১৯৭৪-৭৮ বিশ্বকাপ: টোটাল ফুটবলের ব্যর্থ উপাখ্যান

১৯৭৪ বিশ্বকাপের পোস্টার

১৯৭৪ বিশ্বকাপ ছিল আক্ষরিক অর্থেই বিশ্বকাপের এক নতুন শুরু। দশম আসরে এসে পুরোপুরি পাল্টে ফেলতে হয় বিশ্বকাপের শিরোপা। গ্রিক দেবী নাইকির আদলে তৈরি করা ‘জুলে রিমে ট্রফি’ পাকাপাকিভাবে চলে গিয়েছে ব্রাজিলের ঘরে। সে শূন্যস্থান পূরণের জন্য ডাক পড়ে তামাম দুনিয়ার শিল্পীদের। আর সেখান থেকেই বেছে নেওয়া হয় ইতালিয়ান শিল্পী সিলভিও গাজ্জানিগার নকশা।

৩৬ সেন্টিমিটারের এই ট্রফিতে হাত উঁচু করে ধরে পৃথিবীকে ধরে রেখেছে দুজন অ্যাথলেট। ১৮ ক্যারেট সোনা দিয়ে তৈরি ট্রফির ওজন ৬.১ কিলোগ্রাম। যদিও বিশ্বকাপের আগেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, এই শিরোপা পাকাপাকিভাবে আর দেওয়া হচ্ছে না কাউকে। দিন শেষে শিরোপা ফেরত আসবে ফিফার কাছেই।

বিশ্বকাপ শিরোপার পাশাপাশি ফরম্যাটেও পরিবর্তন আনে ফিফা। আগের মতোই ১৬ দলকে ভাগ করা হয়েছিল ৪টি আলাদা গ্রুপে। প্রতি গ্রুপের সেরা দুই দল উঠবে দ্বিতীয় রাউন্ডে। ৪ গ্রুপ থেকে শীর্ষ ৮ দল আবারও ভাগ হয়ে যাবে ২টি গ্রুপে। দুই গ্রুপের সেরা দল খেলবে ফাইনাল। আর রানার্স আপ দল খেলবে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী।

বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে ছিল চমক। স্পেন, ইংল্যান্ড, হাঙ্গেরি, ফ্রান্সের মতো হেভিওয়েট দলকে বিশ্বকাপ মৌসুম কাটাতে হয় বাসায় বসে। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে নাম লেখায় পূর্ব জার্মানি, হাইতি, অস্ট্রেলিয়া ও জায়ার। ১৯৭৪ বিশ্বকাপই একমাত্র বিশ্বকাপ, যেখানে জার্মানির দুই প্রান্ত অংশ নিয়েছিল বিশ্বকাপে।

৭০-এর দশকে ফুটবলবিশ্ব পরিচিত হয় নতুন একধরনের ফুটবলি স্টাইলের সঙ্গে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশক যেখানে মেতে ছিল সাম্বা ফুটবলে, সেখানে সত্তরের দশকে নবজাগরণ ঘটে নেদারল্যান্ডসের টোটাল ফুটবলের। কোচ রেনাস মিশেল ও ইয়োহান ক্রুইফের হাত ধরে ফুটবল বিশ্বকে পাল্টে দেয় টোটাল ফুটবল। ৩৬ বছর পর বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়েই তাক লাগিয়ে দেয় নেদারল্যান্ডস।

অপরাজিত থেকে গ্রুপ করে নেদারল্যান্ডস। সাম্বা ফুটবল যে তাদের টোটাল ফুটবলের কাছে কিছুই না, তার প্রমাণ মেলে দ্বিতীয় রাউন্ডে। পরাক্রমশালী ব্রাজিলকে ২-০ গোলে হারিয়ে নিশ্চিত করে ফাইনাল। যদিও পেলে, গারিঞ্চা, গার্সনদের বিদায়ে অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল ব্রাজিল দল, তাতে কি? সাম্বা ফুটবলের বিপক্ষে এমন জয়, দর্শকের মন কেড়ে নিয়েছিল দ্রুতই।

অন্যদিকে অপর পাশ থেকে ফাইনাল নিশ্চিত করে স্বাগতিক পশ্চিম জার্মানি। যদিও তাদের শুরুটা হয়েছিল বেশ কঠিন। শিক্ষাদীক্ষা থেকে শুরু করে ফুটবল—সবকিছুতে যোজন যোজন এগিয়ে থাকা পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে বিশ্বকাপের শুরুতেই বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছিল পূর্ব জার্মানি। পশ্চিম জার্মানি তার শোধ নিল বাকি দলগুলোর ওপর। টানা জয় নিয়ে ফাইনালে উঠল তারা।

