কেন আমেরিকাকে বেছে নিলেন মেসি

২০১৮ সালের জানুয়ারি মাস। মেজর লিগ সকারের ২৫তম ক্লাব হিসেবে অভিষেক হয় ইন্টার মায়ামির। ফুটবলার, অভিনেতা, মডেলের পর ডেভিড বেকহাম আবির্ভূত হন ফুটবল ক্লাবের মালিক হিসেবে। সেদিন তাঁকে অভিনন্দন জানাতেই ইনস্টাগ্রামে একটি ভিডিও বার্তা পৌঁছে দেন লিওনেল মেসি। যার শেষটা ছিল, ‘আজ থেকে বছর কয়েক পরে, যদি দরকার হয়, একটা ফোন দিয়ো।’

ডেভিড বেকহাম সেই ফোন কলটাই করেছেন। লিওনেল মেসির পিএসজি ছাড়া যখন নিশ্চিত হয়েছে, তখনই তাঁকে দলে ভেড়ানোর জন্য লড়াই শুরু হয়েছে দলগুলোর মধ্যে। একদিকে সৌদি আরবের টাকার বস্তা, অন্যদিকে বার্সেলোনার নিজের ঘরে ফেরার টান। অথচ সব টান তুচ্ছ করে লিওনেল মেসি তাঁর নতুন ঘর হিসেবে বেছে নিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রকে। কিন্তু কেন? কী এমন ছিল মায়ামির অফারে, যা সৌদি বা বার্সেলোনায় পাননি মেসি?

ক্যারিয়ারের শেষবেলায় আমেরিকান লিগে যোগ দেওয়া ফুটবলারদের জন্য নতুন কিছু নয়। পেলে থেকে শুরু করে গার্ড মুলার,  ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার এমনকি মেসির আইডল ইয়োহান ক্রুইফ; ক্যারিয়ারের পড়ন্তবেলায় ইউরোপ ছেড়ে পাড়ি দিয়েছেন আমেরিকায়। কিন্তু মেজর লিগ সকার বদলে যায় ডেভিড বেকহামের আগমনের পর। ১৯৯৩ সালে নতুন করে ব্র্যান্ডিং হলেও বড় তারকা আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হচ্ছিল মেজর লিগ সকার। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত ক্যারিয়ারের পড়ন্ত বেলায় খেলোয়াড়দের পছন্দ ছিল নিজেদের প্রথম ক্লাব। আমেরিকান টাকার দিকে তখনো সেভাবে নজর পড়েনি কারও। ডেভিড বেকহামের আগমন আবারও চাঙা করে তোলে মেজর লিগ সকারকে। সে সময় ডেভিড বেকহামের সামনে অকল্পনীয় এক চুক্তি উপস্থাপন করে এলএ গ্যালাক্সি। আর লিওনেল মেসির সামনে যে চুক্তি উপস্থাপন করেছেন বেকহাম, তা তাঁর নিজের চুক্তির কাছে কিছুই না।

লিওনেল মেসি অবশ্য বারবারই বলে এসেছেন, তাঁর কাছে টাকার অঙ্কটা মুখ্য নয়, বরং সম্মানটা মুখ্য। সৌদি আরবের টাকার বস্তা তাই তাঁকে টানেনি। আর বার্সেলোনার কাছে যে সম্মানটা আশা করেছিলেন, তা পাওয়া হয়নি তাঁর। চুক্তি ভেঙে যাওয়ার পরদিনই বার্সেলোনা ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা দিয়েছে, আরাম–আয়েশ করার জন্যই নাকি বার্সেলোনাকে বাদ দিয়ে মায়ামিকে বেছে নিয়েছেন মেসি। নিজেদের সবচেয়ে বড় তারকাকে এমন দৃষ্টিকটু বলার পর আর যোগ দেওয়ার অবস্থা থাকে?

অন্যদিকে মেসির চাওয়া-পাওয়া দুটিই পূরণ করেছে ইন্টার মায়ামি। সৌদির মতো টাকার বস্তা খুলে না দিলেও যথাযথ সম্মান দিয়েছে। তাই বলে টাকার অঙ্কে চুক্তিটা কিন্তু কম বড় নয়। মেসির সঙ্গে ইন্টার মায়ামির চুক্তি মোট আড়াই বছরের। এই আড়াই বছরে শুধু বেতন হিসেবে তাঁর পকেটে ঢুকবে ১৫০ মিলিয়ন ডলার। বছরে প্রায় ৬০ মিলিয়ন ডলার। পিএসজিতে থাকাকালীন যা ছিল ৪০ মিলিয়ন ডলার। মেজর লিগ সকারের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বেতনপ্রাপ্ত খেলোয়াড় এখন মেসি। কিন্তু মাঠের বেতন মেসির সঙ্গে হওয়া চুক্তির একাংশ মাত্র। চুক্তির বিশাল একটা অংশ রয়ে গিয়েছে মাঠের বাইরে, যার অংশীদার বিশ্বের হেভিওয়েট দুই ব্র্যান্ড অ্যাডিডাস আর অ্যাপল।

