ভঙ্গুর বার্সা যেভাবে জিতল ট্রেবল

‘গাধা দিয়ে হালচাষ করা আর বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে শিরোপা জেতা, দুটোই সমান। কারণ জীবনেও সম্ভব না।’ ১৯৯৫-৯৬ মৌসুম শুরুর আগে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনকে নিয়ে এমন একটা কথা বলেছিলেন লিভারপুল ডিফেন্ডার অ্যালান হানসেন। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ক্লাস অব ‘৯২ কে কটাক্ষ করেই কথাগুলো বলেছিলেন হানসেন। স্যার অ্যালেক্স উত্তর দিয়েছিলেন লিভারপুল থেকে ১১ পয়েন্ট ওপরে থেকে, নিজের তৃতীয় প্রিমিয়ার লিগ টাইটেল জিতে।

ভাবছো ২ দশক আগের কথা কেন এখন টেনে আনছি? কারণ এ মৌসুমে বার্সেলোনার অবস্থাটা ছিল অনেকটা সেরকমই। দলভর্তি লা মাসিয়া থেকে গ্র্যাজুয়েট না হওয়া খেলোয়াড়। প্রেসিডেন্ট হিমশিম খাচ্ছেন খেলোয়াড় দলে ভেড়াতে। মড়ার ওপর খড়ার ঘাঁ হয়ে এসেছিলেন কোচ হ্যান্সি ফ্লিক। কোচ হিসেবে তাঁকে নিয়ে প্রশ্ন ওঠাবার জো নেই। কিন্তু হ্যান্সি ফ্লিকের হাতে এমন এক দল তুলে দেওয়া হয়েছিল, যার ছিল না কোনো লক্ষ্য। মাঝসমুদ্রে বৈঠা হাতে খেয়া নৌকার ভার তুলে দেওয়া হয়েছিল তাঁর কাঁধে। মৌসুমের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে সেই দলকে নিয়ে হ্যান্সি ফ্লিক উদ্‌যাপন করেছেন ঘরোয়া ট্রেবল। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদকে হারিয়েছেন চারবার। বার্সেলোনার এমন ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প এবারের লা লিগার মূল আকর্ষণ।

ভঙ্গুর অবস্থায় দলের দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন হ্যান্সি ফ্লিক।
ছবি: এক্স

হ্যান্সি ফ্লিক দায়িত্ব পাওয়ার পর দল সাজানো দূরে থাক, কেনা খেলোয়াড়কে দলে পাবেন কিনা, তা নিয়েও ছিল সন্দেহ। আরবি লাইপজিগ থেকে ৫৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে কেনা দানি ওলমোকে রেজিস্টার করাতে ঘাম ছুটে গিয়েছিল বার্সা বোর্ডের। লা লিগার নিয়ম নীতির ভেতরে থেকে তাঁকে দলে রেজিস্টার করানোর জন্য কোর্টে পর্যন্ত যেতে হয়েছে বার্সেলোনাকে। শুধু মৌসুমের আগে নয়, মৌসুমের মাঝপথেও তাঁকে দলে নেওয়া নিয়ে কম ঝামেলা হয়নি।

এ তো গেল খেলোয়াড় রেজিস্ট্রেশনের গল্প। মৌসুমে শুরু হতে না হতেই এসিএল ইঞ্জুরিতে পরেন দলের মূল গোলরক্ষক টের স্টেগান। ততদিনে দলবদলের মৌসুম শেষ। হুট করে কাউকে দলে ভেড়াবে এমন সুযোগও নেই। অগত্যা গত মৌসুমে ফুটবল থেকে অবসর নেওয়া ভয়চেক শেজনিকে ফ্রিতে দলে ভেড়ায় বার্সা। সদ্য অবসর নেওয়া ৩৫ বছর বয়সী শেজনি, আর সামনে ৩৬ বছর বয়সী স্ট্রাইকার রবার্ট লেফানডফস্কি। পুরো দলে অভিজ্ঞ কাণ্ডারি বলতে এই দুইজনেই। পুরো দলের বয়সের গড় ছিল মাত্র ২৫। বার্সেলোনার মতো দলের জন্য তা বেমাননই বটে।

