মেসি-নেইমারহীন পিএসজির ভবিষ্যৎ কী?

লিওনেল মেসি যে আর পিএসজিতে থাকছেন না, তা অনেকটাই নিশ্চিত বলে মনে করছেন ফুটবল বোদ্ধারা। অনেক দিন ধরেই ক্লাবের দেওয়া নতুন কন্ট্রাক্ট অফার সাইন করছেন না তিনি। এরই মধ্যে ক্লাবকে না জানিয়ে সৌদি ভ্রমণ করায় পেয়েছেন শাস্তি। দুই সপ্তাহের বেতন কাটা পড়েছে, হয়েছেন নিষিদ্ধ। যদিও পিএসজির জার্সিতে তাঁকে মাঠে দেখা যাচ্ছে।

অন্যদিকে নেইমারের গল্পটা একটু অন্য রকম। ২০১৭ সালে রেকর্ড দামে পিএসজিতে ভিড়েছিলেন নেইমার। এর পর থেকে প্রতি দলবদলের মৌসুমেই গুঞ্জন ওঠে—পিএসজি ছাড়ছেন নেইমার। কখনো বার্সা, কখনো ইউনাইটেড, কখনো আবার রিয়াল মাদ্রিদ, নেইমারের নামের সঙ্গে যুক্ত করা যায়, এমন দলের অভাব নেই। কিন্তু প্রতিবারই মুখ থুবড়ে পড়ে ট্রান্সফার, পিএসজির জার্সিতেই মাঠে নামেন নেইমার।

মেসি-নেইমার পিএসজি ছাড়ছেন, এমন গুঞ্জন আগেও উঠেছে। পত্রিকার কাটতি বাড়ানোর জন্য সেরা তারকাদের অন্য দলে পাঠানো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। কিন্তু এই দলবদলের মৌসুম আর দশটা মৌসুমের মতো হবে না বলেই ধারণা করছেন সবাই। পিএসজি ছেড়ে মেসি-নেইমারের অন্য জার্সি গায়ে জড়ানোর সম্ভাবনা বেশ জোরালো। আগের মৌসুমগুলোতে পত্রিকা গুঞ্জন তুললেও সমর্থক থেকে শুরু করে বোর্ড, সবাই ছিলেন খেলোয়াড়দের পক্ষে। খেলোয়াড়দের দলে ধরে রাখতে সুযোগ–সুবিধা বাড়িয়ে দিয়েছে ক্লাব, ছুটি দিয়েছে, চেষ্টা করেছে খেলোয়াড়দের ব্র্যান্ড দিয়ে পিএসজির ব্র্যান্ডকে ওপরে তুলতে। সে ক্ষেত্রে সফলও তাঁরা। সমর্থকেরাও বিনা বাক্যে মেনে নিয়েছেন বোর্ডের সিদ্ধান্ত। সাফল্য যখন নিজে এসে লুটিয়ে পড়ছে পায়ের কাছে, তখন আর সমস্যা কোথায়?

সমস্যার সূচনা যখন সাফল্য আর আগের মতো ধরা দেয় না, তখন। পিএসজির কাছে লিগ জেতা এখন আর সাফল্য নয়, বরং নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। বরং তাদের পাখির চোখ চ্যাম্পিয়নস লিগ। আর সেখানেই দুই বছর ধরে মুখ থুবড়ে পড়ছে পিএসজি। গতবার এক করিম বেনজেমা ম্যাজিকে ইউরোপ থেকে ছিটকে পড়েছিল মেসি-নেইমার-এমবাপ্পে ত্রয়ী। আর এবার ছিটকে গেল বায়ার্নের কাছে হেরে। নকআউট পর্বে এমন লজ্জাজনক বিদায় প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে সবার মনে—আসলেও কি কোটি টাকা দিয়ে তৈরি করা দল সফলতার মুখ দেখছে? নাকি মেসি-নেইমার-রামোস নামগুলো হয়ে উঠছে বোঝা?

