যে পরিবার এগিয়ে নিয়েছে নেদারল্যান্ডসের ক্রিকেট

নেদারল্যান্ডস আর ক্রিকেট—শব্দ দুটি একসঙ্গে শুনলেই একটি নাম চোখের সামনে ভেসে ওঠে—রায়ান টেন ডেসকাট। নেদারল্যান্ডস নামের একটি দেশ যে ক্রিকেট খেলে, বিশ্বে তা ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন ডেসকাট। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের যুগে ফেরিওয়ালার মতো ঘুরে বেরিয়েছেন দেশে-বিদেশে, মুখে মুখে ছড়িয়ে দিয়েছেন ডাচদের নাম। আজকের গল্পটা ডেসকাটকে নিয়ে নয়, বরং ডাচ এক পরিবারকে নিয়ে। যারা শুধু ডাচদের ক্রিকেটকে এগিয়েই নেয়নি, ক্রিকেটেরই গোড়াপত্তন করেছিল অচেনা এক ইউরোপীয় দেশে।

বিশ্বকাপের সুবাদে বাস ডি লিডি নামটা এখন অনেকের মুখে মুখে। ব্যাটিং বলো আর বোলিং, পাকিস্তানের শক্তিশালী লাইনআপের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন তিনি একাই। বল হাতে ৪ উইকেট, ব্যাটে হাতে ৬৭ রান। ব্যাটে-বলে এমন অলরাউন্ড পারফরম্যান্স করেও বিরস বদনে মাঠ ছাড়তে হয়েছে তাঁকে। বিরস বদনে ডি লিডি মাঠ ছাড়লেও নামটা স্মৃতিতে আটকে গেছে অনেক আটপৌরে ক্রিকেট সমর্থকের। স্মৃতির মনিকোঠায় ভেসে উঠেছে আরেক ডি লিডির গল্প। এই বিশ্বকাপের মঞ্চেই যিনি ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন ভারতীয় ব্যাটিং লাইনআপের।

নেদারল্যান্ডসের ক্রিকেটের প্রথম বড় নাম বলতে যা বোঝায়, সেটাই ছিলেন টিম ডি লিডি। নেদারল্যান্ডসে তখন ক্রিকেটার বলে কোনো পেশা ছিল না। স্কুলের শিক্ষক, বই বিক্রেতা, মাছের বাজারের দোকানি; কাজের বাইরে যে যতটুকু সময় পেতেন, ঠিক ততটুকুই দিতেন ক্রিকেটের প্রতি। দৃশ্যপট বদলে গেল ১৯৯৪ আইসিসি ট্রফিতে তৃতীয় স্থান অর্জন করার পর। মজার ছলে, কাজের ফাঁকে ক্রিকেট খেলা দেশটির হাতে বিশ্বকাপের টিকিট। তখনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়নি ডাচদের। অথচ বিশ্বকাপের টিকিট তাদের হাতে। কোনোমতে টিকিটের টাকা জোগাড় করে পাড়ি দিলেন উপমহাদেশে। মাঠে নামার আগে মোটে মাত্র চার দিন অনুশীলন করার সুযোগ পেয়েছিল নেদারল্যান্ড দল। নতুন দল হিসেবে তাদের কাছ থেকে যতটা আশা করা যায়, সেটাই দেখেছিল বিশ্ব। গুটিকয়েক ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স ছাড়া বলার মতো কিছুই ছিল না তাদের। এই গুটিকয়েক পারফরম্যান্সের মধ্যেই নজর কেড়েছিলেন টিম ডি লিডি নামের ২৮ বছর বয়সী এক তারকা।

চার বছর পর ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে সহ–আয়োজক হলো নেদারল্যান্ডস। যদিও সে বিশ্বকাপে দর্শক হয়েই থাকতে হয় ডাচদের। ২০০১ আইসিসি ট্রফি জিতে আবারও বিশ্বকাপের মূল মঞ্চে ফেরত আসে ডাচরা। আর টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচেই বিশ্বকে চমকে দেন টিম ডি লিডি। ৪ উইকেট নিয়ে ভারতের বিখ্যাত ব্যাটিং লাইনআপকে ধসিয়ে দেন একাই। ম্যাচ হেরে গেলেও ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার ওঠে তাঁর হাতে। বিশ্বকাপজুড়েই ছিল নেদারল্যান্ডসের ‘ওয়ানম্যান শো’, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অপরাজিত ৫৮ রান, অস্ট্রেলিয়া ও পাকিস্তানের বিপক্ষে ২ উইকেট। বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডস বলার মতো কিছু করতে না পারলেও, টিম ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল। ছোট দলের বড় তারকা বলতে যা বোঝায়, সেটাই ছিলেন টিম ডি লিডি।

