কেমন হলো বাংলাদেশের বিশ্বকাপ ফিকশ্চার

বহু কাঠখড় পুড়িয়ে, মন–কষাকষি, বাধাবিপত্তি পেরিয়ে অবশেষে বিশ্বকাপের ফিকশ্চার ঘোষণা করেছে আইসিসি। পাকিস্তানের আপত্তি সত্ত্বেও পুরো বিশ্বকাপই হতে চলেছে ভারতের মাটিতে। ১০ দল, ১০ ভেন্যু, ৪৬ দিন, ৪৮ ম্যাচ। গত বিশ্বকাপের মতো এবারও প্রতিটি দল গ্রুপ পর্বে খেলবে একে অপরের বিপক্ষে, তারপর শীর্ষ চার দলের জায়গা হবে সেমিফাইনালে। ভারতের ছয় ভেন্যুতে গ্রুপ পর্বের ৯টি ম্যাচ খেলবে বাংলাদেশ। কেমন হলো বাংলাদেশের ফিকশ্চার? বিশ্বকাপের ভেন্যুগুলোতে বাংলাদেশের রেকর্ডই–বা কেমন?

বাংলাদেশের বিশ্বকাপ ফিকশ্চারকে ছুরি-কাঁচির নিচে ফেলে একটু দেখা যাক। বিশ্বকাপে ভিন্ন ভিন্ন ছয়টি মাঠে খেলবে বাংলাদেশ। এর মধ্যে কলকাতা, পুনে ও ধর্মশালায় দুটি করে ম্যাচ। আর দিল্লি, মুম্বাই ও চেন্নাইয়ে একটি করে ম্যাচ। দিন-রাতের হিসাব করলে তিনটি ম্যাচ হবে দিনে। আর বাকি ছয়টি ম্যাচই হবে দিন-রাত মিলিয়ে।

ম্যাচ ১: প্রতিপক্ষ আফগানিস্তান, ভেন্যু ধর্মশালা

বিশ্বকাপে যে কয়েকটি ম্যাচকে ‘মাস্ট উইন’ ধরে রেখেছে বাংলাদেশ, তাদের মধ্যে আফগানিস্তান একটি। পচা শামুকে পা না কাটলে, ম্যাচের ফল যে আমাদের পক্ষেই আসছে, তা বলাই যায়। এ ছাড়া ধর্মশালায় বাংলাদেশের রেকর্ডটাও বলার মতো। তিন ম্যাচ খেলে দুটিতে জয়, একটি ভেসে গেছে বৃষ্টিতে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত ধর্মশালায় চিন্তার খোরাক জাগাচ্ছে এর আবহাওয়া। বৃষ্টিবাধায় আশঙ্কা রয়েছে ম্যাচ ব্যাহত হওয়ার।

তবে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ধর্মশালার পিচ বাংলাদেশের জন্য হয়েছে শাপেবর। আফগানিস্তানের স্পিন আক্রমণ অনেকটাই মুখ থুবড়ে পড়বে ধর্মশালায় পেসবান্ধব কন্ডিশন ও পিচের কাছে। প্রথম ম্যাচে তাই বাংলাদেশের ভরসা তাসকিন-হাসান-এবাদতদের ওপরে। গত কয়েক বছরে পেসারদের যে উত্থান হয়েছে, বড় মঞ্চে তা প্রমাণ করার সুযোগ তাঁদের সামনে।

ম্যাচ ২: প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড, ভেন্যু ধর্মশালা

প্রথম ম্যাচে ধর্মশালার পিচ শাপেবর হলেও পরের ম্যাচেই পরিস্থিতি ঘুরে যেতে পারে ১৮০ ডিগ্রি। কারণ, প্রতিপক্ষের নাম যে ইংল্যান্ড। বিশ্বজয়ী ইংল্যান্ডের পেস আক্রমণকে নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই। তবে বড় মঞ্চে ইংল্যান্ডের ত্রাসের নাম ঘুরেফিরে সেই বাংলাদেশই। ২০১১ ও ২০১৫ টানা দুই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কাছে হেরেই বাড়ির পথ ধরতে হয়েছিল তাদের। বিশ্বজয়ী হলেও একটা বাড়তি চাপ তো থাকছেই।

