দেড় যুগ পর দুই মিলানের লড়াই

দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন, লাল ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন ইতালির সান সিরো স্টেডিয়াম, এর মধ্যেই একে অপরের কাঁধে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মিলান নগরীর দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী—মাতেও মাতারাজ্জি ও রুই কস্তা।

৬৭ বছরের ইতিহাসে কম রোমাঞ্চের সাক্ষী হয়নি চ্যাম্পিয়নস লিগ। ফার্গি টাইম, ইস্তাম্বুল রূপকথা, ৯২.৪৮ থেকে গত মৌসুমের রিয়াল রূপকথা; চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসে গায়ে কাঁটা দেওয়া কামব্যাকের গল্প কম নেই। কিন্তু তবু যদি চ্যাম্পিয়নস লিগের ঐতিহাসিক ছবিগুলোর একটা তালিকা করো, তাতে সবার ওপরে স্থান পাবে ২০০৫ চ্যাম্পিয়নস লিগ সেমি ফাইনালের এই একটি ছবি। একদিকে দেবালয় পুড়ছে, অন্যদিকে নগরীর দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী শত্রুতা ভুলে একে অপরের সঙ্গী হয়ে তাকিয়ে আছেন অপলক দৃষ্টিতে।

এই শত্রুতার গল্পের সূচনা আজ থেকে ১১৫ বছর আগে, ইতালির সবচেয়ে সমৃদ্ধ নগরী মিলানে। ঊনবিংশ শতাব্দীর একদম শেষে ১৮৯৯ সালে দুই ইংলিশম্যানের হাত ধরে গোড়াপত্তন হয় মিলান ফুটবল ও ক্রিকেট ক্লাবের। মিলানজুড়ে তখন ক্লাব বলতে একটাই, পুরো মিলান ঐক্যবদ্ধ ছিল মিলান দলের ছায়াতলে। প্রথম এক দশকে ঐক্যবদ্ধ মিলান ছিল অপ্রতিরোধ্য। দেড় বছরের মাথায় প্রথম শিরোপা, এরপর নিয়মিত বিরতিতে শিরোপা জেতা, মিলানের জন্য সাফল্য ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। কথায় আছে, সুখে থাকলে ভূতে কিলায়। মিলান বোর্ডকে যেন সেই ভূতই কিলানো শুরু করল।

মিলানের কারিগর হার্বার্ট ক্লিপলিনের অবসরের পর থেকেই বিদেশি খেলোয়াড় নিয়ে গড়িমসি শুরু করে মিলান বোর্ড। ইতালিজুড়ে তখন লেগেছে জাতীয়তাবাদের হাওয়া। সেই হাওয়ায় পাল তুলে হঠকারী এক সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে মিলান বোর্ড। সামনের মৌসুম থেকে ব্রিটিশ বাদে অন্য কোনো বিদেশি খেলোয়াড়কে দলে না ভেড়ানোর সিদ্ধান্ত নিল তারা। দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল মিলান বোর্ড। সৃষ্টির শুরু থেকে যে বিদেশিরা ছিলেন মিলানের মূল স্তম্ভ, তাঁদেরই সরিয়ে নতুন দল গড়ার প্রস্তাব অনেকেই ভালো চোখে দেখেননি, বিশেষ করে তখনো দলে থাকা বিদেশিরা তো নয়ই। বিদেশি খেলোয়াড়দের নিয়ে কর্মকর্তারা ইস্তফা দেন মিলান বোর্ড থেকে। ১৯০৮ সালের ৯ মার্চ তৎকালীন মিলান ভেঙে তৈরি হয় নতুন এক ক্লাব—ইন্টারন্যাসিওনালে।

সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই দর্শন নিয়ে সূচনা হয় মিলানের দুই স্তম্ভের। জাতীয়তাবাদী চেতনায় ভরপুর এক দল ইতালিয়ান ছাড়া কাউকে দলে ভেড়াত না; অন্যদিকে দূরদূরান্ত থেকে বিদেশি খেলোয়াড়দের ডেকে আনত আরেক দল। ইন্টার নিজেদের পুরো অস্তিত্বই গড়ে তুলল মিলানের বৈপরীত্যে। মিলান যেখানে আপন করে নিয়েছিল লাল-কালো স্ট্রাইপ, ইন্টার সেখানে বেছে নিল নীল-কালো স্ট্রাইপ। ভাগাভাগি হয়ে গেল দুই দলের সমর্থকও। বিদেশি খেলোয়াড়দের নিয়ে ইতালির এলিট শ্রেণির কাছে সহজেই নিজেদের নাম পৌঁছে দিয়েছিল ইন্টার, অন্যদিকে ইতালিয়ানদের নিয়ে গড়ে ওঠা মিলানের সমর্থক হয়ে উঠল মিলানের খেটে খাওয়া শ্রমিকগোষ্ঠী।

শুরু হলো রোজানারি আর নেরাজ্জুরিদের মধ্যকার দ্বৈরথ্য, যা ১১৫ বছর পর এসেও অমলিন। বিদেশি খেলোয়াড়দের নিয়ে একদিকে যখন ইতালিতে রাজত্ব গড়ে তুলছিল ইন্টার, ইতালিয়ানদের নিয়ে অন্যদিকে ধুঁকে ধুঁকে মরছিল মিলান। ফলে বছর দশেকের মাথাতেই নিজেদের হঠকারী সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে মিলান, দুই হাতে গ্রহণ করতে থাকে বিদেশি খেলোয়াড়দের। কিন্তু তত দিনে বড্ড দেরি হয়ে গেছে, ঘরোয়া লিগে ইন্টারের ধারেকাছে আর পৌঁছানো হচ্ছিল না মিলানের।

এসি মিলানের খেলোয়াড়দের উল্লাস

রাজত্ব গড়তে না পারলেও মিলানে নিজেদের রাজ্য গড়ে ফেলার কাজ অনেক আগেই সেরে ফেলেছিল মিলান। ১৯২৬ সালে মিলান প্রেসিডেন্ট পিয়েরো পিরেল্লি একপ্রকার নিজের পকেটের টাকা দিয়েই গড়ে তোলেন স্বপ্নের সান সিরো স্টেডিয়াম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগপর্যন্ত সান সিরো ছিল একান্তই মিলানের। আর ইন্টার নিজেদের মাঠ হিসেবে বেছে নিয়েছিল ইতালির প্রাচীনতম মাঠ অ্যারিনা সিভিকাকে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের পর অ্যারিনা সিভিকায় খেলা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না ইন্টারের। মিলান কর্তৃপক্ষের একান্ত অনুরোধে মন গলে মিলানের, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইন্টারের সঙ্গে ভাগাভগি করে নেয় সান সিরো স্টেডিয়ামের মালিকানা। শুরু হয় এক মাঠে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর আভিজাত্যের লড়াই।

ষাটের দশকে নতুন প্রাণ পায় মিলান ডার্বি। সঙ্গে পায় গালভরা একটি নাম, ‘ডার্বি দেলা ম্যাডোনিয়া’। যে রাশভারী নাম এসেছে মিলানের বিখ্যাত ম্যাডোনিয়া ক্যাথেড্রাল থেকে। মিলানের উত্থান–পতনের ইতিহাসের সবটাই জড়িয়ে আছে এই ক্যাথেড্রালের সঙ্গে। ১৩৮৬ সালে শুরু হওয়া নির্মাণকার্য সমাপ্তির মুখ দেখেছে ১৯৬৫ সালে। ক্যাথেড্রালের প্রতিটি ইটে লেখা আছে মিলানের উত্থান-পতনের ইতিহাস। মিলান আর ইন্টারের দ্বৈরথও ঠিক একই সূত্রে গাঁথা। ইতালিয়ান ফুটবলের উত্থান–পতনের ইতিহাস যেন ‘ডার্বি দেলা ম্যাডোনিয়া’ এক পূর্ণাঙ্গ প্রতিচ্ছবি।

শুধু মিলান ডার্বির উত্তেজনার দিকে তাকিয়েই বলে দেওয়া সম্ভব, ঠিক কখন কখন ফুটবলে আধিপত্য বিস্তার করেছে ইতালি। আশির দশকের শুরু থেকে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি, ইতালিয়ান ফুটবলের স্বর্ণযুগ ছিল মিলান ডার্বিরও স্বর্ণযুগ। এক পাশে কার্লো আনচেলত্তির মিলান, অন্যদিকে লোথার ম্যাথিউসের ইন্টার। দুই ফিলসফিতে গড়ে ওঠা দুই দলের দ্বৈরথ ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে যে ছবির গল্প দিয়ে শুরু করেছি, সেটির ইতিহাস একবিংশ শতকের শুরুতে। শেষ যেবার চ্যাম্পিয়নস লিগে মুখোমুখি হয়েছিল দুই মিলান।

