ডেভিড বেকহাম: ইংল্যান্ডের ভিলেন, ইংল্যান্ডের নায়ক

গভীর রাত, কুকুরের চিৎকারে অতিষ্ঠ হয়ে ঘুম ভেঙেছে ডেভিড বেকহামের। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলেন মধ্যবয়সী এক লোক দাঁড়িয়ে আছেন রাস্তার মাঝখানে। আশপাশের কোনো কিছুতে ভ্রুক্ষেপ নেই তাঁর, মুখে কোনো কথাও নেই, নজর শুধু বেকহামের ভীতসন্ত্রস্ত দুটি চোখের দিকে। যেন রাস্তা থেকেই হৃদয়টা গ্রাস করে নিচ্ছেন তিনি। মিনিট দশেক পর অশ্রাব্য এক দুয়োধ্বনি ছুড়ে নিজের পথ মাপলেন তিনি।

সালটা ১৯৯৯। ইংলিশ মিডিয়াজুড়ে তখন একটাই গুঞ্জন, গাঁটছড়া বাঁধতে চলছেন ডেভিড বেকহাম আর ভিক্টোরিয়া অ্যাডামস। ইংলিশ ফুটবল আর মিউজিক মিলতে চলছে একই সুরে। একদিকে চলছে উৎসবের প্রস্তুতি, অন্যদিকে প্রতিক্ষণেই বেড়ে চলেছে বেকহামের প্রতি ইংলিশদের জমে থাকা ক্ষোভ। ম্যানচেস্টারের রাস্তা থেকে বেকহামের দিকে ছুড়ে দেওয়া সেই দুয়োধ্বনি ছিল পুরো ইংলিশ সমর্থকদের পক্ষ থেকে দেওয়া ‘বিয়ের উপহার’।

ঘটনার সূত্রপাত ঘটনার ঠিক এক বছর আগে। ফ্রান্সে বসেছে বিশ্বকাপের ১৬তম আসর। ২৩ বছর বয়সী ডেভিড বেকহাম তখন শুধু ইংল্যান্ড নয়, পুরো বিশ্বের আইকন। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের পোস্টার বয়, স্পাইস গার্ল ভিক্টোরিয়া অ্যাডামসের প্রেমিক; স্বর্ণকেশী বেকহাম তখন ইংলিশ মিডিয়ার সোনার ডিম পাড়া হাঁস। রাজপরিবারের পর সব ক্যামেরার নজর শুধু বেকহামের দিকেই। আগের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড ছিল দর্শক, ইউরোতেও টাইব্রেকার দুর্ভাগ্যে জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে শিরোপা–স্বপ্ন। সব ব্যর্থতার গল্প পেছনে ফেলে বেকহামেই স্বপ্ন বুনেছিল ইংল্যান্ড। সেখানে প্রথম বাদ সাধলেন স্বয়ং কোচ গ্লেন হডল। ‘ফুটবলে মনোযোগ নেই’ আর ‘বেশি মিডিয়া কাভারেজ পাচ্ছে সে’, এমন অদ্ভুত দোহাই দিয়ে ইংলিশ নাম্বার সেভেনের বিশ্বকাপ যাত্রা শুরু হলো বেঞ্চে থেকে। এমনিতেই বিশ্বকাপ হয় ৪ বছরে একবার। সেখানে খেলতে এসেছেন ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে স্টাইলিস্ট তারকা। ক্যামেরার চোখ তাঁর দিকে থাকবে না তো কার দিকে থাকবে?

বেকহামকে বসিয়ে রাখার স্বাদও পেয়েছিলেন হডল। তিউনিসিয়ার বিপক্ষে উতরে গেলেও রোমানিয়াতে কাটা পড়ল ইংল্যান্ড। শিকেয় ঝুলে থাকা চাকরি আর নকআউট পর্বের আশা বাঁচাতে কলম্বিয়ার বিপক্ষে দলে জায়গা মিলল বেকহামের। ম্যাচের সময় তখন ২৯ মিনিট, দূরত্ব ৩০ গজ। বেকহামের দুর্দান্ত ফ্রি-কিক কলম্বিয়াকে ছিটকে দিল বিশ্বকাপ থেকে। এত দিন যে বেকহামে ভরসা করে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা খরচ করেছে ইংলিশ মিডিয়া, সব যেন উথলে দিলেন ইংলিশ নাম্বার সেভেন। সমগ্র ইংল্যান্ডের প্রিন্স তখন একজনই—ডেভিড বেকহাম!

