আবার ছড়াবে ফরাসি সৌরভ?

ফুটবল বিশ্বকাপ শুরুর সময়টায় সবচেয়ে শক্তিশালী দল ছিল উরুগুয়ে আর ইতালি। এর মধ্যে ইতালি আটলান্টিক মহাসাগরের বিশাল দূরত্ব পার হতে চায়নি দেখে অংশ নেয়নি ১৯৩০-এর বিশ্বকাপে। এর প্রতিবাদে ১৯৩৪ আর ১৯৩৮-এর বিশ্বকাপ বর্জন করে উরুগুয়ে। ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার মতোই পরপর দুটি বিশ্বকাপ জিতে নেয় ইতালি। তারপর ১৯৫৮ আর ১৯৬২-এর বিশ্বকাপে পেলে, গারিঞ্জা, ভাভা সান্তোসদের ব্রাজিল বিশ্বকাপ জিতে পরপর দুইবার। টানা বিশ্বকাপ জেতার ইতিহাস সেখানেই শেষ। এর পুনরাবৃত্তি করতে পারেনি ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা অথবা রোনালদোর ব্রাজিল। কিন্তু ২০২২ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালের সামনে দাঁড়িয়ে যে ৬০ বছর পর আবার ইতিহাসের এই হারিয়ে যাওয়া পাতা খোলার প্রবল সম্ভাবনা, আর ইতিহাসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা দলটির নাম ফ্রান্স।

বিশ্বকাপ শুরুর আগে ফ্রান্সের সম্ভাব্য স্কোয়াডের প্রায় অর্ধেক ইনজুরির শিকার, তার ওপর নেই ব্যালন ডি’অরজয়ী তারকা করিম বেনজেমা। অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন, আগের তিন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের মতো প্রথম রাউন্ড থেকেই হয়তোবা বিদায় নিবে ফ্রান্স। কিন্তু কিসের কী! দ্বিতীয় সারির দল নামিয়ে তিউনিসিয়ার বিপক্ষে হারটা বাদ দিলে সেমিফাইনালে উঠেছে তারা প্রবল বিক্রমে।

ফ্রান্সের গত বিশ্বকাপ আর এই বিশ্বকাপের পারফরম্যান্সের পার্থক্য খোঁজার জন্য ফ্রান্সের এ বিশ্বকাপের গ্রুপের দিকে তাকানোই যথেষ্ট। এবারের গ্রুপসঙ্গী ডেনমার্ক আর অস্ট্রেলিয়া যে তাদের গ্রুপে ছিল গত বিশ্বকাপেও। হট ফেবারিট হয়ে বিশ্বকাপে গেলেও প্রথম ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে তারা জিতে গ্রিজমানের পেনাল্টি আর এক আত্মঘাতী গোলের সুবাদে। দ্বিতীয় ম্যাচে পেরুর সঙ্গে এক গোলে জয়ের পর শেষ ম্যাচে ডেনমার্কের সঙ্গে গোলশূন্য ড্র; অর্থাৎ বলা যায়, বিশ্বকাপ যত সামনে এগিয়েছে, ফ্রান্স তত ক্ষুরধার হয়েছে। আর এবার তো তারা বিশ্বকাপ শুরুই করল অস্ট্রেলিয়াকে চার গোল দিয়ে। টুর্নামেন্টের ‘ডার্ক হর্স’খ্যাত ডেনমার্ককে হারানোর পর তিউনিসিয়ার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় সারির দলের পরাজয়। আগের বিশ্বকাপের পুরো প্রথম রাউন্ডে তিন গোল দেওয়া ফ্রান্স এবার সেটা অতিক্রম করেছে প্রথম ম্যাচেই।

এই বিশ্বকাপে চমক ফ্রান্সের স্ট্রাইকার অলিভিয়ের জিরু

বিশ্বকাপের সেমিফাইনালের বাকি তিন দলের মধ্যে ক্রোয়েশিয়া দুই ম্যাচ জিতেছে পেনাল্টিতে, মরক্কো আর আর্জেন্টিনা এক ম্যাচ করে সেই ভাগ্য বরণ করেছে, শুধু ব্যতিক্রম ফ্রান্স, সেমিফাইনালে উঠতে নকআউটের কোনো ম্যাচেই অতিরিক্ত সময় পর্যন্ত খেলতে হয়নি ফ্রান্সের। গত বিশ্বকাপেও কিন্তু বিশ্বকাপ জেতার পথে একইভাবে সব খেলা অতিরিক্ত সময়ের আগেই শেষ করেছিল ফ্রান্স। এক বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর পরের বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল, এমন দৃশ্যই দেখা গিয়েছিল সর্বশেষ ১৯৯৮ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের সৌজন্যে।