৪ উইকেট নিয়ে ভারতের বিখ্যাত ব্যাটিং লাইনআপকে ধসিয়ে দেন টিম ডি লিডি
ছবি: আইসিসি

২০০৭ সালে তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপে নামেন ডি লিডি। তত দিনে বয়স ছুঁয়েছে ৪০-এর কোঠা। বিশ্বকাপে লিডি এসেছিলেন নিজের ছায়া হয়েই। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে অবিস্মরণীয় এক জয় দিয়ে ক্রিকেটকে বিদায় বলেন টিম। বিশ্বকাপের মঞ্চ থেকে যাত্রা শুরু করা ডি লিডি, বিদায়ও বললেন সেই বিশ্বকাপ থেকেই।

জন্মের পর থেকে বাবা টিম ডি লিডিকে নায়ক হিসেবেই দেখে এসেছেন বাস ডি লিডি। টিম যখন নিজের ক্রিকেট প্যাড পাকাপাকিভাবে তুলে রাখেন, বাসের বয়স তখন মাত্র ৮। ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসাটা শুরু সেখান থেকেই। টিম ডি লিডির বিদায়ের ঠিক ১০ বছর পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় ছেলে বাস ডি লিডির। মাত্র ১৮ বছর বয়সে ডাচ দলে অভিষেক হয় বাসের। স্বপ্নটা ছিল বাবার মতো হওয়ার। কিন্তু বাস হয়তো তখনো ভাবেননি, তার জন্য অপেক্ষা করছে আরও বড় কিছু। ‘হিরো’ থেকেও আরও অনেক বড় কিছু হতে পারেন তিনি।

বিশ্বকাপে ওঠার অঘোষিত ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল নেদারল্যান্ডস আর স্কটল্যান্ড। ইউরোপের দুই সহযোগী দেশ কঠিন পথটা পার করে এসেছে অনেক আগেই। জিম্বাবুয়ে-ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো দল ছিটকে গেছে বিশ্বকাপের লড়াই থেকে। স্কটল্যান্ডের জন্য সমীকরণটা বেশ সহজ, জিতলেই ভারতে টিকিট নিশ্চিত তাদের। কিন্তু নেদারল্যান্ডসকে যেতে হবে হিসাব–নিকাশের মধ্য দিয়ে। প্রথমে ব্যাট করে ২৭৮ রানের বিশাল টার্গেট ছুড়ে দেয় স্কটল্যান্ড। কিন্তু ডাচদের সেটা ৫০ ওভারে পূরণ করলে হবে না, রানরেটে স্কটল্যান্ডকে পারি দিতে হলে সেই লক্ষ্য পূরণ করতে হবে ৪৪ ওভারে! এ রকম অসম্ভব টার্গেট পূরণ করায় বেশ খ্যাতি আছে ডাচদের। ২০১৪ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের মাটিতে ১৪ ওভারে ১৯০ রান তাড়া করে বিশ্বকাপের সুপার টেনে জায়গা করে নিয়েছিল তারা। সে তুলনায় স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটা তাদের কাছে সহজই বটে। কিন্তু প্রথমেই ২ উইকেট হারিয়ে সহজ ম্যাচটা কঠিন করে ফেলল কমলা জার্সিধারীরা। ব্যাট হাতে নেমেই বাস ডি লিডি বুঝলেন, আজকের দিনটা শুধু তার জন্যই লেখা আছে। এ সুযোগ শত বছরে একবার আসে, এ সুযোগ হেলায় হাতছাড়া করার মতো নয়।