পূর্ব জার্মানির কাছে এক হার খোলনলচে বদলে দিয়েছিল পশ্চিম জার্মানির খেলার ধরনে। ফর্মের তুঙ্গে থাকা জার্মানি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটাল আবার। ২০ বছর আগে ঠিক যেভাবে পরাক্রমশালী হাঙ্গেরিকে হারিয়ে ‘জায়ান্ট হান্টার’ উপাধি পেয়েছিল, ঠিক একই পথে হাঁটা শুরু করল তারা। এবার তাদের প্রতিপক্ষ নেদারল্যান্ডস।

টুর্নামেন্ট–সেরা দলকে হারিয়ে শিরোপা উল্লাসে মেতে ওঠে পশ্চিম জার্মানি—এ যেন ১৯৫৪ বিশ্বকাপেরই ‘দেজা ভ্যু’

মিউনিখের অলিম্পিয়া স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হয় নেদারল্যান্ডস ও পশ্চিম জার্মানি। প্রথম মিনিট থেকেই নিজেদের ট্যাক্টিসে জার্মানিকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখে ইয়োহান ক্রুইফরা। প্রথম মিনিটেই ক্রুয়েফকে ডি বক্সের মধ্যে ফাউল করে বসেন উলি হোয়েনেস। ম্যাচের দুই মিনিটের মাথায় নেদারল্যান্ডসকে এগিয়ে নেন ইয়োহান ন্যাসকেন্স। সেটাই ছিল নেদারল্যান্ডসের শুরু ও শেষ। ২৬ মিনিটে পেনাল্টি থেকে জার্মানিকে সমতায় ফেরান পল ব্রেটনার। ৪৩ মিনিটে গার্ড মুলারের গোলে এগিয়ে যায় জার্মানি। সেটাই হয়ে থাকে নেদারল্যান্ডসের ১৯৭৪ বিশ্বকাপ যাত্রার শেষ পেরেক। টুর্নামেন্ট–সেরা দলকে হারিয়ে শিরোপা উল্লাসে মেতে ওঠে পশ্চিম জার্মানি—এ যেন ১৯৫৪ বিশ্বকাপেরই ‘দেজা ভ্যু’। ডমিনেট করে ফাইনালে এসে সেরা দলের হার দেখার।

১৯৭৮ বিশ্বকাপ: বিতর্কে ঠাসা বিশ্বকাপে

‘টোটাল ফুটবল’ কফিনে প্রথম পেরেক ঠুকেছিল পশ্চিম জার্মানি। আর দ্বিতীয় ও শেষ পেরেক হয়ে হাজির হয়েছিল আর্জেন্টিনা। আরও স্পষ্ট করে বললে আর্জেন্টাইন সরকার।

১৯৭৮ বিশ্বকাপের পোস্টার

সবচেয়ে পক্ষপাততুষ্ট বিশ্বকাপের কথা আসলে সবার আগে নাম আসবে ১৯৩৪ ইতালি বিশ্বকাপের। ফ্যাসিজমের কর্ণধার বেনিতো মুসোলিনি রেফারিদের সঙ্গে বসে ঠিক করতেন ম্যাচের ফলাফল। এরপর থেকেই ফিফা সিদ্ধান্ত নেয়, রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে—এমন কোনো দেশে বিশ্বকাপ আয়োজনের আগে দুবার ভাববে তারা।

যে কারণে বহু জোরাজুরির পরও কিছুতেই জার্মানি আর আর্জেন্টিনা নিজেদের দেশে বিশ্বকাপ আয়োজন করতে সক্ষম হচ্ছিল না। কিন্তু অবশেষে ফিফা মুখ তুলে তাকায় ১৯৭৮ সালে। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব পায় আর্জেন্টিনা। ১৬ বছর পর বিশ্বকাপ আবারও ফিরল লাতিন আমেরিকায়। কিন্তু ফেরাটা ঠিক সুখকর হলো না আর্জেন্টিনার জন্য।

বিশ্বকাপে শুরুর বছর দুই আগে আর্জেন্টাইন প্রেসিডেন্ট ইসাবেল মার্টিনেজ পেরনকে ক্ষমতাচ্যুত করে সামরিক সরকার গঠন করেন জেনারেল জর্জ রাফায়েল ভিদেলা। ক্ষমতা পাওয়ামাত্র শুরু হয় অসহনীয় অত্যাচার। এক এক করে গুম হতে শুরু করেন ভিন্ন মতাদর্শী লোকজন। এমনও শোনা যায়, সরকার গঠনের তিন মাসের মাথায় নিখোঁজ হন সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ।