নকআউট পর্বে ইংল্যান্ডের মুখোমুখি আর্জেন্টিনা। তাদের দ্বৈরথটা ধরতে সময়ের কাঁটা ধরে ঠিক ১৬ বছর পেছনে ফিরতে হবে, আটলান্টিকের বুকে গড়ে ওঠা এক দ্বীপরাজ্য ফকল্যান্ডে। সাড়ে ১১ হাজার কিলোমিটার দূরের দুই দেশ আর্জেন্টিনা আর যুক্তরাজ্য ছোট্ট একটা দ্বীপ নিয়ে জড়িয়ে পড়েছিল যুদ্ধে। যুদ্ধ জিতে ফকল্যান্ডের দখল নেয় ব্রিটিশরা, পতন হয় আর্জেন্টাইন সামরিক জান্তার। কিন্তু আর্জেন্টাইনদের বুকের মাঝে ফকল্যান্ড শব্দটা চির অধরা এক আক্ষেপের নাম। তাই তো বছর চারেক পর বিশ্বকাপের মঞ্চে ‘হ্যান্ড অব গড’ মঞ্চস্থ করেও উঁচু গলায় ম্যারাডোনা বলেন, ‘আমি একটুও লজ্জিত নই।’ এরপর আরও ১২ বছর অপেক্ষা করেছে ইংল্যান্ডবাসী। ম্যারাডোনার প্রশ্নের সমুচিত জবাব দিতে। অবশেষে ফ্রান্সে এসেছে সে সুযোগ। সময় এখন প্রতিশোধ নেওয়ার।

একদিকে পুরো ইংল্যান্ড যখন প্রতিশোধের আগুনে তপ্ত, ঠিক তার অন্যদিকে বেকহাম তখন আনন্দে উন্মাতাল। ইংল্যান্ড থেকে ফোন এসেছিল ভিক্টোরিয়ার, প্রথমবারের মতো বাবা হতে চলেছেন ডেভিড। পুরো টিমবাস যেন উৎসবের কারখানা। বেকহামের প্রাণখোলা হাসি যে কান্নায় রূপ নেবে, এমনটা হয়তো তাঁর একনিষ্ঠ নিন্দুকও ভাবেনি। ম্যাচের আগে আর্জেন্টাইনদের একটু তাতিয়ে দিতে ছাড়ল না ক্রীড়াসামগ্রী নির্মাতা অ্যাডিডাস। পোস্টারবয় বেকহামের ছবি দিয়ে তৈরি করল বিশাল এক পোস্টার। যাতে লেখা, ‘আজকের পর আর্জেন্টিনা-ইংল্যান্ড ম্যাচ স্মরণীয় হয়ে থাকবে একজন খেলোয়াড়ের পায়ের কাজের জন্য।’ অ্যাডিডাস তখন হয়তো আঁচও করতে পারেনি, কাঁটা হয়ে ছোড়া প্রতিটি শব্দ হুল ফোটাবে তাদের গায়ে।

প্রথমার্ধের ১০ মিনিটের মাথায় দুই পেনাল্টি, প্রথমার্ধ শেষ হতে না হতেই চার গোল, ২-২ গোলের সমতা। কিন্তু মূল ঘটনার সূচনা ম্যাচের ৪৭ মিনিটের মাথায়। বেকহামকে মাঝমাঠে ধাক্কা মেরে বসেন আর্জেন্টাইন অধিনায়ক ডিয়েগো সিমিওনে। মাটিতে লুটিয়ে থাকা বেকহামের পিঠে চাপড় দিয়ে তাঁকে উঠতে বলেন সিমিওনে। এমন সময়ই ডান পা ভাঁজ করে সিমিওনের হাঁটুতে আঘাত করে বসেন ইংলিশ তারকা। সামনে থেকে সবটাই দেখছিলেন ডেনিশ রেফারি কিম মিল্টন। পকেট থেকে বের করে আনলেন লাল কার্ড, সরাসরি বহিষ্কার করলেন মাঠ থেকে।

এরপরের গল্পটা শুধুই হতাশার। ম্যাচ গড়িয়েছে পেনাল্টিতে, ইউরোর পর বিশ্বকাপেও ইংল্যান্ডের কপাল পুড়েছে টাইব্রেকারে। সবটা বুকে পাথরচাপা দিয়ে দেখেছেন বেকহাম। ম্যাচ শেষে আর্জেন্টিনার বুনো উল্লাস দেখে মুখ লুকিয়েছেন বাবার কোলে। যে ডান পা ছিল বেকহামের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ, সেই ডান পা-ই হয়ে উঠল তার অভিশাপ। ২৪ ঘণ্টা আগেও যে মানুষটা ছিলেন ইংল্যান্ডের নায়ক, দিনের ব্যবধানে তিনি ‘পাবলিক এনিমি নাম্বার ওয়ান’।