ইন্টার মিলানের খেলোয়াড়দের উল্লাস

সময়টা ২০০৫, ইউরোপিয়ান ফুটবলে তখন ইতালির রাজত্ব। সান সিরোতে মুখোমুখি দুই মিলান। প্রথম লেগে জ্যাপ স্টাম আর শেভচেঙ্কোর গোলে ২-০–তে ম্যাচ শেষ করে মিলান। ফিরতি লেগে ৩০ মিনিটে শেভচেঙ্কোর গোলে এগিয়ে যায় মিলান। সেমি নিশ্চিত করতে অবিস্মরণীয় কিছুর দরকার ছিল ইন্টারের। সেটা এলও ৭০ মিনিটে। এস্তেবান ক্যাম্বিয়াসোর গোল নাকচ করে হলুদ কার্ড দেখান রেফারি। মুহূর্তেই ফেটে পড়ে সান সিরো। মিলান গোলপোস্টের দিকে ছুটে আসতে থাকে পানির বোতল, ফ্লেয়ার, লাইটার। মিলান গোলরক্ষক দিদার সামনে এসে বিস্ফোরিত হয় একটি ফ্লেয়ার। মুহূর্তেই সান সিরো পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। একদিকে মিলান সমর্থকদের উল্লাস, অন্যদিকে ইন্টার সমর্থকদের দুয়োধ্বনি। ফুটবলের দেবালয় সান সিরো রাতারাতি পরিণত হলো ধোঁয়াটে এক মহারণে। আর এত কিছুর মধ্যে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মাতেও মাতারাজ্জি ও রুই কস্তা একে অপরের কাঁধে ভর দিয়ে দেখছেন সেই দৃশ্য। শত বছরের ইতিহাস, দ্বৈরথ ছাপিয়ে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর কাঁধে হাত রাখা ছবি হয়ে রইল মিলান ডার্বির প্রতিচ্ছবি।

শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা আর মাঠে গড়ায়নি। এসি মিলানকে ওয়াকওভার দিয়ে জিতিয়ে দেওয়া হয়েছিল ম্যাচে। সেবারই ফাইনালে এসি মিলানকে হারিয়ে ইস্তাম্বুল রূপকথা গড়েছিল লিভারপুল। অথচ সেই চ্যাম্পিয়নস লিগের আইকনিক ছবির পাত্র হয়ে আছেন মাতেও মাতারাজ্জি ও রুই কস্তা। শত বছরের দ্বৈরথ সান সিরোতে এসে পরিণত হয়েছে বন্ধুত্বে।

চ্যাম্পিয়নস লিগের সর্বশেষ লড়াইয়ে জয়ী হয়েছিল এসি মিলান

গত দশকের পুরোটাই ছিল ইতালিয়ান ফুটবলের জন্য এক ক্রান্তিকাল। এক কোভিডে আক্রান্ত ইউরো জয় বাদে ইতালিয়ান ফুটবলকে খুঁজে পেতে হয়েছে পত্রিকার শেষ পাতায়। আন্তর্জাতিক থেকে ক্লাব—কোনো ফুটবলেই আলোর দিশা পায়নি ইতালি। দুই মিলানের দৈন্যদশার ভুক্তভোগী হতে হয়েছে ইতালিকে। ১৮ বছর পর ইতালির আশা হয়ে ফিরছে সান সিরো। নিজের সন্তানদের নিয়ে সান সিরো ফিরেছে চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমি ফাইনালে। চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিতে মিলান ডার্বির প্রত্যাবর্তন আবারও সান সিরোর গায়ে আগুন জ্বলাবে কি না, সে উত্তর দেওয়া মুশকিল। কিন্তু মাঠে ফুটবলের আগুন লাগাতে যে বিন্দুমাত্র পিছপা হবে না দুই দল, তা গ্যারান্টি দিয়েই বলে দেওয়া যায়।