সেই স্যামিও বাঁচাতে পারলেন না ওয়েস্ট ইন্ডিজকে

স্যামি ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের হাল ধরেছিলেন কোচ হয়ে

ড্যারেন ক্রস যখন বলটা মিড উইকেটের ওপর দিয়ে তুলে দিয়েছেন, ততক্ষণে স্কটল্যান্ডের জয় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে। ডাগ-আউটে চলছে বুনো উল্লাস, মাঠেও দুই সতীর্থ জড়িয়ে ধরেছেন দুজনকে। স্কটল্যান্ডের জয়োল্লাস পাশ কাটিয়ে ক্যামেরার নজর গিয়ে আটকাল ড্যারেন স্যামির দিকে। লজ্জায়, অপমানে তিনি যেন মুখ লুকোনোর জায়গা খুঁজছেন। নিজের সিট থেকে উঠে অভিবাদন জানালেন স্কটল্যান্ডের টিম ম্যানেজমেন্টকে। বিরস বদনে ডাগ-আউট থেকে গুটি গুটি পায়ে নেমে আসতে শুরু করলেন মাঠে।

ড্যারেন স্যামির মাটিতে নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে যেন মাটিতে মিশে গেল রাজকীয় ওয়েস্ট ইন্ডিজের আভিজাত্য। যাঁদের নাম শুনলে প্রতিপক্ষের গলা শুকিয়ে যেত, যাঁদের বিপক্ষে বল করতে প্রতিপক্ষের হাঁটু কাঁপত, সেই তাঁরাই কি না আজ বিশ্বকাপের বাইরে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের যে আভিজাত্যের সূচনা হয়েছিল ক্লাইভ লয়েডের হাত ধরে। তার ইতি টানা হলো ২০২৩ সালের জুলাই মাসের ১ তারিখ। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের দ্বাদশ আসরের পর্দা উঠতে চলেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ছাড়াই।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ কোনো স্বাধীন দেশ নয়। বরং ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের কয়েকটি দ্বীপরাষ্ট্র; যেমন বার্বাডোজ, জ্যামাইকা, গুয়ানা, অ্যান্টিগা, ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো নিয়ে তৈরি করা একটি স্বাধীন ক্রিকেট বোর্ড। যার অধীনে সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে ক্রিকেট খেলে আসছে দ্বীপরাষ্ট্রগুলো। ক্যারিবিয়ানদের মূল উত্থানটা হয় এক দিনের ক্রিকেটের সূচনালগ্নে। ক্লাইভ লয়েডের হাত ধরে এক দিনের ক্রিকেটে রাজত্ব শুরু করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বিশ্বকাপের প্রথম দুই আসরে তাদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া দূরে থাক, সমানে সমান লড়াই করার মতো দল ছিল না। লর্ডসের মঞ্চে বিশ্বকাপ মানেই ক্লাইভ লয়েডের হাতে শিরোপা।

সেই রাজত্বে হানা দিলেন কপিল দেব। আনকোরা এক ভারতকে নিয়ে হানা দিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিশাল সাম্রাজ্যে। ১৯৮৩ সালে বিশ্বকাপ ফাইনালে পচা শামুকে পা কাটল লয়েড বাহিনীর। ভারতের কাছে হেরে রাজার আসন থেকে বিচ্যুত হলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সেই যে রাজত্ব হাতছাড়া হলো, সেই রাজ্যের ধারেকাছে আর ভেড়া হয়নি তাদের। ভিভ রিচার্ডস থেকে ম্যালকম মার্শাল, কার্ল হুপার থেকে ব্রায়ান লারা; সবাই ইতিহাসের পাতায় নিজেদের নাম লিখিয়েছেন। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজকে শীর্ষে নিতে পারেননি। পেরেছিলেন একজন, নাম তাঁর ড্যারেন জুলিয়াস গার্ভি স্যামি।