রাজার আসন থেকে আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলতে একমুহূর্ত সময় নেয়নি ইংলিশ মিডিয়া। ট্যাবলয়েডের পাতায় শিরোনাম হয়েছে, ‘১০টি সিংহ ও একজন বোকা বালক।’ চার্চের সামনে বিশাল ইলেকট্রিক বোর্ডে লেখা উঠেছে, ‘ঈশ্বর সবাইকে ক্ষমা করেন, এমনকি বেকহামকেও।’ ইংল্যান্ড থেকে পালিয়ে গিয়েও বাঁচতে পারেননি তিনি। কিছুদিন পরপরই তাঁর বাসার সামনে লোকজন জড়ো হতো। সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী, সন্তানকে নিয়ে এতটাই উৎকণ্ঠায় থাকতেন যে তাঁদের ম্যানচেস্টারের বাসায় রাখতেনই না তিনি। নিজের দলের সমর্থকেরা পর্যন্ত মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল তাঁর দিক থেকে। বাসায়, মাঠে, ঘুমের ঘোরে; সব জায়গাতেই বেকহাম ব্যর্থ, ইংল্যান্ডের ‘ভিলেন নাম্বার ওয়ান’।

বেকহামের দুর্দিনে তাঁকে সন্তানের মতো আগলে রেখেছিলেন একজন—ইউনাইটেড কোচ স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন। অস্তমিত নন, উদীয়মান এক সূর্য বেকহাম, তা ভালো করেই জানেন তিনি। তাই তো তাঁকে কেন্দ্র করেই তৈরি করলেন রেড ডেভিলদের দল। ফলাফল? ইউনাইটেড ইতিহাসের সবচেয়ে সফল মৌসুমের নৈপথ্যের কারিগর তিনি। আধুনিক ফুটবলের প্রথম ট্রেবলজয়ী দল হলো ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড।

রেড ডেভিলের জার্সিতে সাফল্য যেখানে পায়ের সামনে লুটিয়ে পরছে, থ্রি লায়ন্সের জার্সিতে গল্পটা ঠিক উল্টো। ব্যর্থ ইউরো মিশনের মেজাজ হারিয়ে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করায় আবারও শিরোনামে বেকহাম। তত দিনে অবশ্য ইংলিশ মিডিয়াকে থোড়াই কেয়ার করেন তিনি। লক্ষ্য তাঁর একটাই—নিজেকে প্রমাণ করা। সে জন্য সমর্থকদের ভরসার পাত্র হওয়াটা খুব বেশি জরুরি। বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে ইংল্যান্ডের তথৈবচ অবস্থা সে সুযোগটাই করে দিল।

ইংল্যান্ডের কোচের সিট তখন ইউরোপের সবচেয়ে দামি হটসিট। কেউ ম্যাচ হেরে লজ্জায় স্টেডিয়ামের বাথরুম থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিচ্ছেন, কারও সঙ্গে আবার চুক্তিই হচ্ছে এক ম্যাচের। এর মাঝেই ইংল্যান্ডের কোচ হয়ে আসেন পিটার টেইলর। তাঁর অধীনে একমাত্র ম্যাচে আর্মব্যান্ড পরিয়ে দিলেন বেকহ্যামের হাতে। ভরসা রাখলেন ইংল্যান্ডের ভিলেনের ওপর। যদিও এক ম্যাচ খেলেই টেইলর বিদায় নিয়েছিলেন, তবে উতরে গিয়েছিলেন বেকহাম। নতুন কোচের অধীনে অধিনায়কত্বের আর্মব্যান্ড ছিল তাঁর হাতেই।

নতুন অধিনায়কের অধীনে ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ যাত্রায় এল আমূল পরিবর্তন। মিউনিখে পরাক্রমশালী জার্মানিকে ৫-১ গোলে হারানো, বাছাইপর্বে শীর্ষ স্থান দখল করা—সবকিছুতেই ছিল বেকহামের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অবদান। বাছাইপর্বের শেষ ম্যাচে এসে সামনে দাঁড়াল সমীকরণ। শেষ দিনে জার্মানি আর ইংল্যান্ডের সমান ১৬ পয়েন্ট, গোল ব্যবধানে এগিয়ে ইংল্যান্ড। অর্থাৎ বিশ্বকাপে সরাসরি যেতে হলে হয় জার্মানির সমান অথবা ভালো ফলাফল বের করতে হবে ম্যাচ থেকে। হেরে গেলেও একটা সুযোগ থাকবে বৈকি, কিন্তু বিন্দুমাত্র ঝুঁকি নিতে রাজি নন অধিনায়ক।