আর্জেন্টিনা সরকারের এমন স্বৈরাচারী মনোভাবের প্রতি প্রথম আঙুল তোলেন তৎকালীন ফুটবলের অন্যতম সেরা তারকা নেদারল্যান্ডসের ইয়োহান ক্রুইফ ও জার্মানির পল ব্রেটনার। আর্জেন্টিনায় বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হলে সেখান থেকে নাম সরিয়ে নেওয়ার হুমকিও দেন তাঁরা। আর্জেন্টিনার রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে পৃথিবীর অনেক দেশই সেবার বিশ্বকাপ বয়কটের চিন্তাভাবনা শুরু করেছিল। এমন হুমকিতে নড়েচড়ে বসে ফিফা। কিন্তু এক বছরের মধ্যে বিশ্বকাপ অন্য কোথায় সরিয়ে নেওয়া অসম্ভব ব্যাপার ছিল তাদের জন্য। বিশেষ বিবেচনা ও নিয়ম-নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল মেনে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ আয়োজনের অনুমতি দেয় ফিফা। কিন্তু নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন ক্রুইফ ও ব্রিটনার। বিশ্বকাপ বয়কট করেন তাঁরা দুজনে।

কিন্তু বিশ্বকাপ ঘনিয়ে আসতেই শুরু হয় স্বৈরাচারী সরকারের প্রভাব। বিশ্বকাপের মাত্র কয়েক মাস আগেই গুম করে ফেলা হয় বিশ্বকাপ আয়োজক কমিটির প্রধানকে। বিশ্বকাপের শিডিউলেও আনা হয় ব্যাপক পরিবর্তন। আর্জেন্টিনার গ্রুপ পর্বের প্রতিটি ম্যাচের সময় নিয়ে যাওয়া হয় রাতে। যাতে গ্রুপের বাকি ম্যাচগুলোর ফলাফল জেনেই মাঠে নামার সুযোগ ছিল তাদের হাতে। আর তার পূর্ণ সুযোগ নেয় আলবেসিয়েস্তারা।

খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গ্রুপ পর্ব পার করে আর্জেন্টিনা। কিন্তু তাদের মূল খেলা শুরু হয় ব্রাজিল, পেরু ও পোল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় রাউন্ডে। নিজেদের প্রথম ম্যাচ জিতে নেয় ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা দুই দল। এরপর ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ম্যাচটি ড্র হয়। শেষ ম্যাচে পোল্যান্ডের বিপক্ষে ব্রাজিল ৩-১ গোলে জিতলে আর্জেন্টিনার জন্য সমীকরণ দাঁড়ায় শেষ ম্যাচে পেরুর বিপক্ষে অন্তত ৪ গোলের ব্যবধানে জিততে হবে তাদের।

সবাইকে অবাক করে দিয়ে সে ম্যাচ আর্জেন্টিনা জিতে নেয় ৬-০ গোলে। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছে যায় পেরু-আর্জেন্টিনা ম্যাচ। অভিযোগ ওঠে পাতানো ম্যাচের—ব্রাজিলের সাংবাদিকেরা নজর রাখতে শুরু করেন পেরুর খেলোয়াড়দের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। এমনকি পেরুর বামপন্থী নেতারা দাবি করেন, এই ম্যাচের পরই আর্জেন্টিনায় বন্দী থাকা পেরুর ১৩ বিদ্রোহীকে পেরুর হাতে তুলে দিয়েছিল আর্জেন্টাইন সরকার।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল পুরো টুর্নামেন্টে বাজে রেফারিং, মিডিয়ার চাপ, সামরিক লোকজনের মাঠে অবাধে আসা-যাওয়া করার অনুমতি। সব মিলিয়ে অদ্ভুত এক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল পুরো বিশ্বকাপে। বিশ্বকাপ ফাইনালে আরও প্রকট হয়ে ওঠে সে সমস্যা। একই হোটেল থেকে আর্জেন্টিনা দল যেখানে মাঠে পৌঁছে যায় সহজেই, নেদারল্যান্ডস দলকে সেখানে ঘুরিয়ে আনা হয় বহুদূর। এমনকি নেদারল্যান্ডস দাবি করে, ম্যাচের আগে তাদের ট্যাক্টিস চুরি করেছিল আর্জেন্টিনা। যদিও ম্যাচে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করেছিল নেদারল্যান্ডস। প্রথম ৯০ মিনিট শেষ হয়েছিল ১-১ গোলে। কিন্তু অতিরিক্ত সময়ে মারিও কেম্পেস ও রিকার্ডো বের্তোনির গোলে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ শিরোপা নিজেদের করে নেয় আর্জেন্টিনা।

পর্দার পেছনে সামরিক জান্তা সরকারের প্রভাব যতই থাকুক না কেন, ’৭৮ বিশ্বকাপ জয় সুগম করেছিল আর্জেন্টিনার বিশ্বযাত্রা। যার পথ ধরেই আর্জেন্টাইন ফুটবল রাঙিয়েছেন ম্যারাডোনা, বাতিস্ততা, রিকুয়েলমে, তেভেজ, মেসিরা।