হলুদে রাঙা বিশ্বকাপ

১৯৯৪ বিশ্বকাপ: বিশ্বকাপে হলুদ জাগরণ

বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত এবং একই সঙ্গে সমালোচিত বিশ্বকাপের মধ্যে অন্যতম ১৯৯৪ বিশ্বকাপ। এর আগেও বিশ্বকাপ আসর নিয়ে সমালোচনা হয়েছে অনেক। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেসব আসর থেকে উল্লেখ করে বলার মতো ভালো কোনো দিক ছিল না বললেই চলে। কিন্তু বিশ্বকাপের ১৫তম আসর সেদিক থেকে বেশ আলাদা।

১৯৯৪ বিশ্বকাপের পোস্টার

ফুটবলের দেশ না হলেও বিশ্বকাপ আয়োজনে কমতি রাখেনি যুক্তরাষ্ট্র। ২৪ দল নিয়ে আগের ফরম্যাটেই শুরু হয় বিশ্বকাপ। কিন্তু পরিবর্তন আসে পয়েন্ট পদ্ধতিতে। ম্যাচ জিতলে ৩ পয়েন্ট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ফিফা। আমেরিকা মহাদেশের এই বিশ্বকাপের সব আলো কেড়ে নেয় লাতিন আমেরিকার তিন দেশ—আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল আর কলম্বিয়া!

বিশ্বকাপের প্রথম ধাক্কা আসে আর্জেন্টিনাকে একা হাতে বিশ্বকাপ জেতানো তারকা ডিয়েগো ম্যারাডোনার কাছ থেকে। ১৯৯১ সালে মাদক সেবনের দায়ে একবার নিষিদ্ধ হয়েছিলেন তিনি। সেখান থেকে ফিরে এসে বিশ্বকাপের প্রথম দুই ম্যাচে একক নৈপুণ্যে আর্জেন্টিনাকে জয় এনে দেন ম্যারাডোনা। কিন্তু নাইজেরিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ দেখেই নড়েচড়ে বসে ফিফা। ম্যাচ শেষে করা হয় ডোপ টেস্ট। সেখানে তাঁর শরীরে পাওয়া যায় নিষিদ্ধ এফিড্রিন, যা প্রফেশনাল ফুটবলে নিষিদ্ধ একটি ওষুধ। বিশ্বকাপ থেকে নিষিদ্ধ হন ম্যারাডোনা। প্রথমবারের মতো ডোপ–পাপে বিশ্বকাপ থেকে বহিষ্কৃত হলেন কোনো খেলোয়াড়। ম্যারাডোনার সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায় আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ স্বপ্ন।

একদিকে যখন ম্যারাডোনার ডোপ পরীক্ষা চলছে, অন্যদিকে চলছে কলম্বিয়ার বিশ্বকাপ যাত্রা। সেবারের বিশ্বকাপে অন্য রকম একটা আশা নিয়ে মাঠে নেমেছিল কলম্বিয়া। কিন্তু স্বাগতিক যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হেরে স্বপ্নভঙ্গ হয় তাদের। সে ম্যাচে এক আত্মঘাতী গোল করে দেশের স্বপ্নে সবচেয়ে বড় বাগড়া দেন অধিনায়ক আন্দ্রেস এসকোবার। সেই আত্মঘাতী গোলের ফল ছিল ভয়াবহ। কলম্বিয়াজুড়ে মাফিয়াদের রাজত্ব। আর সেখানে আত্মঘাতী গোল করে কলম্বিয়ার স্বপ্নভঙ্গ করার মাশুল এসকোবারকে দিতে হয়েছিল নিজের জীবন দিয়ে। নিজের শহরে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ ত্যাগ করেন এসকোবার। এক আত্মঘাতী গোল হয়েছিল তাঁর জীবনের অন্তরায়।