কাগজে-কলমে তাঁর পরিচয় ছিল অলরাউন্ডার। কিন্তু মাঠে নামলে বোঝা যেত, ব্যাট কিংবা বল হাতে তিনি যতটা না বেশি শাণিত, তার থেকে বহুগুণ বেশি শাণিত তাঁর মুখের হাসি। ২ ওভারে ১০ রান ঠেকিয়ে দেওয়া হোক কিংবা আর শেষ ওভারে ১৯ রান তাড়া করা, স্যামির কপালে চিন্তার বলিরেখা পড়তে দেখা যায়নি কোনো দিনই। স্যামি যেন কুসুমকুমারী দাশের ‘আদর্শ ছেলে’, মুখে হাসি, বুকে বল; তেজে ভরা মন। এই একটি গুণই তাঁকে আলাদা করেছে ক্রিকেট ইতিহাসের সব অধিনায়ক থেকে। এই একটি গুণই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে উপহার দিয়েছিল তাদের দ্বিতীয় স্বর্ণযুগ।

ড্যারেন স্যামির মাটিতে নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে যেন মাটিতে মিশে গেল রাজকীয় ওয়েস্ট ইন্ডিজের আভিজাত্য

২০১০ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়কত্ব হাতে পান ড্যারেন স্যামি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বিতীয় স্বর্ণযুগ তৈরির পরিকল্পনা শুরু করেন সেদিন থেকেই। স্যামি বুঝেছিলেন, এই দলে টেস্ট কিংবা ওয়ান-ডে ক্রিকেট খেলার মতো ধৈর্যশীল খেলোয়াড় যত না আছেন, তার থেকে বেশি আনাগোনা টি-টোয়েন্টির ফেরিওয়ালাদের। তাই পাখির চোখ করলেন শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত ২০১২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপকে। তত দিনে বোর্ডের সঙ্গে ঝামেলায় চুক্তি স্বাক্ষর করেননি অনেকে, জাতীয় দলের প্রতি ভালোবাসাও দিন দিন লোপ পাওয়ার পথে। এমন সময় প্রতিটি খেলোয়াড়কে এক করে ধরলেন শ্রীলঙ্কার প্লেন। লক্ষ্য বিশ্বকাপ। সবাইকে অবাক করে দিয়ে বিশ্বকাপ শিরোপা ঘরে তুলল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। শুরু হলো ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বিতীয় স্বর্ণযুগ।

৪ বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বদলে যায় দৃশ্যপট। ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের এক মাস আগেও নিশ্চিত ছিল না, বিশ্বকাপে আদৌ অংশ নিতে পারবে কি না ওয়েস্ট ইন্ডিজ। খেলোয়াড়দের রাজি করা দূরে থাক, জার্সি তৈরির টাকা পর্যন্ত ছিল না বোর্ডের কাছে। অপারগ হয়ে বোর্ড শরণাপন্ন হয় ড্যারেন স্যামির। বিশ্বকাপের মাত্র এক মাস আগে বিশ্বকাপের জন্য দল তৈরির দায়িত্ব নেন স্যামি। ক্রিস গেইল, ডোয়াইন ব্রাভো, মারলন সামুয়েলস, সুলিমান বেন থেকে শুরু করে আন্দ্রে রাসেল, কার্লোস ব্রেথওয়েট; ঘুরে ঘুরে সবাইকে রাজি করান, শেষবারের মতো লড়াই করতে চান। বাদামি জার্সিটার জন্য, ওয়েস্ট ইন্ডিজ নামটার জন্য। নিজেদের আত্মসম্মানের জন্য।