টাকাপয়সা নিয়ে কোনো দিনই সমস্যা ছিল না পিএসজির। ২০১১ সালে কাতারের মালিকানার অধীনে আসার পর থেকে পিএসজি যেদিকেই তাকিয়েছে, খুঁজে পেয়েছে স্বর্ণ। ইব্রাহিমোভিচ, থিয়াগো সিলভা, ডেভিড বেকহামদের সঙ্গে নিয়ে নিজেদের ভিত শক্ত করেছে তারা। একের পর এক লিগ জয়, ইউরোপে নিজেদের গুছিয়ে নেওয়া, পিএসজির স্বর্ণযুগের সূচনা তাদের হাত ধরেই। আরও বড় করে বলতে গেলে, তাদের বিদায়ের মধ্য দিয়েই অবসান ঘটেছে নির্ঝঞ্ঝাট পিএসজির দৌড়।

২০১৭ সালে প্রথম আটঘাট বেঁধে দলবদলের মৌসুমে নামে পিএসজি। ২২২ মিলিয়ন ইউরোর বদলে দলে ভেড়ায় নেইমারকে। যে নেইমার ছিলেন বার্সার বিখ্যাত ‘রেমন্টাদা’র মূল নায়ক। তাঁকে দলে ভিড়িয়ে পিএসজি একটা ঘোষণাই দিয়ে দেয়, আমরা চাইলে যে কাউকে দলে ভেড়াতে পারি। এক বছরের মাথায় ১৮০ মিলিয়নের বিনিময়ে কিলিয়ান এমবাপ্পে। ২০২১ সালে এক মৌসুমেই দলে যোগ দেন জিয়ানলুইজি ডোনারোমা, সার্জিও রামোস আর লিওনেল মেসি। যাঁদের দলে ভেড়াতে সর্বসাকল্যে খরচ হয়েছিল শূন্য টাকা! মডার্ন ডে গ্যালাক্টিকো তৈরির চিন্তা সব সময়ই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল প্রেসিডেন্ট নাসের-আল-খেলাইফির। কিন্তু সেই গ্যালাক্টিকো কাজ তো করেইনি, উল্টো বাদ সেধেছে তাদের লক্ষ্যে।

একটু লক্ষ করলেই বুঝতে পারবে, পিএসজি সব সময়ই বড় নামের পেছনে ছুটেছে। বড় নাম তাদের বড় ট্রফি এনে দেবে—এই চিন্তাই ঘুরপাক খেয়েছে টিম ম্যানেজমেন্টের মনে। দলের প্রয়োজনের কথা কখনোই তাদের মূল চিন্তায় আসেনি সেভাবে। এমবাপ্পে-নেইমার-মেসি ত্রয়ী কাগজে–কলমে সেরা। কিন্তু কাউন্টার অ্যাটাকে তাঁদের কাউকেই খুঁজে পাওয়া যায় না ডিফেন্সে। সার্জিও রামোস, কাগজে–কলমে এই সময়ের সেরা ডিফেন্ডার, কিন্তু বয়সের ভার যে তাঁর ওপরেও পড়েছে, তা নিয়ে ভাবেনি বোর্ড। ফলে যখনই গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ এসেছে, তাঁদের সাদা হাতিগুলোই হয়েছে কাল। পিএসজি বোর্ডের মনোযোগ এখন তাই সাদা হাতির দিকে নয়, বরং নিজেদের নৌকায় ফুটোগুলো ঠিক করতে।

পিএসজি বোর্ডের চোখে দলের মূল তারকা এখন এমবাপ্পে। মেসি-নেইমার থাকার পরেও গত দুই মৌসুমে দলের কান্ডারি হয়ে ছিলেন এই এমবাপ্পেই। দলের অন্য দুই তারকার সঙ্গে না করে তার ওপরেই সব দায়িত্ব দেওয়ার ইচ্ছা এখন পিএসজি কর্তৃপক্ষের। তাদের ইচ্ছা, এমন কাউকে দলে আনার, যে কিনা এমবাপ্পের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে দলকে সাহায্য করতে পারবেন। আর সেই তালিকার প্রথম পছন্দ, ইংলিশ অধিনায়ক হ্যারি কেইন। অনেক দিন ধরেই দল ছাড়তে চাইছেন কেইন, পিএসজির মতো দলের সেকেন্ড-ইন কমান্ড রোলে তাঁকে মানাবেও বেশ।

শুধু তা–ই নয়, সদ্য বায়ার্নে যোগ দেওয়া সাদিও মানের দিকেও নজর আছে তাদের। বায়ার্নে ইতিমধ্যেই এক দফা ঝামেলা তৈরি করেছেন তিনি। সানের সঙ্গে হাতাহাতির পর থেকেই তাঁকে দলচ্যুত করার পদ্ধতি খুঁজছে বায়ার্ন। পিএসজি সে সুযোগটাই লুফে নিতে চাইছে। দলে একজন স্বার্থহীন খেলোয়াড়ের প্রয়োজনীয়তা খুব ভালোভাবেই জানে পিএসজি, লিভারপুলে সে কাজটা খুব ভালোভাবেই করে এসেছেন মানে। তাই তাঁকে পেলে এমবাপ্পের সঙ্গে ঝামেলা দূরে থাক, বরং মানিকজোড় হয়ে ওঠার সম্ভাবনাও আছে তাঁদের।