নিষিদ্ধ হয়ে বিশ্বকাপ থেকে ম্যারাডোনার বিদায়

যদিও এত ঘটনার মাঝে ঠিকই বড় দলগুলো নিজেদের জায়গা তৈরি করে নিয়েছিল। রিস্টো স্টইচকভের বুলগেরিয়া ছিল ১৯৯৪ বিশ্বকাপের চমক। মেক্সিকো-জার্মানিকে হারিয়ে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠে এসেছিল তারা। যদিও তাদের জয়রথ থামিয়ে দেন রবার্তো ব্যাজিও। সেমিতে ১-২ গোলে হেরে বাড়ি ফেরে বুলগেরিয়া। ফাইনালে ইতালির মুখোমুখি হয় ব্রাজিল।

২৪ বছর পর বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠলেও তা নিয়ে খুব একটা খুশি ছিল না ব্রাজিলবাসী। প্রথমত, ব্রাজিলের টিপিক্যাল সাম্বা ফুটবলকে ছুড়ে ফেলে নতুন একধরনের ফুটবল আয়ত্ত করেছিলেন কোচ কার্লোস আলবার্তো পেরেইরা। গোল করার মতো খেলোয়াড়ের অভাব তাঁর কাছে ছিল না, কিন্তু গোল থামানোটাই ছিল তাঁর কাছে মুখ্য। সেটাই হয়ে উঠেছিল ব্রাজিলের সবচেয়ে বড় অস্ত্র। ফাইনালে অ্যারিগো সাচ্চির ইতালির মুখোমুখি হয় ব্রাজিল। আর প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ফাইনাল শেষ হয় গোলশূন্য অবস্থায়। ফাইনাল গিয়ে পৌঁছায় টাইব্রেকারে।

পেনাল্টি মিসের হতাশায় রবার্তো ব্যাজ্জিও

আর সেখানেই আটকে যান রবার্তো ব্যাজিও। ইতালির ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় ব্যাজিও ছিলেন পেনাল্টি মাস্টার। অথচ চাপে পড়ে পেনাল্টিটাই তুলে দেন আকাশে। ‘দ্য ডিভাইন পনিটেইল’-এর পেনাল্টি মিস ব্রাজিলের হাতে তুলে দেয় নিজেদের চতুর্থ বিশ্বকাপ। শুরু হয় নতুন এক হলুদ যাত্রা।

জয়ের পর ব্রাজিলের আনন্দমিছিল

১৯৯৮ বিশ্বকাপ: হলুদ যাত্রায় জিদান–বিরতি

১৯৯৮ বিশ্বকাপ ছিল বিশ্বকাপ ইতিহাসের আরেক যুগান্তকারী আয়োজন। আজকের দিনে তোমরা সবাই যে বিশ্বকাপ দেখতে পাও, তার সূচনা হয়েছিল এই ফ্রান্স বিশ্বকাপ দিয়েই। দ্বিতীয়বারের মতো ফ্রান্সে আয়োজিত হওয়া বিশ্বকাপে নতুনত্বের অভাব ছিল না।

১৯৯৮ বিশ্বকাপের পোস্টার

অংশগ্রহণকারী দলের সংখ্যা ২৪ থেকে বেড়ে হয়েছিল ৩২! বিশ্বকাপের দলগুলোকে আর ৬ গ্রুপে ভাগ না করে ভাগ করা হয় ৮ গ্রুপে। সেরা তৃতীয় স্থানের কোয়ালিফাই করার সুযোগও বন্ধ হয়ে যায় সেবার থেকে। প্রথমবারের মতো প্রচলন হয় গোল্ডেন গোলের। নকআউট পর্বের ম্যাচের অতিরিক্ত সময়ে গোল ব্যবধান নয়, বরং প্রথম যে দল গোল করবে, সে দলই চলে যাবে পরবর্তী পর্বে। ইলেকট্রনিক বোর্ড ব্যবহারের অনুমতি পান ফোর্থ অফিশিয়ালরা। পেছন থেকে ট্যাকলের অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি লাল কার্ড দেওয়ারও অধিকার পান মূল রেফারি।