অবসর থেকে এসে শেজনি বনে গেলেন বার্সেলোনার হিরো।
ছবি: এক্স

হ্যান্সি ফ্লিক যখন বার্সার ডেরায় এলেন, দলের আত্মবিশ্বাস তখন তলানিতে। অভিজ্ঞ লেফানডফস্কি আর রাফিনহার পায়ে গোল নেই। মাঝমাঠ থেকে বলের সাপ্লাই নেই। তরুণদের খেলায় বারুদের অভাব। কথা চলছিল, টাকা জোগাড় করার জন্য বিক্রি করে দেওয়া হতে পারে ফ্র্যাংকি ডি ইয়ংকে। ফ্লিকের প্রথম কাজ ছিল দলের মধ্যে সেই পুরো কনফিডেন্স ফিরিয়ে আনা। দলকে চাঙ্গা করা। সেটা শুরু করেছিলেন লেফানডফস্কি, রাফিনহা আর ডি ইয়ংয়ের কাঁধে ভরসার হাত রেখে।

ফ্লিকের দ্বিতীয় চিন্তা ছিল এতগুলো কম বয়সী খেলোয়াড় নিয়ে। তাঁদের খেলায় জোশ আছে, আছে আত্মবিশ্বাস। এই জোশ আত্মবিশ্বাস নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। পেদ্রি, গাভি, লামিন ইয়ামাল, আলেহান্দ্রো বালদে, মার্ক ক্যাসাডো–তরুণ খেলোয়াড়দের দক্ষতা আর গতির ওপর ভরসা রেখেছেন জার্মান কোচ। তরুণদের ভুলে পয়েন্ট খুইয়েছেন, কিন্তু একবারের জন্যও তাদের ওপর চড়াও হননি, দল থেকে ফেলে দেননি। বরং তাদেরকে ধরে ধরে ভেতরের সুপ্ত প্রতিভা বের করেছেন। তাই বলে যে ছাড় দিয়েছেন তাও কিন্তু নয়।

তরুণদের সামলানো চ্যালেঞ্জ ছিল ফ্লিকের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
ছবি: ইন্সটাগ্রাম

তরুণ খেলোয়াড়দের উচ্ছ্বন্নে যেতে বিন্দুমাত্র সময় লাগে না। পরিপূর্ণ গাইডলাইনের অভাবে অনেক তরুণ খেলোয়াড়ই হারিয়ে যান ফুটবলের ইতিহাস থেকে। সে কারণেই নিয়ম নীতির ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ছাড় দেননি তিনি। টিম মিটিং কিংবা ট্রেনিংয়ে দেরি করলে ছিল শাস্তি। মাঠে নিজস্ব স্টাইলে আসার বন্দোবস্তও বন্ধ করে দিয়েছিলেন তিনি। সবাইকে মাঠে থাকতে হবে ক্লাবের ট্রেনিং ড্রেসে। হিপ রিপ্লেসমেন্ট করে ৬০ বছর বয়সী ফ্লিক নিজেও হয়ে উঠেছিলেন পূর্ণ ফিট। সব মিলিয়ে বার্সেলোনার দুঃসময় ফ্লিকের জন্য পরিণত হয়েছিল একটি চ্যালেঞ্জে।

আর সেই চ্যালেঞ্জ ফ্লিক উৎরে গিয়েছেন অনায়াসেই। একটা সময় মনে হয়েছিল, বার্সেলোনা মৌসুমটা খেলছে শুধু খেলার জন্যই। বিশেষ করে বড়দিনের ছুটিতে যাওয়ার আগে। রিয়াল মাদ্রিদ থেকে বার্সা পিছিয়ে ছিল ৯ পয়েন্টের ব্যবধানে। এমনকি আতলেতিকো মাদ্রিদও সমানে সমানে টেক্কা দিচ্ছিল রিয়ালকে, কিন্তু বার্সেলোনা নিজেদের পায়ের তলায় মাটিই খুঁজে পাচ্ছিল না। সেখান থেকে আনচেলত্তির রিয়ালকে শুধু টেক্কা নয়, লা লিগার শীর্ষস্থান দখল করেছে ফ্লিকের বার্সা।

