রাষ্ট্রপ্রধানের হস্তক্ষেপে ফিরে এসেছেন যেসব খেলোয়াড়

যার শুরু আছে, তার শেষও আছে—জগতের এই চিরায়ত নিয়ম মেনে প্রায় সবকিছুকেই আমাদের বিদায় জানাতে হয়। একসময়ের মাঠ মাতানো খেলোয়াড়েরা ‘বুড়ো’ হয়ে যেমন বিদায় নেন, বিদায় নেন ইনজুরির কারণে। আবার মাঝেমধ্যে অভিমান থেকেও বিদায় নেন তাঁরা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অভিমানের বিদায়গুলো ভেঙে ফিরে আসেন খেলোয়াড়েরা। সেটা কখনো দলের প্রয়োজনে, ভক্তদের আবদারে; কখনো আবার রাষ্ট্রপ্রধানের একান্ত অনুরোধে। রাষ্ট্রপ্রধানের হস্তক্ষেপে ফিরে আসা খেলোয়াড়ের সাম্প্রতিক উদাহরণ তামিম ইকবাল। কিন্তু তিনিই একমাত্র নন। কালে কালে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন তারকাই ফিরে এসেছেন দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তির প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে। তালিকার শুরুটা করা যাক ফুটবল থেকে।
রজার মিলা

রজার মিলা (ক্যামেরুন)

আফ্রিকার ফুটবলের অন্যতম বিখ্যাত তারকা এই ক্যামেরুনিয়ান। ১৯৯৪ সালে ফিফা বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি বয়সী খেলোয়াড় হিসেবে ম্যাচ খেলা এবং গোল করার দুটি রেকর্ডই নিজের করে নেন মিলা। তখন তাঁর বয়স ৪২ বছর! অথচ ১৯৯০ বিশ্বকাপের আগেই অবসর নিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। বিশ্বকাপের এক বছর আগে ফিটনেসজনিত সমস্যায় নিজেকে ফুটবল থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ক্যামেরুনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পল বাইয়া তাঁকে অনুরোধ করেন, বিশ্বকাপে দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে। প্রেসিডেন্টের কথা রাখেন মিলা। ফিরে এসে ’৯০–এর বিশ্বকাপে ক্যামেরুনকে কোয়ার্টার ফাইনালে তুলতে সাহায্য করেন। যদিও বয়সের কারণে ম্যাচের শুরুর একাদশে থাকতেন না। কিন্তু বেঞ্চ থেকে এসে চার–চারটি গোল করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। এমনকি ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনাকে হারানোর সেই ঐতিহাসিক ম্যাচে ক্যামেরুনের হয়ে দারুণ খেলেছিলেন রজার মিলা। ফরোয়ার্ড হিসেবে খেলা এই ফুটবলারের কর্নার ফ্ল্যাগের কাছে গিয়ে গোল উদ্‌যাপনের নাচ এখনো ফুটবলের আইকনিক দৃশ্যগুলোর একটি।

আসামোয়াহ জিয়ান

আসামোয়াহ জিয়ান (ঘানা)

ক্যামেরুনের ফুটবলে মিলা যেমন সিংহপুরুষ, ঘানার ফুটবলে আসামোয়াহ জিয়ানও তেমনি। ব্ল্যাক স্টারদের বিশ্বকাপ যাত্রায় জিয়ানের অবদান অনেক বেশি। ২০০৬, ২০১০ ও ২০১৪ বিশ্বকাপে মোট ৬টি গোল করেছিলেন জিয়ান। আফ্রিকার খেলোয়ারদের মধ্যে বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার রেকর্ডটি তাঁর। পেছনে ফেলেন ক্যামেরুনের কিংবদন্তি রজার মিলাকে। ২০১৪ বিশ্বকাপে জার্মানি আর পর্তুগালের বিপক্ষে গোল করেছেন জিয়ান। শুধু যে গোলই করেছেন তা নয়, ঘানাকে ২০১০ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে তোলার অন্যতম কৃতিত্বও তাঁর। কিন্তু এই জিয়ানই ২০১৯ সালে অধিনায়কত্ব নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে অবসর নেন। পরবর্তী কালে ঘানার প্রেসিডেন্ট নানা আকুফো-আদ্দোর হস্তক্ষেপে ফুটবলে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। তারপর ২০১৯ সালের আফ্রিকান কাপ অব নেশনস খেললেও ফিটনেসের কারণে জায়গা পাননি ঘানার ২০২২ বিশ্বকাপের দলে। শেষ পর্যন্ত কিছুদিন আগে, গত ২০ জুন স্থায়ীভাবে বুটজোড়া তুলে রাখার ঘোষণা দেন জিয়ান। জাতীয় দলে ১০৯ ম্যাচে ৫১ গোল করে ঘানার সর্বোচ্চ গোলদাতার ব্যাজ নিজের কাছেই রেখেছেন।