পাকিস্তানের ব্যাটিং লাইনআপকে চমকে দিয়েছেন ৪ উইকেট তুলে নিয়ে
ছবি: আইসিসি

৭২ রানে ২ উইকেটের পতন হওয়ার পর যখন বাস ডি লিডি নামলেন, তখনো দিল্লি অনেক দূর। আর যখন প্যাভিলিয়নে ফিরলেন, তখন দিল্লির ফ্লাইট শুধু ল্যান্ড করা বাকি। সেদিনের বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়েছেন একা। স্কটল্যান্ডের বোলিং লাইনআপের সামনে শুধু নিজের উইকেট বাঁচিয়েই খেলেননি, স্ট্রাইক রেটটাও রেখেছেন মানানসই। একদিকে যখন বাস ডি লিডি ব্যাট হাতে লড়াই করে যাচ্ছেন, অন্যদিকে একের পর এক ব্যাটসম্যান ফেরত যাচ্ছেন প্যাভিলিয়নে। ৯৬ বলে ১২৩ রান করে বাস ডি লিডি যখন প্যাভিলিয়নে ফিরলেন তখন নেদারল্যান্ডসের প্রয়োজন মাত্র ২ রান। ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরির সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বকাপের টিকিটটাও নিশ্চিত করেছেন তিনি। ১২ বছর পর নেদারল্যান্ডসকে পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্বকাপের মঞ্চে। এক ম্যাচে ৫ উইকেট আর শতরানের ইনিংস, এক দিনের ক্রিকেটে এমন রেকর্ড ছিল মাত্র তিনজনের। বাস ডি লিডি সেই ছোট্ট তালিকায় নিজের নামটাও যুক্ত করে নিলেন।

২৬ বছর আগে এই ভারতের মাটিতেই প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে এসেছিল ডাচরা। গত আড়াই দশকে বদলে গেছে ক্রিকেটের হালচাল, আবেগের থেকে সবার মনোযোগ এখন বেশি টাকার দিকেই। কিন্তু এত কিছুর পরও নেদারল্যান্ডসের অবস্থা খুব একটা বদলায়নি। হ্যাঁ, ক্রিকেট খেলতে এখন হয়তো এত যুদ্ধ করতে হয় না, পেশা হিসেবেও বেশ মানানসই। কিন্তু নিয়মিত খেলতে গেলে এখনো যুদ্ধ করতে হয় তাদের। এত বছর পরও সহযোগী দেশ হিসেবে তাদের লড়াইটা চলছেই। যে লড়াইটা শুরু করে গিয়েছিলেন ফ্র্যান্স ডি লিডি।

ইউরোপের ফুটবলপাগল দেশে ক্রিকেটের বিস্তার ঘটাতে পাগল ছিলেন ফ্র্যান্স। ক্রুইফ আর আয়াক্স যখন ফুটবলে বিশ্বজয় করে বেড়াচ্ছে, তখন ফ্র্যান্সিস বিভোর ছিলেন ক্রিকেটে। নেদারল্যান্ডসের প্রথম ক্রিকেট একাডেমিও গড়ে উঠেছে তার হাত ধরে। নিজের স্ত্রীকে খুঁজে পেয়েছেন এই ক্রিকেট মাঠ থেকেই। ভুরবার্গ ক্রিকেট ক্লাবের সূচনা হয়েছিল তাঁকে সঙ্গী করেই। সেই ক্লাবের মাটিতেই গড়ে উঠেছেন টিম ডি লিডি। যাঁর হাত ধরে প্রথমবারের মতো বিশ্বমঞ্চে পা রাখে নেদারল্যান্ডস। এরপর আরও দুবার কমলা জার্সিধারীদের বিশ্বমঞ্চে নিয়ে গেছেন তিনি। উপহার দিয়েছেন বিশ্বমঞ্চে প্রথম জয়। ১২ বছর পর সেই ডি লিডিই আবারও হয়ে উঠলেন ডাচদের ত্রাণকর্তা। খাদের কিনারা থেকে আবারও বিশ্বমঞ্চে তুলে আনলেন নেদারল্যান্ডসকে।

দাদা ফ্র্যান্স কখনো ব্যাট হাতে নামতে পারেননি, বাবা টিম ডি লিডি কখনো সেঞ্চুরি হাঁকাতে পারেননি। বাস ডি লিডি প্রতিদিনই যেন সবাইকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। তাই তো পাকিস্তানের ব্যাটিং লাইনআপকে চমকে দিয়ে যখন ৪ উইকেট তুলে নেন, কিংবা ভয়ংকর পেস বোলিং লাইনআপের সামনে ব্যাট হাতে একাই দাঁড়িয়ে যান। লড়াকু এক ৬৭ রানের ইনিংস ভীতি জাগিয়ে দেয় প্রতিটি পাকিস্তানি সমর্থকদের মনে, তখন হয়তো আকাশ থেকে মুচকি হাসেন ফ্র্যান্স। আনন্দে চক্ষু সজল হয়ে আসে টিমের। সহযোগী দেশগুলোর গল্প অনেকটা এ রকমই, দুঃখ-কষ্ট-আনন্দ-বেদনা সব মিশে থাকে একত্রে। কারও গল্প বাঁধা থাকে এক পরিবারের সূত্রে।