টিভি পর্দায় প্রথম বিশ্বকাপ

১৯৫৪ বিশ্বকাপের পোস্টার

বিশ্বকাপ শব্দটার অর্থ যতই বড়ই হোক না কেন, ১৯৫৪ সালের আগপর্যন্ত ফিফার কাছে শব্দটা ছিল আতঙ্কের মতো। প্রতিবারই বিশ্বকাপের সময় ঘনিয়ে আসে আর ফিফা অফিশিয়ালদের মনে জেগে ওঠে অজানা এক শঙ্কা। সমস্যা যেন প্রতিশব্দ হয়ে উঠেছিল বিশ্বকাপের। বিশ্বকাপের পঞ্চম আসরে এসে প্রথমবারের মতো নির্ঝঞ্ঝাট এক বিশ্বকাপের আয়োজন সম্পন্ন করল ফুটবলেরর সর্বোচ্চ সংগঠন।

১৯৪৬ সালের ফিফা কংগ্রেসে একই সঙ্গে দুই বিশ্বকাপ আয়োজকের নাম ঘোষণা করেছিল ফিফা। ব্রাজিলের মতো ১৯৫৪ বিশ্বকাপ কোনো প্রতিযোগিতা ছাড়াই বাগিয়ে নিয়েছিল সুইজারল্যান্ড। ইউরোপ থেকে বিশ্বকাপ আয়োজন করার মতো সামর্থ্য একমাত্র তাদেরই ছিল। বিশ্বযুদ্ধ শেষে পুরো ইউরোপের অবস্থা নাজুক হলেও সে আঁচ লাগেনি সুইসদের গায়ে। নিরপেক্ষ অবস্থান আর পাহাড়ি অঞ্চলের কারণে তাদের যেমন কেউ আক্রমণ করেনি, তারা কাউকে আক্রমণ করেনি। পুরো বিশ্বযুদ্ধকে একরকম পাশ কাটিয়ে গেছে সুইজারল্যান্ড। ইউরোপে বিশ্বকাপ ফেরানোর জন্য সুইজারল্যান্ডই ছিল আদর্শ ভেন্যু।

১৯৫৪ বিশ্বকাপ দিয়ে নতুন যুগে পদার্পণ করে বিশ্বকাপ। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ সম্প্রচার করা শুরু হয় টেলিভিশনে। আগে প্রতি মিনিটের খবর জানতে মানুষ কান পেতে রাখত রেডিওতে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অক্ষশক্তির ওপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিল, তা উঠিয়ে নেয় ফিফা। নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে বিশ্বকাপে ফেরে পশ্চিম জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও চেকোস্লোভাকিয়া। প্রথমবারের মতো ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ইউরোপিয়ান কোনো বিশ্বকাপে অংশ নেয় উরুগুয়ে। আর স্বাগতিক দেশ হিসেবে অংশ নেয় সুইজারল্যান্ড। বাছাইপর্বের ৪২ দল থেকে চূড়ান্ত করা হয় ১৪ দল। সেই সঙ্গে বিশ্বকাপ মুখোমুখি হয় তার প্রথম অঘটনের। বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে বাদ পরে গতবারের সেমিফাইনালিস্ট দুই দল স্পেন ও সুইডেন। তাদের বাদ দিয়েই শুরু হয় বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব।

ফরম্যাট থাকে আগের মতোই। কিন্তু ১৬ দল হওয়ায় বিশ্বকাপের পূর্ণাঙ্গ আনন্দ পাওয়া যায় এই আসরে। চারটি গ্রুপ, চার গ্রুপের শীর্ষ দুই দল নিয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল। শেষ আট থেকেই শুরু হয় নকআউট পর্ব। বিশ্বকাপের আদর্শ ফরম্যাট যাকে বলে।

ফরম্যাট অনুযায়ী ভাগ করলে কী হবে, বিশ্বকাপ যে হাঙ্গেরির সেটা নিয়ে বিন্দুমাত্র দ্বিধা ছিল না ফুটবলবাসীদের। হাঙ্গেরি তখন একেবারে অজেয়। এমন কোনো দল নেই, যাদের নাকানিচুবানি খাওয়ায়নি তারা। এমন কোনো রেকর্ড নেই, যা ভাঙেনি তারা। এককথায়, সুইজারল্যান্ড বিশ্বকাপ আয়োজনই হয়েছিল শিরোপা হাঙ্গেরির হাতে তুলে দেওয়া জন্য।

১৯৫২ অলিম্পিকে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন, বিশ্বকাপের আগে টানা ২৮ ম্যাচে জয়। কোচ গুস্তাভ সেভেসের ম্যাজিক্যাল ম্যাগিয়ার্সকে থামানোর ফন্দি জানা ছিল না কারোরই। পুসকাস-ককসিচদের মতবাদ ছিল একটাই—গোল যতগুলো হজম করব, তার থেকে বেশি গোল দেব।

অব্যর্থ এই মতবাদের ফলাফল দেখা গেল বিশ্বকাপ আসতে না আসতেই। ৯-০, ৮-৩, ৪-২, ৪-২! বিশ্বকাপের প্রথম চার ম্যাচে এই ছিল হাঙ্গেরির গোললাইন। গোলমুখে ককসিচ, পুসকাসদের থামানোর সাধ্য ছিল না কারও। অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হিসেবে বার্নে এক পা দিয়েই রেখেছিল হাঙ্গেরি। ফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ ছিল পশ্চিম জার্মানি। সেই পশ্চিম জার্মানি, গ্রুপ পর্বে যাদের ৮-৩ গোলে হারিয়ে উৎসব করেছিল পুসকাসরা। গত চার বছরে যাদের কেউ থামাতে পারেনি, তাদের কাছ থেকে বিশ্বকাপ ছিনিয়ে নেবে এমন সাধ্য কার?

একদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত, পেশাদার ফুটবলের অভিজ্ঞতাহীন পশ্চিম জার্মানি অন্যদিকে টানা ৩২ ম্যাচ জেতার অভিজ্ঞতা নিয়ে ফাইনালে আসা হাঙ্গেরি। অসম এক লড়াই দেখতেই সুইজারল্যান্ডের বার্নে হাজির হয়েছিলেন ৬৩ হাজার মানুষ। তাদের জন্য গোলের পসরাও সাজিয়ে বসেছিলেন পুসকাস। প্রথম ৮ মিনিটেই ২-০ গোলে এগিয়ে যায় হাঙ্গেরি। পরের ১০ মিনিটে তা শোধও করে ফেলে জার্মানরা। ২০ মিনিটেই গোললাইন দাঁড়ায় ২-২-এ। 

হেলমুট রানের গোলে এগিয়ে যায় জার্মানি

অবশেষে ম্যাচের ৮৪ মিনিটে এসে ভাগ্যের শিকে ছেঁড়ে পশ্চিম জার্মানির। হেলমুট রানের গোলে এগিয়ে যায় পশ্চিম জার্মানি। যদিও ২ মিনিটের মধ্যেই সেই গোল ফেরত দেন পুসকাস। কিন্তু তা মানতে নারাজ ছিলেন রেফারি। বরং লাইন্সম্যানের সঙ্গে আলোচনা করে অফসাইড ট্যাগ দিয়ে বাতিল করেন সে গোল। রেফারি হয়তো ভুলেই গিয়েছিলেন টিভি পর্দায় সরাসরি দেখানো হচ্ছে এ ম্যাচ। নিশ্চিত গোলকে অফসাইড বলে বাতিল করায় তখনই সমালোচনার ঝড় বয়ে যায় রেফারিই ওপর দিয়ে। ম্যাচে বাকি ৪ মিনিটে আর কিছুই করতে পারেনি হাঙ্গেরি। ১৯৫৪ বিশ্বকাপ শেষ হয় হাঙ্গেরির পরাজয় আর এক ‘মিরাকল অব বার্ন’ দিয়ে।

বার্নে সেদিন শুধু রেফারি নয়, অনেক কিছুই ছিল হাঙ্গেরির বিপক্ষে। ম্যাচের আগে বৃষ্টিতে মাঠ হয়ে পড়েছিল খেলার অনুপযুক্ত। হাঙ্গেরি খেলতে না চাইলেও জোর করে ফাইনালে তাদের মাঠে নামায় ফিফা। এমনকি দাবি উঠেছিল, ম্যাচের হাফটাইমে শরীরে অতিরিক্ত ‘ভিটামিন সি’ পুশ করেছিল জার্মান দল। যা ছিল সে সময়কার নিষিদ্ধ ড্রাগ। যত দিনে প্রমাণ পাওয়া গেছে তত দিনে দুই দেশের ফুটবল মোড় নিয়েছে দুই দিকে।

‘মিরাকল অব বার্ন’ পশ্চিম জার্মানিকে দেখিয়েছিল বিশ্ব ফুটবলে নতুন আশা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সব তির যখন তাদের দিকেই ধেয়ে এসেছে, তখন ফুটবলেই প্রশান্তি খুঁজে নিয়েছিল জার্মানরা। গোড়াপত্তন হয়েছিল বুন্দেসলিগার, বিশ্ব না পারলেও বিশ্ব ফুটবলে শুরু হয়েছিল জার্মান শাসনকাল।

১৯৫৪ বিশ্বকাপের শিরোপা জিতে নেয় পশ্চিম জার্মানি

মুদ্রার অন্য পিঠে থমকে গিয়েছিল হাঙ্গেরির স্বপ্নযাত্রা। ম্যাজিক্যাল ম্যাগিয়ার্সের মুখ থুবড়ে পড়া একপ্রকার স্তিমিত করে দিয়েছিল হাঙ্গেরির ফুটবল–যাত্রা। সময়মতো একটি শিরোপার জোগান দিতে না পারায় নিজেদের ফুটবলকে আর এগিয়ে নিতে পারেনি তারা।

পরপর দুই বিশ্বকাপে ‘মারাকানজো’ আর ‘মিরাকল অব বার্ন’ ফুটবলকে ঠেলে দিয়েছিল নিজেদের সর্বোচ্চ উচ্চতায়। যে ভিত্তিতে আজও দাঁড়িয়ে আছে আন্তর্জাতিক ফুটবল।