ফিলিস্তিনের ফুটবল : যুদ্ধ ও মৃত্যুর মাঝে সাফল্যের রূপকথা

২০১৪ সালের কথা। ছোট্ট গাজা উপত্যকার ওপরে শকুনের মতো উড়ে বেড়াচ্ছে কিছু জেট বিমান। ভূমধ্যসাগরের তীরে বেড়ে ওঠা মাহমুদ ওয়াদির সেদিকে খেয়াল নেই। ফিলিস্তিনের জাতীয় ফুটবল দলে প্রথমবারের মতো ডাক এসেছে তাঁর। খোলা ময়দানে সবকিছু ভুলে ট্রেনিং করতে হচ্ছে তাঁকে। মাথার ওপরে থাকা ইসরায়েলের মহাপতঙ্গগুলোর পেট খুলে বেরিয়ে এল ডিম! সেগুলো যেখানেই পড়ছে, মুহূর্তের মধ্যে ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে দালানকোঠা-মসজিদ-হাসপাতাল সবকিছু। গোলাগুলির শব্দে তালা লেগে যায় কানে, কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করার সুযোগ নেই ওয়াদির। হয় মৃত্যু নয়তো ফুটবল—যেকোনো একটাই ভাগ্যে আছে তাঁর। যেটাই আসুক, সে প্রস্তুত।

সেবার মরতে হয়নি ওয়াদিকে। তবে ফিলিস্তিনের জাতীয় ফুটবল দলেও খেলতে পারেননি। খেলতে যাওয়ার জন্য যে অনুমতি দরকার, সেটা ইসরায়েল থেকে আসেনি। গাজা থেকে বের হতে পারেননি তিনি। যদিও শেষ পর্যন্ত ফিলিস্তিনের জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে ২০১৭ সালে অভিষেক হয়েছে তাঁর, কিন্তু যতবারই গাজায় নিজের বাড়িতে এসেছেন, প্রতিবারই বের হওয়ার অনুমতি না পেয়ে আটকে যেতে হয়েছে। কেবল ওয়াদিই নন, এই গল্পটা প্রায় গাজার প্রতিটি ফুটবলারের জন্য সত্য।

ফিলিস্তিন জাতীয় দলে ১৯ নম্বর জার্সি পরে খেলেন মাহমুদ ওয়াদি
ছবি: এএফপি

জীবন নাকি ফুটবল—এ রকম প্রশ্নে বহুবার ফুটবলকেই বেছে নিয়েছেন ফিলিস্তিনের ফুটবলাররা। কারণ, বিশ্বের বেশির ভাগ আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো যেখানে ফিলিস্তিনকে এখনো দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি, সেখানে ফিফা তাদের পূর্ণাঙ্গ সদস্যের মর্যাদা দিয়েছে ১৯৯৮ সালে। যদিও এর জন্য পোড়াতে হয়েছে বহু কাঠখড়!

আরও পড়ুন

ফিলিস্তিনিদের জীবনের সঙ্গে ফুটবল জড়িয়ে আছে বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে। অটোমান সাম্রাজ্যের পর ব্রিটিশদের অধীনে থাকাকালে ১৯২৮ সালে গঠিত হয় ‘প্যালেস্টেনিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন’, সে সময় ফিফাতেও যোগ দেয় তারা। কিন্তু আরব-অনারব-ইহুদিদের নিয়ে গড়া ওই ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন থেকে সরে আসে ফিলিস্তিনের আরব অধিবাসীরা। ‘আরব প্যালেস্টেনিয়ান স্পোর্টস ফেডারেশন’ গঠন করে নিজেদের ফুটবল দলও তৈরি করে তারা। ১৯৪৮ সালের পর ফিলিস্তিনের অনারব ও ইহুদিরা ইসরায়েলের অংশ হিসেবে ফুটবল দল গঠন করে ফিফার সদস্যপদ লাভ করে। কিন্তু তখনো ফিলিস্তিনের আরবরা নিজেদের ভূখণ্ডের দখল এবং ফুটবল দলের স্বীকৃতি পায়নি। তবু ১৯৯৮ সালের আগপর্যন্ত নিয়মিতই নিজেদের দল নিয়ে অন্য আরব দলের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচ খেলেছে ফিলিস্তিনিরা। এমনকি আরব কাপেও অংশ নিয়েছে তারা।

গাজার এক শরণার্থী শিবিরে ফুটবল খেলছে ফিলিস্তিনি তরুণেরা
ছবি: গেটি ইমেজ

১৯৯৮ সালে ফিফার তৎকালীন সেক্রেটারি এবং পরে প্রেসিডেন্ট সেপ ব্লাটার ফিলিস্তিনকে ফিফার পূর্ণাঙ্গ সদস্য হিসেবে ঘোষণা দেন। এরপরেই ফিলিস্তিনের ফুটবলে আসে চমকপ্রদ পরিবর্তন। নিজেদের ফুটবল দল তো ছিলই, এর পাশাপাশি তৈরি হয় নিজেদের লিগ। সেখানে খেলতে প্রতিবেশী আরব দেশের খেলোয়াড়েরা নিয়মিতই পাড়ি জমাতে থাকে। ধীরে ধীরে পরিবর্তন হয় ফুটবল-কাঠামো, উন্নত হয় প্রশিক্ষণব্যবস্থার। ফিফা বিশ্বকাপের বাছাইপর্বেও অংশ নিতে থাকে তারা। কিন্তু এর সবকিছুই প্রায় ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরকেন্দ্রিক।

বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ ২০২০-এ অংশ নিয়েছিল ফিলিস্তিন, হয়েছিল চ্যাম্পিয়ন
ফাইল ছবি

ফিলিস্তিনের দুটি অংশ—পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকা। এর মধ্যে পশ্চিম তীরের মানুষের জীবনযাপন এবং সুযোগ-সুবিধা গাজা উপত্যকার মানুষের চেয়ে ভালো। চারপাশে ইসরায়েল এবং অন্য এক পাশে মিসরে ঘেরা গাজা উপত্যকার মানুষেরা কখনোই সুদিন দেখেনি। মাত্র একটি পথ দিয়ে বাইরের দুনিয়ায় বের হতে পারে সেখানের বাসিন্দারা এবং সেই বের হওয়ার অনুমতিও আসে ইসরায়েল থেকে। ফলে ইচ্ছা থাকলেও যে কেউ পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিন লিগের ফুটবল খেলতে যেতে পারত না। যারা খেলত অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে উপত্যকা ছেড়ে দলের সঙ্গে যোগ দিতে হতো। অনেকবার নিজেদের মাঠেও স্বাগতিক হিসেবে ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করতে পারেনি ফিলিস্তিন। জোর করে খেলতে হয়েছে নিরপেক্ষ ভেন্যুতে।

নিজ ভূখণ্ডে এমন পরাধীন জীবনযাপন করেও মাঠের খেলায় বেশ ভালোই ফল আনতে থাকে ‘কেনানের সিংহ’খ্যাত ফিলিস্তিন ফুটবল দল। ২০১৪ সালে এএফসি চ্যালেঞ্জ কাপ জিতে প্রথমবারের মতো সুযোগ পায় এশিয়ার সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ফুটবল আসর এএফসি এশিয়ান কাপে খেলার। খুব ভালো কিছু করতে না পারলেও বড় আসরে খেলার অনুপ্রেরণায় আস্তে আস্তে তাদের ফুটবলের চেহারা পাল্টে যেতে থাকে। ২০১৮ সালে ফিফা র‍্যাঙ্কিংয়ে নিজেদের সেরা অবস্থানে (৭৩) পৌঁছায় তারা। তারপর ২০১৯ ও ২০২৩ সালের এশিয়ান কাপেও বাছাইপর্ব খেলে সরাসরি নিজেদের জায়গা নিশ্চিত করে। এত অল্প সময়ে ধ্বংসযজ্ঞ থেকে উঠে এশিয়ার প্রথম সারির দল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পারা রূপকথার চেয়ে কম নয়। এখন বাইরের অনেক ক্লাবেও নিয়মিত খেলতে দেখা যায় ফিলিস্তিনের ফুটবলারদের।

প্রতিনিয়ত সতীর্থ হারানোর ক্ষত নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়েছে ফুটবলারদের
ছবি: আল-জাজিরা

এত কিছু পাওয়ার মধ্যেও প্রতিনিয়ত সতীর্থ হারানোর ক্ষত নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়েছে ফুটবলারদের। একের পর এক ইসরায়েলের হামলায় গাজা ও পশ্চিম তীরে মারা গেছে ফিলিস্তিন লিগের ফুটবলার থেকে শুরু করে জাতীয় দলের ফুটবলারও। ধ্বংস হয়ে গেছে স্টেডিয়াম। এমনকি সম্প্রতি ২০২৬ বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব খেলতে দলের সঙ্গে যোগ দিতে পারেননি ইব্রাহিম আবুউমেইর, আহমেদ কুল্লাব ও খালেদ-আল-নাব্রিস। গাজায় করা ইসরায়েলের হামলায় বন্দী হয়ে পড়েছেন এই তিন ফুটবলার। বের হওয়ার কোনো রাস্তা নেই। এঁদের কেউ হারিয়েছেন নিজের বাড়ি, কেউ পরিবারের সদস্যদের। যেকোনো দিন মরতে হতে পারে তাদেরও! মৃত্যুকূপে বসে তাঁরা অনবরত দিন গুনছেন মৃত্যুর কিংবা ফুটবলের।

ফুটবলটা এ কারণেই শুধু আর খেলা হয়ে নেই ফিলিস্তিনিদের কাছে, এ যেন ফুটবল তাঁদের কাছে মৃত্যুকে ভুলে থাকার রাস্তা। ফুটবল পৃথিবীর কাছে নিজেদের কথা পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যম। এ যেন এক রূপকথা, চোখের পলকে বদলে দেবে তাঁদের জীবন!