টুর্নামেন্টের মূল আকর্ষণ ছিল ব্রাজিলের দিকেই। টানা চার বছর একই ধারায় খেলে গিয়েছে সেলেসাওরা। যুক্ত হয়েছে রোনালদো, রোনালদিনহোর মতো বড় বড় নাম। কোপা আমেরিকা, কনফেডারেশন্স কাপও তাঁদের নামের পাশেই শোভা পাচ্ছে। আর কোচ হিসেবে স্বয়ং মারিও জাগালো—ব্রাজিলের প্রতিটি বিশ্বকাপ জয়ের মিশনেই তিনি ছিলেন সঙ্গী। দুইবার খেলোয়াড়, একবার ম্যানেজার, একবার মেন্টর। এবার একেবারে কোচ। বিশ্বকাপ জেতা তাঁর কাছে বাঁ হাতের খেল। বাকি শুধু মাঠে পারফর্ম করা।

গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে নরওয়ের বিপক্ষে হোঁচট খাওয়া ছাড়া ঠিকঠাকই চলছিল ব্রাজিলের বিশ্বকাপ পরিকল্পনা। চিলি, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে ব্রাজিল উঠে এসেছিল বিশ্বকাপের ফাইনালে। অন্যদিকে নিজেদের মাটিতে ফ্রান্স ছিল অপরাজিত। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ থেকে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা ফ্রান্সকে আটকানোর সাধ্য হয়নি কারোর। পুরো বিশ্বকাপে মাত্র ২ গোল হজম করে ফরাসিরা। তার একটা আবার সেমিফাইনালে এসে। স্বাগতিক হওয়ার পূর্ণ সুবিধাটা কাজে লাগিয়েছিল তারা।

হতাশ রোনালদো, পেছনে বিজয়ী ফ্রান্সের উৎসব

ফাইনালের আগের দিন বাধে বিপত্তি। হোটেলে হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েন রোনালদো। সবে ২১ বছরে পা দিয়েছেন, তখনই বিশ্বের সেরা তারকাদের একজন। ব্রাজিলের আক্রমণভাগের অন্যতম সেরা অস্ত্র তিনি। ফাইনালের আগের দিন এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়লেন যে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালে। সেখান থেকে ফেরত এসে সরাসরি ফাইনালে।

অপ্রতিরোধ্য জিদান

রোনালদোর এমন ইঞ্জুরি সবার মনেই চিন্তার খোরাক জন্ম দিয়েছিল। ব্রাজিল দলও বিমর্ষ হয়ে পড়েছিল। আর সে সুযোগটা হারায়নি ফ্রান্স। একেবারে শুরু থেকেই ব্রাজিলের টুঁটি চেপে ধরে দেশমের দল। বিশেষ করে জিনেদিন জিদান। বিশ্বকাপের প্রথম দিন থেকে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা জিদানকে থামানোর সাধ্য ছিল না কারোরই। সেখানে রাতারাতি বিপর্যস্ত ব্রাজিল দলকে পেয়ে আরও জ্বলে ওঠেন তিনি।

ফ্রান্সের প্রথম শিরোপা

জিদানের দুই গোল আর ম্যাচের শেষ মিনিটে পেতিতের গোলে ৩-০ গোলে জয় নিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ শিরোপা উঁচিয়ে ধরে ফ্রান্স। ফিফার জন্মস্থান ফ্রান্সে প্রথমবারের মতো ভেড়ে বিশ্বকাপ ট্রফি।

২০০২ বিশ্বকাপ: ব্রাজিলের পাঁচ

সেবারই প্রথম ইউরোপ–আমেরিকার গণ্ডি ছেড়ে বেরিয়ে আসে বিশ্বকাপ। ২০০২ বিশ্বকাপের মঞ্চ হিসেবে ঠিক হয় এশিয়ার দুই দেশ—দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান। এটাই ছিল ইতিহাসের প্রথম যৌথ আয়োজনের বিশ্বকাপ। এ নিয়ে উত্তেজনাও কম ছিল না। আর এই উত্তেজনার মাঝেই একের পর এক চমক দেখিয়ে গিয়েছে বিশ্বকাপ।