মিশেল প্লাতিনি
ছবি: টুইটার

মিশেল প্লাতিনি (ফ্রান্স)

ফ্রান্সের তো বটেই, ইউরোপের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় ধরা হয় মিশেল প্লাতিনিকে। তিনবার ব্যালন ডি অর জয়ী প্লাতিনি ১৯৮৭ সালে ফ্রান্স জাতীয় দল থেকে অবসরের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এর এক বছরের মাথায়ই কুয়েতের আমিরের অনুরোধে মাঠে ফেরেন তিনি। কুয়েতের জার্সিতে ম্যাচ খেলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে। মাত্র ২২ মিনিট খেলে কোনো গোল পাননি ফ্রান্সের সেই সময়ের সর্বোচ্চ গোলদাতা প্লাতিনি। ওই একটিই, এরপর আর কোনো ম্যাচ খেলেননি প্লাতিনি। কিন্তু অন্য এক দেশের সরকারপ্রধানের অনুরোধে অবসর ভেঙে সেই দেশের হয়ে খেলতে নামার এক বিরল ঘটনার জন্ম দিয়েছেন এই ফরাসি কিংবদন্তি।

লিওনেল মেসি
ফাইল ছবি

লিওনেল মেসি (আর্জেন্টিনা)

তালিকার সবচেয়ে বড় নাম এটাই। লিওনেল মেসি, সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার হুট করে জাতীয় দল থেকে অবসরের ঘোষণা জানিয়েছিলেন ২০১৬ সালের জুন মাসে। একের পর এক আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের ফাইনাল হারের ব্যর্থতা ঘিরে ধরেছিল তাঁকে। সেবার কোপা আমেরিকা ফাইনালের টাইব্রেকারে চিলির কাছে হারের কষ্টটা সহ্য করতে পারেননি বাঁ পায়ের জাদুকর। ম্যাচ শেষ হতে না হতেই অবসরের ঘোষণা জানিয়ে দেন তিনি। হতবাক হয়ে গিয়েছিল পুরো ফুটবল বিশ্ব। তড়িঘড়ি করে মেসিকে ফোন দিয়েছিলেন আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট মাউরিসিও মাকরি। বিনীত অনুরোধ জানিয়েছিলেন মেসিকে জাতীয় দলে ফিরে আসার। সঙ্গে সঙ্গে মত পরিবর্তন না করলেও, প্রেসিডেন্টের অনুরোধ ভেবে দেখবেন বলেছিলেন তিনি। এর মাস দুয়েক পরেই আর্জেন্টিনার হয়ে আবারও খেলার আগ্রহ জানান লিওনেল মেসি। এরপরের গল্প তো সবারই জানা। অবসর ভেঙে ফিরে এসে আলবিসেলেস্তেদের বিশ্বকাপ জেতানোর পেছনে মূল নায়কের ভূমিকা পালন করেন তিনি।

১৯৯২ বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে ইমরান খান
ছবি: এএফপি

ইমরান খান (পাকিস্তান)

১৯৮৭ বিশ্বকাপের পর অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সেই সময়ের ৩৫ বছর বয়সী পাকিস্তান অধিনায়ক ইমরান খান। সেবার ভারত-পাকিস্তানের মাটিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলতে ব্যর্থ হয় পাকিস্তান। সেই ক্ষোভেই অবসরের সিদ্ধান্ত নেন ইমরান। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়া-উল-হক সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বলেন তাঁকে। অবসর ভেঙে খেলায় ফেরেন ইমরান। তারপর ১৯৯২ সালে তাঁরই নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয় পাকিস্তান।

জাভেদ মিয়াঁদাদ

জাভেদ মিয়াঁদাদ (পাকিস্তান)

ক্রিকেটের ‘বড়ে মিয়াঁ’ নামে পরিচিত পাকিস্তানের মিয়াঁদাদও ১৯৯৪ সালে অবসরের সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলেন। কিন্তু দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর অনুরোধে সিদ্ধান্ত বদল করেন ১০ দিনের মাথায়। তারপর তিনি খেলেছেন ১৯৯৬ বিশ্বকাপও। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের কাছে হেরে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বাদ পড়া ম্যাচটিই তাঁর ক্যারিয়ারে শেষ। অবসরের সময় পাকিস্তানের হয়ে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড ছিল জাভেদ মিয়াঁদাদের দখলে।