অধিনায়কের কথা ফেলতে পারেননি কেউ। রাজি হয়ে যান বিশ্বকাপের জন্য। দুই সেট জার্সি আর খেলার সরঞ্জাম নিয়ে ভারতে পা রাখে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বাকিটুকু নিয়ে মহাকাব্য লিখলেও যেন কম হয়ে যাবে। স্যামির ভরসার মূল্য দিয়েছিলেন সবাই মিলে। কোনো দিন ব্যাট হাতে গেইল, কোনো দিন সামুয়েলস; কোনো দিন বল হাতে সুলিমান বেন, আবার কোনো দিন আন্দ্রে রাসেল; প্রতি ম্যাচেই কেউ না কেউ জ্বলে উঠে দলকে পৌঁছে দিয়েছেন জয়ের সীমানায়। আর ফাইনালে? অচেনা এক কার্লোস ব্রেথওয়েট, বেন স্টোকসকে টানা ৪ ছক্কা হাঁকিয়ে নিজেদের করে নিলেন শিরোপা। দ্বিতীয়বারের মতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতে নিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সেবার শুধু ওয়েস্ট ইন্ডিজের পুরুষ দল নয়, নারী দলও উঁচিয়ে ধরেছিল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা। ড্যারেন সামি তাঁদের সঙ্গে নিয়েই মেতে উঠেছিলেন আনন্দে। ‘চ্যাম্পিয়ন’ গানের সুরে শুধু ওয়েস্ট ইন্ডিজ নয়, মাতল পুরো বিশ্ব।

বিশ্বকাপের মূল মঞ্চে উঠতে ব্যর্থ হলো ক্যারিবিয়ানরা

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের প্রতিদান হিসেবে স্যামিকে কী দেওয়া হয়েছিল জানো? অর্ধচন্দ্র! বিশ্বকাপ ফাইনালই ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের জার্সিতে ড্যারেন স্যামির শেষ ম্যাচ। কারণ হিসেবে বোর্ড দেখিয়েছিল স্যামির বাজে ফর্ম। পুরো বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে একজনই ব্যাটে-বলে ফ্লপ ছিলেন, অধিনায়ক ড্যারেন স্যামি। ফাইনালের প্রেস কনফারেন্সে বলা কথাটাই হয়ে থাকল ওয়েস্ট ইন্ডিজের জার্সিতে তাঁর শেষ কথা, ‘আমি জানি না আবার কবে এই দলের সঙ্গে আমি খেলতে পারব। কিন্তু আমি গর্বিত এই দলের অধিনায়কত্ব করতে পেরে। আমি গর্ব করে বলতে পারব, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইজ দ্য চ্যাম্পিয়ন।’

স্যামির বিদায়ের পর থেকেই ছন্নছাড়া হয়ে পড়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেট। নামীদামি খেলোয়াড় এসেছেন বটে, কিন্তু অধিনায়ক আসেননি। ঢাল, তলোয়ার, সৈনিক সবই আছে, শুধু সেনাপতির বড্ড অভাব। তাই তো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের তিন বছরের মাথাতেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে খেলতে হয়েছে ওয়ানডে বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব। সেবার বৃষ্টির দয়ায় স্কটল্যান্ডকে হারিয়ে বিশ্বকাপে জায়গা পায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ২০২১ ও ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও যাচ্ছেতাই পারফরম্যান্স ওয়েস্ট ইন্ডিজের। সামনে আবারও বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব। এলোমেলো দলকে এক করতে আবারও সেই ড্যারেন স্যামির কাছেই ফিরে গেল ওয়েস্ট ইন্ডিজ বোর্ড। এবার আর অধিনায়ক নয়, স্যামি হাল ধরলেন কোচ হয়ে। কিন্তু ভাগ্য বদলাতে পারলেন না ওয়েস্ট ইন্ডিজের। জিম্বাবুয়ে, নেদারল্যান্ডস আর স্কটল্যান্ডের কাছে বাজেভাবে হেরে বিশ্বকাপের মূল মঞ্চে উঠতে ব্যর্থ হলো ক্যারিবিয়ানরা। নিজেদের হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা ড্যারেন স্যামিও বাঁচাতে পারলেন না এই লজ্জা থেকে।