বিশ্বকাপের ১০ অধিনায়কের গল্প

চার বছর পর আবারও শুরু হয়েছে বিশ্বকাপ। কত আলোচনা, কত প্রতীক্ষা, কত স্বপ্ন এই বিশ্বকাপ ঘিরে। খেলার মাঠে নেমে পড়েছেন খেলোয়াড়েরা, তাঁদের সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবেন অধিনায়কেরা। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এক কেইন উইলিয়ামসন বাদে গত বিশ্বকাপে নেতৃত্ব দেওয়া কোনো অধিনায়কই এবার অধিনায়কত্ব করছেন না। সব দলই কমবেশি বদলে ফেলেছে নিজেদের। বদলে যাওয়া দলের বদলে যাওয়া অধিনায়কদের গল্পগুলো জেনে নেওয়া যাক একনজরে।

সাকিব আল হাসান (বাংলাদেশ)

বাংলাদেশের জান, বাংলাদেশের প্রাণ; সাকিব আল হাসান। তাঁকে নিয়ে যতই বলা হয়, শেষ যেন হয় না। অথচ এই বিশ্বকাপে সাকিবের অধিনায়কত্ব করার কথাই ছিল না। কিন্তু বিশ্বকাপের মাত্র দুই মাস আগে এক দিনের ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন অধিনায়ক তামিম ইকবাল। খেলোয়াড় তামিম ফিরলেও অধিনায়ক তামিম ফেরেননি। অগত্যা অধিনায়কের দায়িত্ব এসে পড়ে সাকিবের কাঁধে। ২০২৩ বিশ্বকাপের সবচেয়ে অভিজ্ঞ খেলোয়াড় এবং অধিনায়ক, দুটোই সাকিব আল হাসান। টানা চার বিশ্বকাপে খেলা ও এক বিশ্বকাপে অধিনায়কত্ব করার অভিজ্ঞতার পুরোটা ঢেলে দিয়ে দলকে সাজাবেন তিনি। গত বিশ্বকাপের মতো এই বিশ্বকাপেও বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের মতোই পারফরম্যান্স দেবেন, এমনটা শুধু সাকিবের কাছ থেকে আশা করা যায়।

রোহিত শর্মা (ভারত)

অভিজ্ঞতার দিক দিয়ে সাকিব আল হাসানের পরের অবস্থানেই থাকবেন রোহিত শর্মা। এক দিনের ক্রিকেটে তাঁর অভিষেক ২০০৭ সালে। লোয়ার মিডল অর্ডারে ক্যারিয়ার শুরু করা রোহিত এখন বিশ্বের সেরা ওপেনারদের একজন। নামের পাশে রয়েছে ১০ হাজার ওয়ানডে রান। ২০১১ সালে চোটের কারণে ভারতের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জয় তাঁকে দেখতে হয়েছে বাসায় বসে। ১২ বছরের ব্যবধানে তাঁর সামনে সুবর্ণ সুযোগ সেই আক্ষেপ পূরণ করার। অধিনায়ক হিসেবে ১৪১ কোটি মানুষের ভারটাও এবার যে তার কাঁধেই।

বাবর আজম (পাকিস্তান)

অভিজ্ঞতার দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকলেও ব্যাট হাতে বর্তমানে বাবর আজমের সমকক্ষ নেই কেউ। বর্তমান ওয়ানডে ক্রিকেটের সেরা ব্যাটসম্যানের হাতেই রয়েছে পাকিস্তানের অধিনায়কত্ব। যদিও এশিয়া কাপে আশানুরূপ পারফরম্যান্স করতে পারেননি বটে, কিন্তু দল হিসেবে পাকিস্তানকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। তাঁর অধিনায়কত্বেই ৩৩ বছর পর ওয়ানডে ক্রিকেট র৵াঙ্কিংয়ে শীর্ষে উঠে এসেছিল পাকিস্তান। যদিও নিয়মিতই তাঁর অধিনায়কত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে মিডিয়ায়, কিন্তু ব্যাট হাতে সব সমালোচনার মোক্ষম জবাব দিয়ে দেন তিনি। বিশ্বকাপে তাঁকে নিয়ে বড় কিছুর স্বপ্ন দেখা নিশ্চয় ভুল কিছু হবে না।

