শুরু হয়ে গেছে ফুটবল বিশ্বকাপ। কাতার বনাম ইকুয়েডরের খেলার মধ্য দিয়ে পর্দা উঠেছে বিশ্বকাপের ২২তম আসরের। ফুটবল খেলার বিভিন্ন নিয়মকানুন অনুযায়ী রেফারি যেন সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, সে জন্য এবারের বিশ্বকাপে ফিফা নিয়ে এসেছে অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তি।
ফুটবলে প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে বেশ কয়েক বছর ধরেই। রাশিয়াতে অনুষ্ঠিত ২০১৮ বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো গোললাইন প্রযুক্তি এবং ‘ভার্চ্যুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি’ বা ‘ভিএআর’ নিয়ে আসে ফিফা। কিন্তু এসব প্রযুক্তি থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় রেফারির সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেন না দর্শকেরা। অনলাইন বা অফলাইনে নিজেদের মধ্যে মেতে ওঠেন তর্কে। এর পেছনের কারণটা মূলত খেলার বিভিন্ন নিয়ম সম্পর্কে সঠিকভাবে না জানা। আজকে ফুটবল খেলার এমনই সাধারণ দুটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করব, যা নিয়ে ফুটবলপ্রেমীদের মধ্যে বিভ্রান্তি দেখা দেয় এখনো। সেগুলো হলো ফাউল ও অফসাইড।
অফসাইড নিয়ে হরহামেশাই ভুল–বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। প্রায়ই রেফারি এই নিয়মকে নিজের মতো করে বুঝে নিয়ে সিদ্ধান্ত দেন, যা মেনে নিতে পারেন না অনেকে। পাশাপাশি অফসাইডের নিয়মও বদলেছে অনেকবার। ফলে বিভ্রান্তি বাড়ে আরও বেশি, কারণ নিয়মটির অনেক সূক্ষ্ম বদলও নাটকীয়ভাবে মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে যেকোনো ম্যাচের। আজকে বিশদভাবে আলোচনা করা হবে নিয়মটি নিয়ে।
অফসাইড নিয়মটা আসলে কী
একজন খেলোয়াড়কে অফসাইড বলে ধরে নেয়া হবে তখনই, যখন তাকে পাস দেয়ার সময় তার সামনে গোলকীপার ছাড়া প্রতিপক্ষের কোনো খেলোয়াড় থাকবে না।
এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে,
মাথা, শরীর এবং পা অফসাইডের আওতাভুক্ত, হাত নয়। কোনো খেলোয়াড়কে পাস দেওয়ার সময় হাত বাদে তার বাকি তিনটি অঙ্গ যদি বিপক্ষ দলের শেষ খেলোয়াড়ের থেকে সামনে এগিয়ে যায়, তাহলেই সেটিকে অফসাইড বলে ধরে নেওয়া হবে। শুধু হাত যদি সামনে থাকে, তাহলে অফসাইড হবে না।
অফসাইড হওয়ার জন্য কোনো খেলোয়াড়কে অবশ্যই প্রতিপক্ষের অংশে থাকতে হবে। প্রতিপক্ষের সব খেলোয়াড় যদি কোনো খেলোয়াড়ের নিজের অংশে থাকে, তাহলে তিনি পাস নেওয়ার সময় তাদের থেকে সামনে এগিয়ে থাকলেও অফসাইড হবেন না।
একজন খেলোয়াড় তখনই অফসাইড হবেন, পাস দেওয়ার যখন তার সামনে কেউ থাকবে না। সামনে না থেকে এক লাইনে থাকলেও অনসাইড হিসেবে ধরে নেওয়া হবে।
কর্ণার, গোলকিক ও থ্রো-ইন অফসাইডের আওতাধীন নয়। মানে, গোলকীক, থ্রো-ইন ও কর্ণার থেকে বল নেওয়ার সময় কোনো খেলোয়াড় যত ইচ্ছা সামনে এগিয়ে থাকতে পারবেন।
অফসাইডের মারপ্যাঁচ