অক্টোবর ৬, ২০০১। সেই চিরচেনা ওল্ড ট্র্যাফোর্ড, গায়ে থ্রি লায়ন্সের জার্সি। ৭ নম্বর জার্সি পরা বেকহাম নামছেন হাতে আর্মব্যান্ড জড়িয়ে। লক্ষ্য একটাই, বিশ্বকাপ নিশ্চিত করা। সেদিনের বেকহামকে নিয়ে একটা উপন্যাস রচনা করলেও কম হয়ে যাবে। ফুটবলের ইতিহাস লেখা হলে তাতে অন্তত একটা প্যারাগ্রাফ আলাদা করে বরাদ্দ থাকবে ৬ অক্টোবরের ডেভিড বেকহামের জন্য। ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের প্রতিটি ঘাস সেদিন পেয়েছিল তাঁর ছোঁয়া। ৯০ মিনিটে ১৬ কিলোমিটার দৌড়ে ফুটবলের রেকর্ডবুকে করে নিয়েছিলেন নিজের আলাদা জায়গা। মাঠের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ছুটে বেড়িয়েছেন। বল যেখানে, সেখানেই বেকহাম। বাকি ছিল শুধু লক্ষ্যভেদ করা। কিন্তু ভাগ্যের কী নিদারুণ ফের, পোড়া কপালে সেটাই ছিল না।

উল্টো প্রথমার্ধে এগিয়ে নিজেদের এগিয়ে নিল গ্রিস। ইংল্যান্ড সমতায় ফিরল ৬৭ মিনিটে। বেকহামের ফ্রি-কিক থেকে টেরি শেরিংহাম ইংল্যান্ডকে ফেরালেন সমতায়। কিন্তু সে আনন্দ টিকল মাত্র এক মিনিট। ৬৯ মিনিটে এগিয়ে গেল গ্রিস। একটা গোলের জন্য ইংলিশ ক্যাপ্টেন তখনো দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন মাঠ। কিন্তু গোল তখনো অম্যাবস্যার চাঁদ। ক্রস করছেন, শট নিচ্ছেন, কিন্তু সব ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে গ্রিক–দেয়ালের কাছে গিয়ে। অন্যদিকে সময় ক্রমেই কমে আসছে।

ইংল্যান্ডের ম্যাচ শেষ হওয়ার আগেই ওপাশ থেকে খবর এল, গোলশূন্য ড্র করেছে জার্মানি। বিশ্বকাপ নিশ্চিত করতে ইংল্যান্ডের প্রয়োজন মাত্র এক পয়েন্ট। অর্থাৎ একটি মাত্র গোল। ৯০ মিনিটের খেলা ততক্ষণে শেষ, চলছে তিন মিনিটের অতিরিক্ত সময়। এমন সময়ই গোলবার থেকে ঠিক ৩০ গজ দূরে একটা ফ্রি-কিক পেলেন বেকহাম। হ্যাঁ, ফ্রি–কিক। আজকের আগে যে ফ্রি-কিক তাঁর কাছে ছিল ডাল-ভাতের থেকেও সহজ কিছু। আজকে এই ফ্রি–কিকই তাঁর কাছে জটিল এক গোলকধাঁধা। পুরো ম্যাচে গুনে গুনে ১০টি ফ্রি-কিক নিয়েছেন। একটিও লক্ষ্যভেদ করেনি। কোনোটি গোলরক্ষক থামিয়েছেন, কোনোটি থামিয়েছে বার। কোনোটি উড়ে গিয়ে পড়েছে স্ট্যান্ডে। বল জালে জড়ানো যেন বেমালুম ভুলে গিয়েছেন তিনি। ৯৩ মিনিটের ফ্রি-কিকটাই তাঁর শেষ সুযোগ। শেষ সুযোগ, ম্যাচে ফেরার। অতীত ভুলে ইংল্যান্ডের মানুষের কাছে নায়ক হওয়ার। সুযোগ ম্যানচেস্টারে নিজের বাসায় শান্তিতে ঘুমানোর নিশ্চয়তা পাওয়ার।