প্যাট কামিন্স (অস্ট্রেলিয়া)

এবারের বিশ্বকাপের প্রতিটি অধিনায়কের অধিনায়কত্ব নিয়ে কমবেশি জল ঘোলা হয়েছে। প্যাট কামিন্সও তার বিপরীতে নন। কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে টিম পেইনের বিদায়ের পর টেস্ট দলের অধিনায়কত্ব পান কামিন্স। অতঃপর সাদা বলের ক্রিকেট থেকে অ্যারন ফিঞ্চের অবসরের পর ওয়ানডেতেও অধিনায়কত্ব পান তিনি। অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের প্রথম পেস বোলিং অধিনায়ক তিনি। দায়িত্ব পাওয়ার এক বছর পার হয়ে গেলেও মাত্র দুই ম্যাচে দলকে নেতৃত্ব দিতে পেরেছেন তিনি। চোট আর পারিবারিক কারণে সেই দায়িত্ব পালন করেছেন স্মিথ, মার্শরাই। বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া সমর্থকদের দুশ্চিন্তা তাই অধিনায়ক প্যাট কামিন্স।

কেইন উইলিয়ামসন (নিউজিল্যান্ড)

গত বিশ্বকাপ থেকে টিকে থাকা একমাত্র অধিনায়কের নাম কেইন উইলিয়ামসন। যদিও তাঁকে পাওয়া না–পাওয়া নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় ছিল নিউজিল্যান্ড। বছরের শুরুতে আইপিএল খেলতে গিয়ে বেশ বড় সময়ের জন্য মাঠের বাইরে চলে যান উইলিয়ামসন। চিকিৎসকেরা উইলিয়ামসনের বিশ্বকাপ–স্বপ্নকে বিদায় দিতে বলেছিলেন। কিন্তু কঠোর পরিশ্রম করে বিশ্বকাপের আগেই সুস্থ হয়েছেন তিনি। ট্রেনিংয়ে ফিরেছেন, নিজের স্বাভাবিক খেলাটাও খেলতে পারছেন। তাঁকে নিয়েই ভারত বিশ্বকাপে পাড়ি দিচ্ছে গত দুবারের রানার্সআপ কিউইরা।

দাসুন শানাকা (শ্রীলঙ্কা)

একটা সময় বিশ্বকাপে সুযোগ পাওয়াই অনিশ্চিত ছিল শ্রীলঙ্কার। অভিজ্ঞ তারকাদের বিদায়ের পর তরুণ দল নিয়ে অনেকটা সময় ধরে খাবি খাচ্ছিল শ্রীলঙ্কা দল। সেই খাদের কিনারা থেকে দলকে তুলে এনেছেন অধিনায়ক দাসুন শানাকা। ২০২১ সালে অধিনায়কের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই তরুণদের ওপর ভরসা রেখেছেন তিনি। প্রথমে ধাক্কা খেলেও বর্তমান শ্রীলঙ্কা দলকে সমীহ করে চলে সবাই। এশিয়া কাপে ভারতের কাছে হারার আগে টানা ১৩ ম্যাচ অপরাজিতও ছিল তাঁরা। ব্যাটে-বলে সেখানে সমান ভূমিকা রেখেছেন অধিনায়ক শানাকা। যদিও এশিয়া কাপ ফাইনালে লজ্জাজনক পরাজয় বরণ করতে হয়েছে তাঁদের। তবে পূর্ণশক্তির দল নিয়ে নামলে শ্রীলঙ্কাকে ভয় পেতে বাধ্য যে কেউ।

টেম্বা বাভুমা (দক্ষিণ আফ্রিকা)