ভালোভাবে নিয়ম জানার পরও অফসাইড নিয়ে বেশ জটিল কিছু পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় অনেক সময়। একজন খেলোয়াড় তখনই অফসাইড হবেন, যখন তাঁর দলের কেউ পাস দেওয়ার সময় তিনি কোনো না কোনোভাবে খেলার সঙ্গে যুক্ত থাকেন। ধরা যাক, একজন খেলোয়াড় অফসাইড পজিশনে দাঁড়িয়ে আছেন। এ অবস্থায় তাঁর দিকে পাস না দিয়ে যদি অনসাইডে থাকা অন্য কোনো খেলোয়াড়ের দিকে বল পাস দেওয়া হয়, তাহলে কিন্তু অফসাইড হবে না। কিন্তু ঘটনাটি যদি এমন হয়, অফসাইডে থাকা কোনো খেলোয়াড় বল পাস না পেয়েও যদি অন্যভাবে খেলায় প্রভাব রাখেন, তাহলে আবার রেফারি অফসাইড দিয়ে বসবেন। দেখা গেল, অফসাইডে থাকা খেলোয়াড়টিকে বল পাস দেওয়া না হলেও তাঁর কারণে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড় বা গোলকিপার যদি বলের কাছে যেতে না পারেন বা বল দেখতে না পারেন, তাহলে তাঁকে অফসাইড বলে ধরে নেওয়া হবে। বল না পেলেও অফসাইড পজিশনে থেকে নিজের দলকে সুবিধা করে দেওয়ার কারণে এখানে অফসাইডের সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়ে থাকে।
নিচের ছবিগুলো দেখলে বুঝতে পারবে, কোন পজিশনটি অফসাইড এবং কোনটি অনসাইড।
এই পজিশনে খেলোয়াড় A অফসাইড পজিশনে আছে। লক্ষ করো, যখন খেলোয়াড় B বল পাস দিচ্ছে, তখন A প্রতিপক্ষের অংশে প্রতিপক্ষের সব খেলোয়াড়ের থেকে সামনে এগিয়ে আছে। সামনে গোলকিপার থাকলেও, গোলকিপার যেহেতু অফসাইডের আওতাভুক্ত নয়, A খেলোয়াড়টিকে অফসাইড বলে ধরে নেওয়া হবে।
আবার এই ছবিতে, B যখন A–কে বল পাস দিচ্ছে, তখন গোলকিপার ছাড়াও প্রতিপক্ষের আরও একজন খেলোয়াড় A–এর সামনে থাকায় পজিশনটি অনসাইড।
রেফারি যখন অফসাইডের ঘোষণা দেন, তখন অফসাইড পজিশনে থাকা খেলোয়াড়ের বিপরীত দল একটি ফ্রি–কিক লাভ করে।
বিশ্বকাপ ফুটবলে নতুন প্রযুক্তি
প্রতি বিশ্বকাপেই নতুন নতুন সব প্রযুক্তি নিয়ে আসে ফিফা। গত বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো প্রয়োগ করা হয় ‘ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি’ বা ‘ভিএআর’। নতুন প্রযুক্তি নিয়ে আসা হয়েছে এ বিশ্বকাপেও। এত দিন পর্যন্ত অফসাইড বোঝার জন্য রেফারি নির্ভর করতেন সহকারীদের ওপর। সহকারী রেফারিরা এত দিন খালি চোখে দেখেই অফসাইডের সিদ্ধান্ত দিতেন। গত বিশ্বকাপে ভিএআর আসার পরে রেফারিদের কষ্ট খানিকটা কমে যায়। তবে ভিএআর এলেও অফসাইডের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক থেকেই যায়।
বিতর্ক পুরোপুরি দূর করতে এ বিশ্বকাপে প্রয়োগ করা হয়েছে ‘সেমি-অটোমেটেড অফসাইড টেকনোলজি’। নতুন এই প্রযুক্তি কাজ করবে দুটি ভিন্ন প্রযুক্তির মাধ্যমে। এর মধ্যে একটি হলো ‘লিম্ব ট্র্যাকিং টেকনোলজি’। এর মাধ্যমে খেলার পুরোটা সময় খেলোয়াড়দের শরীরের গতিবিধির ওপর নজর রাখা হবে। ১২টি ক্যামেরার মাধ্যমে প্রত্যেক খেলোয়াড়ের শরীরের ২৯টি অংশ থেকে সেকেন্ডে ৫০ বার ডেটা সংগ্রহ করা হবে, যেন মাঠে খেলোয়াড়দের সঠিক অবস্থান জানা যায়। পাশাপাশি বিশ্বকাপের এবারের বল ‘আল রিহালা’র মধ্যে রাখা হয়েছে বিশেষ সেন্সর। ঠিক কোন মুহূর্তে বলকে লাথি মারা হয়েছে, তা সঠিকভাবে জানার জন্যই এই সেন্সর।