সেই সঙ্গে যুক্ত হবে ভ্রমণক্লান্তি আর কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার সমস্যা। আহমেদাবাদ থেকে ঘুরে এসে বাংলাদেশের বিপক্ষে মাঠে নামতে হবে ইংল্যান্ডকে। অন্যদিকে প্রথম ম্যাচ খেলে কন্ডিশনের সঙ্গে অনেকটাই মানিয়ে নিতে পারবে বাংলাদেশ। আদাজল খেয়ে নামলে ধর্মশালায় ইংল্যান্ডকে হারানো কঠিন বটে, কিন্তু অসম্ভব নয়।

ম্যাচ ৩: প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড, ভেন্যু চেন্নাই

চেন্নাইয়ের চিদাম্বরাম স্টেডিয়ামে এক ম্যাচ খেলতে নেমেছিল টাইগার বাহিনী, সেবার কেনিয়ার কাছে হেরে মাথা নিচু করে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল তাদের। এবার অবশ্য প্রতিপক্ষ কেনিয়া নয়, নিউজিল্যান্ড। চেন্নাইয়ের পিচ বরাবরই স্পিনারদের স্বর্গরাজ্য। এবারও তার খুব একটা ব্যতিক্রম হওয়ার কথা নয়। অন্যদিকে কিউইদের স্পিন–দুর্বলতার কথা তো সর্বজনস্বীকৃত। পিচ আর কন্ডিশনের বিবেচনায় ফেবারিট হিসেবে মাঠে নামবে বাংলাদেশই। কিন্তু সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ফলাফল বের করার দায়িত্বটা ঘুরেফিরে খেলোয়াড়দের কাঁধেই।

ম্যাচ ৪: প্রতিপক্ষ ভারত, ভেন্যু পুনে

বিশ্বমঞ্চে নতুন চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে অনেক দিন ধরেই নাম কামিয়েছে ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচ। আগে শুধু দুই দেশের দর্শক উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে থাকত এই ম্যাচের দিকে। সময় বদলেছে, উত্তেজনার দিক দিয়ে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের পরই অবস্থান এই ম্যাচের। বাংলাদেশের জন্য লড়াইটা শুধু জয়ের নয়, আত্মসম্মানেরও। হাইভোল্টেজ এই ম্যাচের ভেন্যু পুনেতে খেলার কোনো অভিজ্ঞতাই নেই বাংলাদেশের। কিন্তু ইতিহাস বলে পুনের এই মাঠে রানবন্যা দেখা যায় নিয়মিতই। বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচের উত্তেজনা যে রানের পাহাড় দিয়েই মোকাবিলা করতে হবে, তা এখনই বলে দেওয়া সম্ভব। পাঁচ দিনের বিশ্রাম নিয়ে মাঠে নামবে দুই দল। মাঠের লড়াইয়েই বোঝা যাবে হাইভোল্টেজ ম্যাচে জয় আসে কার।

ম্যাচ ৫: প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা, ভেন্যু মুম্বাই

বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ রেকর্ড বরাবরই ভালো। কিন্তু এখানে বাদ সাধতে পারে মুম্বাইয়ের পিচ। ভারতের অন্যান্য মাঠের থেকে তুলনামূলক বেশি রান ওঠে মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে। আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট, ফলে ব্যাটিং পিচ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কাগজে–কলমে দক্ষিণ আফ্রিকা শক্তিশালী হলেও বাংলাদেশের বিপক্ষে তাদের রেকর্ড বেশ দুর্বল। গত বছরই দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে সিরিজ জিতে এসেছে টাইগাররা। নিজেদের স্বাভাবিক খেলা খেলতে পারলে মুম্বাইয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানো অসম্ভব কিছু নয়।