সময়টা ২০২১ সাল, বর্ণবাদ নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় তখন টালমাটাল অবস্থা। এমন অবস্থায় ওয়ানডে দলের অধিনায়কের দায়িত্ব থেকে কুইন্টন ডি কককে সরিয়ে তা তুলে দেওয়া হয় টেম্বা বাভুমার হাতে। বাভুমা তত দিনে দক্ষিণ আফ্রিকার জার্সি গায়ে মাঠে নেমেছেন মাত্র ১৩ ম্যাচ। অনভিজ্ঞ এক খেলোয়াড়ের হাতে অধিনায়কত্ব তুলে দিয়ে যেন পরিস্থিতি সামাল দিতে চেয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট বোর্ড। বাভুমা ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অধিনায়ক। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্নের তিরও এসেছিল তাঁর দিকে। কিন্তু আস্তে আস্তে সব সমালোচনা পাশ কাটিয়ে নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করেছেন দলে।

জস বাটলার (ইংল্যান্ড)

গত বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক ছিলেন জস বাটলার। শেষ বলে রানআউট করে প্রথমবারের মতো ঘরে তুলেছিলেন বিশ্বকাপের শিরোপা। সে দলের সহ-অধিনায়ক ছিলেন বাটলার। বিশ্বকাপ জেতানোর কিছুদিন পরই ক্রিকেটকে বিদায় বলে দেন এউইন মরগান। তাঁর রেখে যাওয়া জায়গাটা বেশ ভালোভাবেই পূরণ করেছেন বাটলার। তাঁর অধীন ২০২২ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছে ইংল্যান্ড। ওয়ানডেতেও তাঁদের আক্রমণাত্মক ক্রিকেট এখনো ব্যর্থতার মুখ দেখেনি

স্কট এডওয়ার্ডস (নেদারল্যান্ডস)

এবারের বিশ্বকাপের সারপ্রাইজ প্যাকেজের নাম নেদারল্যান্ডস। বাছাইপর্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আয়ারল্যান্ডকে হারিয়ে বিশ্বকাপে জায়গা করে নেবে নেদারল্যান্ডস—এমনটা স্বপ্নেও ভাবেননি অনেকে। তাদের এত দূর এনেছেন অধিনায়ক-উইকেটকিপার স্কট এডওয়ার্ডস। এডওয়ার্ডসের বেড়ে ওঠা অস্ট্রেলিয়ায়। নানির সূত্রে নেদারল্যান্ডসের নাগরিকত্ব পেয়েছেন তিনি। ২০১৮ সালে নেদারল্যান্ডসের হয়ে অভিষেক হয় তাঁর। ২০২২ সালে চোটের কারণে অধিনায়ক পিটার সিলার অবসর নিলে অধিনায়কের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় স্কট এডওয়ার্ডসের কাঁধে। বিশ্বকাপে বাছাইপর্বে নেদারল্যান্ডস রূপকথার রূপকার ছিলেন তিনিই।

হাশমতউল্লাহ শহীদি (আফগানিস্তান)

হাশমতউল্লাহ শহীদির অধিনায়কত্ব পাওয়ার গল্পটাও অধিকাংশ অধিনায়কের মতো বেশ ঘোলাটে। আফগানিস্তানের উত্থানের সময় থেকেই দলের অংশ শহীদি। তবে বেশির ভাগ সময়ই তিনি ছিলেন যাওয়া-আসার মধ্যে। তবে ২০২১ সালে বোর্ডের সঙ্গে দ্বন্দ্বে রশিদ খান অধিনায়কত্ব ছাড়লে দায়িত্ব এসে পড়ে হাশমতউল্লাহ শহীদির ওপর। এখন পর্যন্ত তাঁর কাঁধেই আছে আফগানিস্তানের দায়িত্ব।

১০ অধিনায়কের গল্প তো শুনলে। ১৯ নভেম্বর কার হাতে উঠবে বিশ্বকাপ, সেটাই এখন দেখার পালা।