বেকহাম ৩০ গজ দূরে বল বসালেন, তিন পা পিছিয়ে নিজের আইকনিক স্টাইলে দাঁড়ালেন। হিট করলেন বলের ঠিক নিচে। টপ বিন! গোল! বুনো উল্লাসে ফেটে পড়লেন বেকহাম। সঙ্গে পুরো ইংল্যান্ড। দুই হাত শূন্যে ছুড়ে দিয়ে যেন জানান দিলেন, এই ফুটবল বিশ্বের তিনিই রাজা। আক্ষরিক অর্থেই সেদিন থেকে ইংল্যান্ডের রাজার মুকুট তুলে দেওয়া হয়েছিল তাঁর মাথায়। তিন বছর যে লাল কার্ড কুরে কুরে খেয়েছে বেকহামকে। এক মুহূর্তের জন্য ব্রিটিশ ট্যাবলয়েডগুলো ভুলতে দেয়নি সেই ভুলের কথা, তারাই ইংল্যান্ডের অবিসংবাদিত রাজা ঘোষণা করল বেকহামকে। নিজের ঘরে, নিজের মানুষদের সান্নিধ্যে ইংল্যান্ডে নিজের একনিষ্ঠ ভক্তে পরিণত করলেন দ্বিতীয়বারের মতো।

বেকহামের ফিরে আসার শেষ পর্ব তখনো মঞ্চস্থ হওয়া বাকি। আর মঞ্চটা তৈরি করে দিল ২০০২ কোরিয়া-জাপান বিশ্বকাপ। ইংল্যান্ড, আর্জেন্টিনার জায়গা হলো একই গ্রুপে। একদিকে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখা পরাক্রমশালী আর্জেন্টিনা। অন্যদিকে বেকহামে ভর করে বিশ্বকাপে সুযোগ পাওয়া ইংল্যান্ড। তার ওপরে আবার ইংলিশ অধিনায়কের ইনজুরি শঙ্কা। ’৮৬, ’৯৮–এর পুনরাবৃত্তি দেখার জন্য যখন ইংলিশরা টিভির সামনে বসেছেন, ইংলিশ অধিনায়কের মনে তখন চলছে অন্য গল্প, প্রতিশোধের রঙে লাল সে গল্প।

৪৪ মিনিটে পেলেন পেনাল্টি। মাঝ বরাবর শটের জোর এতটাই তীব্র ছিল যে গোলরক্ষক পা লাগালেও হয়তো সেটা ধরতে পারতেন না। বেকহামের এক গোলই যথেষ্ট ছিল টুর্নামেন্টের ফেবারিট আর্জেন্টিনাকে ছুড়ে ফেলতে। ‘হ্যান্ড অব গড’-এর ১৬ বছর পর, দুই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার কাছে নাস্তানাবুদ হওয়ার পর অবশেষে প্রতিশোধ নিতে পারল ইংল্যান্ড। আর সামনে থেকে তার নেতৃত্ব দিলেন ইংলিশ কাপ্তান, দ্য গোল্ডেন বয়, ডেভিড রবার্ট জোসেফ বেকহাম।

বেকহাম তাঁর এক ক্যারিয়ারে কম বাঁক দেখেননি। ইউনাইটেড থেকে রিয়াল মাদ্রিদ, মাঝখানে আমেরিকান ফুটবলের নব জোয়ারের নেতৃত্ব দেওয়া। সেখান থেকে মিলান, শেষমেশ পিএসজি। বেকহাম যেখানে গিয়েছেন, জিতে নিয়েছেন, রাতারাতি বনে গিয়েছেন আইকন। হেয়ারস্টাইল থেকে শুরু করে ট্যাটু (উল্কি), বেকহাম যা-ই করতেন, তা-ই হতো নতুন ট্রেন্ড। এখনো তাঁর জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্তের কথা জিজ্ঞেস করলে প্রথমে থাকবে ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে দেখা হওয়া, এরপর গ্রিস, অতঃপর আর্জেন্টিনা। মাঠে, মাঠের বাইরে সর্বজয়ী হয়েও বেকহামের পছন্দ তাঁর ব্যর্থতার গল্পটা। কারণ, গল্পটা শুধু ব্যর্থতার নয়, একজন ইংলিশ প্রিন্সের রাজা হয়ে ওঠার গল্প। ডেভিড বেকহাম থেকে ‘ডিবিসেভেন’ হয়ে ওঠার গল্প। ঘুরে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রমাণ করার গল্প।