ফ্রান্স বিশ্বকাপে ভালো করলে এমবাপ্পে অসাধারণ করবেন, সেটা তো জানা কথা। তবে এই বিশ্বকাপে চমক ফ্রান্সের স্ট্রাইকার অলিভিয়ের জিরু। গত বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন দলের মূল স্ট্রাইকার হয়েও বিশ্বকাপে শূন্য গোল, এটি নিয়ে নেট দুনিয়ায় কত ট্রল। বেনজেমা ইনজুরিমুক্ত থাকলে এ বিশ্বকাপে যেখানে মূল দলে খেলাই হতো না তাঁর, সেখানে এই বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনি। ৩৬ বছর বয়সী এই স্ট্রাইকার নায়ক বনে গেছেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জয়সূচক গোল করে। এমবাপ্পে, জিরুর সঙ্গে গ্রিজমানের নৈপুণ্যে এই বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত ১১ গোল ফ্রান্সের। তাদের চেয়ে বেশি গোল করা ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেওয়াতে ফ্রান্সের সামনে তাই সুযোগ আছে গত বিশ্বকাপের মতোই এবারের আসরের সর্বোচ্চ গোল করার।

ফ্রান্স টিমের মধ্য মাঠে জুটি বাঁধবেন রিয়াল মাদ্রিদের জোড়া শুয়ামেনি আর কামাভিঙ্গা

২০১৮ সালে ফ্রান্সের সাফল্যের অন্যতম কারণ হিসেবে ধরা হয় পগবা আর এনগোলো কান্তের মিডফিল্ড জুটিকে। চোটগ্রস্ত ফ্রান্স দলে এবার নেই দুজনের কেউ। ধারণা করা হয়েছিল, এবার ফ্রান্স টিমের মধ্য মাঠে জুটি বাঁধবেন রিয়াল মাদ্রিদের জোড়া শুয়ামেনি আর কামাভিঙ্গা। কামাভিঙ্গা দলে নিয়মিত না খেললেও নিয়মিত খেলছেন বিশ্বকাপে জিরুর মতোই আরেক চমক আদ্রিয়েন র‍্যাবিওট। বিশ্বকাপের আগে অনেক ফুটবল-বিশ্লেষকের মতেই বাতিল হয়ে যাওয়া র‍্যাবিওট এবার ফ্রান্স দলের অন্যতম সেরা পারফরমার। বিশেষ করে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হেন্ডারসন, বেলিংহাম যে সুবিধা করতে পারেননি, সেটার অনেকখানি কৃতিত্বই র‍্যাবিওটের।

ফ্রান্সের রক্ষণভাগে বটবৃক্ষ দুই অভিজ্ঞতাসম্পন্ন তারকা রাফায়েল ভারান আর গোলরক্ষক হুগো লরিস। সঙ্গে ভারানের সহযোগী হিসেবে মধ্যে থাকে উপামেনাকো। দুই ফুলব্যাক হিসেবে আছেন থিও হার্নান্দেজ আর জুলস কুন্দে। বলা যায়, এই বিশ্বকাপে ফ্রান্স দলের মূল চালিকা শক্তি অভিজ্ঞতার সঙ্গে তারুণ্যের মেলবন্ধন।

গোল্ডেন বুট আর গোল্ডেন বলের মধ্যে একটি পাবেন এমবাপ্পে, এটা অনেকটা নিশ্চিত

গত বিশ্বকাপে পেলের পর মাত্র দ্বিতীয় টিনেজার হিসেবে বিশ্বকাপ ফাইনালে গোল করেন এমবাপ্পে। এবার তিনি ভেঙে দিয়েছেন ২৪ বছর বয়সের আগে বিশ্বকাপে পেলের গোল করার রেকর্ড। বিশ্বকাপ শেষ দুই রাউন্ডে কোনো খেলোয়াড় অসাধারণ কিছু করে না বসলে গোল্ডেন বুট আর গোল্ডেন বলের মধ্যে একটি পাবেন, এটা অনেকটা নিশ্চিত। কে জানে, বিশ্বকাপটা জিতে গেলে হয়তোবা দুটিই জিতে যেতে পারেন তিনি। সেমিফাইনালে যতই প্রতিপক্ষ হোক বিপক্ষের খেলোয়াড় দ্বারা এখন পর্যন্ত একটিও গোল হজম না করা মরক্কো, একের পর এক প্রতিপক্ষকে গুঁড়িয়ে দেওয়া এমবাপ্পে, জিরু, গ্রিজমানের সঙ্গে কি তারা পেরে উঠবে? নাকি ছয় দশক পর বিশ্ব আবার দেখবে পরপর দুইবার বিশ্বকাপ জেতা কোনো দলকে?