ফ্লিককে নিয়ে দলের উদ্‌যাপন।
ছবি: টুইটার

বার্সেলোনার ফেরার সূচনা হয়েছিল স্পেন থেকে বহুদূরে, সৌদি আরবের কিং আবদুল্লাহ স্পোর্টস সিটি স্টেডিয়ামে। রিয়াল মাদ্রিদকে ৫-২ গোলের বিশাল ব্যবধানে হারিয়ে মৌসুমের প্রথম ট্রফি নিজেদের করে নেয় বার্সা। ট্রফির স্বাদ পেয়েই যেন হিংস্র হয়ে উঠে ব্লাউগ্রানারা। সুপার কাপ জেতার পর থেকে এখন পর্যন্ত স্পেনের ভেতরে রীতিমতো অপরাজিত বার্সা। লা লিগায় ১৬ ম্যাচের মধ্যে ১৪টিতে জয়। বেতিস, ভ্যালেন্সিয়া, আতলেতিকো আর রিয়ালকে হারিয়ে জিতেছে কোপা দেল রে।

আর প্রতিটি মুহূর্তে বার্সেলোনাকে ম্যাচে ফিরিয়ে এনেছে তাদের ইন্টেনসিটি। গত কয়েক মৌসুম ধরে দলের মাঝে যা দেখাই যাচ্ছিল না। ম্যাচে পিছিয়ে পড়লেই যে কেউ বলে দিতে পারত, বার্সেলোনা ম্যাচ শেষ করতে যাচ্ছে হার দিয়ে। গত মৌসুমে এর সমালোচনা করেছিলেন খোদ গুন্দোগান। ফ্লিক সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এনেছেন দলের মনোভাবে। দলের মধ্যে হারার আগেই হেরে যাওয়ার মানসিকতা আর নেই। বরং পিছিয়ে পড়লেও কীভাবে ফিরে আসা যায়, সেই ট্রেনিং চলেছে দলের ভেতরে-বাইরে। ফলাফল? কোপা দেল রে ফাইনালে ‘কামব্যাক কিং’ রিয়ালের বিপক্ষে পিছিয়ে পরেও ফিরে আসার গল্প। ১-২ গোলে পিছিয়ে পড়েও বার্সেলোনা ম্যাচ শেষ করেছে ৩-২ গোলে জিতে।

বার্সার আক্রমণভাগের ভরসা, ইয়ামাল-রাফিনহা জুটি।
ছবি: এক্স

এরপর থেকে চক্রবৃদ্ধি হারে তাদের কামব্যাকের সংখ্যা শুধু বেড়েছে। আতলেতিকো মাদ্রিদ, সেল্টা ভিগো, ভায়াদোলিদ, রিয়াল মাদ্রিদ। লা লিগায় বার্সেলোনার বড় বড় জয়গুলো এসেছে পিছিয়ে পড়ার পরই। লামিন ইয়ামাল, রাফিনহা, ফেরান তোরেসরা নিজেদের নার্ভ ধরে রেখে তুলে এনেছেন জয়। দুই ম্যাচ হাতে রেখেই নিজেদের নগর প্রতিদ্বন্দ্বী এসপানিওলের মাঠ থেকে শিরোপা উদ্‌যাপন করেছে বার্সা।

তিন ট্রফি নিয়ে বার্সেলোনার প্যারেড।
ছবি: এক্স

মৌসুমের শুরুতে চ্যাম্পিয়নস লিগ নিশ্চিতের লড়াইয়ে নামা বার্সেলোনা, এবারের ডমেস্টিক ট্রেবল উইনার। স্পেনের বড় তিন ট্রফি তাদের নাগালে। সঙ্গে রয়েছে চ্যাম্পিয়নস লিগ সেমি ফাইনাল। এসপানিওলের ভেজা মাঠে লা লিগা উদ্‌যাপন যেন নতুন পথের দিশা দিয়েছে বার্সেলোনাকে। সেই সঙ্গে ফুটবলকেও। যার কাণ্ডারি হবেন ইয়ামাল, পেদ্রি, গাভিরা।

আরও পড়ুন