ইন্টার মায়ামির সভাপতি ও মালিক ডেভিড বেকহামের সঙ্গে লিওনেল মেসি
ছবি: টুইটার

ইন্টার মায়ামি আর তাদের মালিক ডেভিড বেকহামের সঙ্গে আগে থেকেই বিশাল চুক্তি রয়েছে অ্যাডিডাসের। সে চুক্তিতে নতুন করে যুক্ত হয়েছেন মেসি। ইন্টার মায়ামির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করার পর থেকে চুক্তির শেষ দিন পর্যন্ত মেসির নামসংবলিত যত জার্সি বিক্রি করবে অ্যাডিডাস, তার একটা অংশ যাবে মেসির পকেটে। গত দুই মৌসুমে শুধু লিওনেল মেসির জার্সি বিক্রি করেই ২৫০ মিলিয়ন ইউরো লাভ করেছে পিএসজি। শুধু প্রথম বছরেই বিক্রি হয়েছে ১০ লাখ জার্সি। অ্যাডিডাসের দুঃখটা এখানেই। মেসির ক্যারিয়ারের শুরু থেকে তাঁর স্পন্সর হয়েও জার্সি বিক্রির লাভটা কখনো নিজেদের পকেটে পুরতে পারেনি তারা। বার্সা ও পিএসজিতে লাভের গুড় খেয়েছে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী নাইকি। এবার তাই সুযোগটা ছাড়েনি অ্যাডিডাস। ইন্টার মায়ামিতে সে সংখ্যাটা যে আরও বাড়বে, তা বলাই বাহুল্য। আগামী দুই বছরে কম করে হলেও ১০০-১৫০ মিলিয়ন ইউরো অনায়াসে পেতে চলেছেন মেসি।

অন্যদিকে অ্যাপলের পরিকল্পনা আরও বড়। গত বছর মেজর লিগ সকারের সঙ্গে ১০ বছরের চুক্তি স্বাক্ষর করেছে অ্যাপল টিভি। অ্যাপল টিভির সাবস্ক্রিপশন ছাড়া পৃথিবীর কোনো প্রান্তেই মেজর লিগ সকার দেখা সম্ভব নয়। মেসিকে দেখতে চাইলে পকেট থেকে ১০ ডলার খরচ করতে হবে কমবেশি সবাইকেই। আর যতজন খেলা দেখার জন্য অ্যাপল টিভির সাবস্ক্রিপশন কিনবেন, তারাই সরাসরি টাকা পৌঁছে দেবেন মেসির পকেটে। অ্যাপল টিভির প্রতিটি সাবস্ক্রিপশনের লভ্যাংশ যাবে মেসির পকেটে। এখানেই থেমে থাকেনি অ্যাপল, মেসির বিশ্বকাপ যাত্রা নিয়ে ইতিমধ্যে একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করেছে অ্যাপল টিভি। তাঁর ইন্টার মায়ামি যাত্রা নিয়েও তৈরি হবে আরেকটি ডকুমেন্টারি। পুরো ডকুমেন্টারি থেকে যা লাভ হবে, তারও একটা অংশ যুক্ত হবে মেসির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে।

মেসির কাছে সুযোগ আছে ডেভিড বেকহামের পদাঙ্ক অনুসরণ করার। আড়াই বছরের চুক্তি শেষে ইন্টার মায়ামির পাবলিক শেয়ারের একটি অংশের মালিক হবেন মেসি। শুধু মায়ামি নয়, ভবিষ্যতে চাইলে এমএলএসে নামমাত্র মূল্যে নতুন ক্লাবও কিনতে পারবেন তিনি। যে সুযোগ নিয়ে ডেভিড বেকহাম এখন ইন্টার মায়ামির মালিক।

আড়াই বছরে ১৫০ মিলিয়ন বেতন, সেই সঙ্গে বিশ্বের হেভিওয়েট দুই ব্র্যান্ডের চুক্তি। তার ওপর ছয় মাস ছুটি আর ছয় মাস ফুটবল। হলিউডের পাশে, বিশাল মায়ামির সমুদ্রসৈকত। চুক্তি শেষে ক্লাবের মালিকানাও ফ্রি। ক্যারিয়ারের শেষবেলায় লিওনেল মেসির এর থেকে বেশি আর কী-ই বা চাওয়ার আছে?