লিওনেল মেসির রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে সিটি তারকা বার্নার্দো সিলভার দিকেও নজর আছে সিটির। কিন্তু পেপ গার্দিওলা একবাক্যে না করে দিয়েছেন সেই সুযোগ। তবে মৌসুম শেষে আরেক মিডফিল্ডার ইল্কায় গুন্দোগান হচ্ছেন ফ্রি এজেন্ট। তাঁকে লুফে নেওয়ার সুযোগও আছে পিএসজির।

তবে তাদের বড় চিন্তা ডিফেন্স নিয়ে। সার্জিও রামোসের সঙ্গে চুক্তি এগোয়নি, তাঁর থাকার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তাঁর পজিশনের জন্য পিএসজির চোখ নাপোলির লিগজয়ী ডিফেন্ডার কিম মিন-জে অথবা ক্রিস্টাল প্যালেসের মাইকেল অলিস। বোঝাই যাচ্ছে বড় নাম নয়, বরং দামে কম, মানে ভালো খেলোয়াড়দের দিকেই এখন নজর পিএসজির।

তবে হাজারো রান্নার উপকরণ দিয়ে কী হবে যদি না ভালো একজন রাঁধুনিই না পাওয়া যায়। খেলোয়াড়দের মতো করে একসময় কোচদেরও ডেকে ডেকে নিয়ে আসত পিএসজি। কিন্তু দলের হযবরল অবস্থা দেখে অনেক কোচই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। নাসের আল খেলাইফির আমলে ১০ বছরে ৬ জন আলাদা আলাদা কোচের অধীনে খেলেছে পিএসজি। কার্লো আনচেলত্তি বাদে প্রতিটি কোচের সঙ্গেই কমবেশি মনোমালিন্য ছিল বোর্ডের। শেষ দুই কোচ তো বরখাস্ত হলেন প্রকাশ্যে খেলোয়াড়দের সমালোচনা করে। এই পিএসজি দলের দায়িত্ব নিতে তাই অনেকেই অপারগ। যদিও ‘স্পেশাল ওয়ান’ জোসে মরিনিওর জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা, কিন্তু তাঁকে না পেলে নতুন কোচের দিকে হাত বাড়াতে হবে তাদের। সে ক্ষেত্রে নতুন কোচ হতে পারেন বায়ার্ন থেকে বরখাস্ত হওয়া জুলিয়ান নাগেলসম্যান। বর্তমান কোচ ক্রিস্তফ গল্টিয়েঁর ওপর ভরসা অনেকটাই হারিয়েছে তারা। তাই নতুন কোচকে নিয়েই নতুন মৌসুম শুরুর ইচ্ছা ফরাসি ক্লাবটির।

এখানেও প্রশ্ন থেকেই যায়, আগের কোচরা বোর্ড থেকে সাহায্য পাননি বলেই চলে। বোর্ড তাদের খেলোয়াড়ের তালিকা ধরিয়ে দিয়েছে, আর তা নিয়েই মাঠে নামতে হয়েছে। কোচদের সঙ্গে নিয়ে দল তৈরি না করার ফসল ছিল গত দুই মৌসুমের ব্যর্থতা। সেই একই পথে কি আবারও হাঁটবে পিএসজি? নাকি কোচ, খেলোয়াড় আর সমর্থক সবাইকে নিয়ে নিজেদের ভুল শুধরে মাঠে ফিরবে তারা? আধুনিক ফুটবলের যুগে টাকা সবারই আছে। খেলোয়াড়দের পেছনে ব্যাংক খালি করে দেওয়ার উদাহরণও অহরহ। কিন্তু সেই টাকা ঠিক সময়ে ঠিক খেলোয়াড়ের পেছনে খরচ করতে পারাটাও অভিজ্ঞতার ব্যাপার। ১০ বছর দল চালানোর অভিজ্ঞতা নিয়ে নাসের আল খেলাইফি কি নিজেকে বদলে ফেলবেন না পুরোনো ভুলই করবেন, তার উত্তর পাওয়া যাবে আগামী ৩ মাসের মধ্যেই। এখন শুধুই অপেক্ষা, ইউরোপিয়ান দলবদলের মৌসুম শুরু হওয়ার।