজেকে প্রমাণ করেছেন জার্মান ক্লাব লাইপজিগের জার্সিতে। বাঁ পাশের সেন্টারব্যাক হিসেবে ছয় ফুট উচ্চতার গাভারদিওলকে অনেকে তুলনা করেন অভিজ্ঞ ডাচ ডিফেন্ডার ভার্জিল ফন ডাইকের সঙ্গে। মদরিচ, কোভাচিচদের সঙ্গী হিসেবে এবারের বিশ্বকাপে ডাক পেয়েছেন তিনি। খেলবেন মূল একাদশেও। গতবারের ফাইনালিস্ট ক্রোয়েশিয়া এবারও চায় চমৎকার একটা বিশ্বকাপ–যাত্রা করতে, আর সেটা করতে হলে বেশ ভালো ভূমিকা রাখতে হবে গাভারদিওলের।

এবারের বিশ্বকাপে তরুণ খেলোয়াড়দের মধ্যে রয়েছেন ইংল্যান্ডের বুকায়ো সাকা ও ফিল ফোডেন, ফ্রান্সের ডিফেন্ডার উইলিয়াম সালিবা, ব্রাজিলের উইঙ্গার রদ্রিগো ও মার্তিনেল্লি, আর্জেন্টিনার মিডফিল্ডার এনজো ফার্নান্দেজ, ইকুয়েডরের মোজেস কাইসিদো, পর্তুগালের নুনো মেন্দেসসহ আরও অনেকে। তাঁদের অনেকে মাতাবেন, দাপটের সঙ্গে শাসন করবেন আগামী দিনের ফুটবল–বিশ্বকে। কিন্তু এবারের বিশ্বকাপে যাঁরা মন জয় করবেন, ফুটবল–ভক্তরা তাঁদেরই মনে রাখবেন আজীবন।