২০০২ বিশ্বকাপের পোস্টার

চমকের শুরু বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব থেকে। ব্রাজিলের কোয়ালিফাই করা নিয়েই শুরু হয় দোটানা। নিজেদের একদম শেষ ম্যাচ জিতে কোনোমতে এশিয়ার টিকিট কাটে তারা। ফেবারিটদের এমন বেহাল দশা দেখে শঙ্কায় পড়ে গিয়েছিল খোদ ব্রাজিলিয়ানরাও।

অন্যদিকে অন্য টপ ফেবারিটদের দুর্দশা শুরু হয় বিশ্বকাপের মূল মঞ্চে। বিশ্বজয়ী ফ্রান্স, ফেবারিট আর্জেন্টিনা—সবাই গ্রুপ পর্ব থেকেই বাড়ির টিকিট কাটে। তাদের পাশ কাটিয়ে বিশ্বকাপের ডার্ক হর্স হয়ে ওঠে তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া। একদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার জয়রথের সামনে পিষে পড়ে ইতালি, স্পেনের মতো দল। অন্যদিকে জাপান, সেনেগালকে হারিয়ে সেমির টিকিট কাটে তুরস্ক।

দুই দলের স্বপ্নযাত্রায় ছেদ ঘটে সেমিতে এসে। জার্মানি আর ব্রাজিলের কাছে হেরে বাড়ি ফেরে তারা। তার আগেই বিশ্বকাপে নতুন এক ইতিহাস লেখা শেষ হয়ে গিয়েছিল তাদের। বাকি ছিল শুধু ফাইনাল। আর সেখানেই গল্পের আসল টুইস্ট।

বিশ্বকাপ ইতিহাসের সেরা দলগুলোর কথা যদি পর্যালোচনা করো, তাহলে একটা জিনিস বারবারই ঘুরেফিরে আসবে—তাদের গল্পের সমাপ্তি হয়েছে বিরহে। ৫৪-এর হাঙ্গেরি, ৭৮-এর নেদারল্যান্ডস, ৮৬-এর ব্রাজিল; ইতিহাসের সেরা দলগুলো কখনো ছুঁয়ে দেখতে পারেনি বিশ্বকাপ। ২০০২–এর ব্রাজিলও ছিল তেমনই একটা দল, বিশ্বকাপের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই সুর-তাল-লয়ে খেলে যাওয়া ব্রাজিল দলকে হারানোর সাধ্য ছিল না কারোর। অন্যদিকে জার্মানি আজীবনই পরিচিত তাদের ‘জায়ান্ট-হান্টার’ ট্যাগ নিয়ে। বিশ্বকাপের সেরা দলদের শিরোপা বঞ্চিত করতে তাদের জুড়ি মেলা ভার।

পুরো টুর্নামেন্টেই আলো ছড়িয়েছেন রোনালদো

সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল রোনালদোর চোট। গত বিশ্বকাপের মতো এই বিশ্বকাপ ফাইনালের আগের দিনও হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন রোনালদো। এবারও চিন্তার খোরাক সবার মাথায়। কিন্তু রোনালদোর তাতে থোড়াই কেয়ার। বরং অদ্ভুত এক হেয়ারকাট দিয়ে সবার নজর নিয়ে গেলেন নিজের খেলার দিকে।

পঞ্চমবারের মতো বিশ্বকাপ ভিড়ল ব্রাজিলের ডেরায়

প্রমাণ মিলল হাতেনাতে। বিশ্বকাপ ফাইনালে সবার মুখে মুখে রোনালদোর হেয়ারকাট। ইঞ্জুরি, জার্মানির ভয়, এগুলো নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলার অবকাশই পেল না। পুরো টুর্নামেন্টে ১ গোল হজম করা অলিভার কানের পাশ দিয়ে পরপর দুই গোল করে সবাইকে চমকে দিলেন রোনালদো। পঞ্চমবারের মতো বিশ্বকাপ ভিড়ল ব্রাজিলের ডেরায়।