বাংলাদেশের বিশ্বকাপ ফিকশ্চার
আইসিসি

ম্যাচ ৬: প্রতিপক্ষ কোয়ালিফায়ার ১, ভেন্যু কলকাতা

পুরো ভারত ঘুরে অবশেষে নিজেদের পরিচিত ভেন্যুতে ফিরবে বাংলাদেশ। মাঠ পরিচিত হলে কী হবে, এই মাঠ থেকে একবারও ভালো স্মৃতি নিয়ে ফিরতে পারেনি বাংলাদেশ। ৪ ম্যাচের ৪টিতেই শোচনীয় পরাজয় বরণ করতে হয়েছে টাইগারদের। তবে এবার ঘুরতে পারে ভাগ্যের চাকা। কলকাতার ইডেন গার্ডেনে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ কোয়ালিফায়ার থেকে উঠে আসা একটি দল। সবকিছু ঠিক থাকলে দলটি হতে পারে জিম্বাবুয়ে অথবা শ্রীলঙ্কা। শক্তিমত্তায় দুই দলের থেকেই যোজন যোজন এগিয়ে বাংলাদেশ। কলকাতাবাসীর সামনে পিচের অবস্থা যেমনই হোক না কেন, জয়ের আশা করতেই পারে বাংলাদেশ।

ম্যাচ ৭: প্রতিপক্ষ পাকিস্তান, ভেন্যু কলকাতা

ইডেন গার্ডেনে টানা দুই ম্যাচ খেলার সুযোগ পাচ্ছে বাংলাদেশ। কন্ডিশনের সঙ্গে তো আগে থেকেই পরিচিত টাইগাররা, পিচের সঙ্গেও মানিয়ে নেওয়ার সময় রয়েছে যথেষ্ট। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের বিপক্ষে মুখোমুখি হওয়ার আগপর্যাপ্ত বিশ্রামও পাবে টাইগাররা।

ম্যাচ ৮: প্রতিপক্ষ কোয়ালিফায়ার ২, ভেন্যু দিল্লি

দিল্লিতে বাংলাদেশ মুখোমুখি হবে কোয়ালিফায়ার থেকে উঠে আসা দ্বিতীয় দলের সঙ্গে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে দলটি হতে পারে জিম্বাবুয়ে অথবা শ্রীলঙ্কা। কলকাতার মতো ব্যাটিং পিচই থাকবে দিল্লিতে। নিজেদের শক্তিমত্তা অনুযায়ী খেলতে পারলে বাংলাদেশের জন্য সহজ জয় অপেক্ষা করছে এই ম্যাচে।

ম্যাচ ৯: প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া, ভেন্যু পুনে

গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ। তত দিনে সব সমীকরণ জানা হয়ে যাবে দুই দলের। সেমিফাইনালে যাচ্ছে কারা, কাদের অবস্থান কী রকম, এই ম্যাচের ফলের ওপর কাদের ভাগ্য নির্ধারিত হচ্ছে, সবটা জেনেই পুনেতে খেলতে নামবে দুই দল। এই ম্যাচ হতে পারে ফাইনালের আগে এক ফাইনাল অথবা নিছকই একটি নিয়মরক্ষার ম্যাচ। যেটাই হোক না কেন, বিশ্বমঞ্চে অস্ট্রেলিয়ার মতো দলকে ঠেকিয়ে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা থাকবে টাইগারদের।

বিশ্বকাপের শেষ চারে সুযোগ পেতে হলে বাংলাদেশকে অন্তত ১০ পয়েন্ট অর্জন করতে হবেই। সে ক্ষেত্রে আফগানিস্তান, জিম্বাবুয়ে, শ্রীলঙ্কা আর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের দিকেই পাল্লাটা বেশ ভারী থাকবে। বাস্তবতার নিরিখে এদের পরেই বাংলাদেশের সুবর্ণ সুযোগ পাকিস্তান কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে।

বাংলাদেশ বিশ্বকাপযাত্রা শুরু করছে বিশ্বজয়ের লক্ষ্যেই। লক্ষ্য যেহেতু বিশাল, বাঘের গর্জনটাও ঠিক সে রকমই হওয়া দরকার। মাঠে ভয় নয়, নিজেদের শক্তিমত্তা বিচার করে নামতে পারলে কেউই অপরাজেয় নয়। অপেক্ষা যেহেতু অনেক বড়, তাই গর্জনটাও অনেক বড় করেই দিতে হবে। বিশ্বকাপ জিততে হলে কোনো দলকে আলাদাভাবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বিশ্বকাপ জেতার মতো সব ধরনের সামর্থ্য বাংলাদেশের আছে।

অপেক্ষা শুধু ৭ অক্টোবরের, বাংলাদেশের বিশ্বকাপযাত্রা শুরুর। বাকিটা? পথ চলতে চলতেই জানা যাবে স্বপ্নযাত্রা কোথায় থামে।