প্রথাভাঙা অধিনায়ক কামিন্স যেভাবে ভাঙলেন ভারতীয়দের মন

বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে সবরমতী নদীর তীরে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক প্যাট কামিন্স

‘ফাইনালে আপনাদের লক্ষ্য কী?’

‘খেলায় বিপুলসংখ্যক সমর্থকদের চুপ করিয়ে দেওয়ার চেয়ে সন্তুষ্টির আর কিছু হতে পারে না। আমাদের আগামীকালের লক্ষ্য এটাই।’ ফাইনালের আগে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক প্যাট কামিন্স। গতকাল ফাইনালে ঠিক সেটাই করে দেখিয়েছেন তিনি। ষষ্ঠবারের মতো ওয়ানডে বিশ্বকাপ জয় করল প্যাট কামিন্সের দল। নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামের লাখো দর্শককে চুপ করিয়ে দেওয়ায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন অধিনায়ক কামিন্স।

২৯তম ওভারের ৩ নম্বর বল, কিছুটা অসম বাউন্স। প্যাট কামিন্সের বলটা বুঝতে না পেরে প্লেইড অন হলেন বিরাট কোহলি। ব্যাটের কানায় লেগে বল আঘাত হানল স্টাম্পে। মুহূর্তের ১ লক্ষ ৩০ হাজার দর্শকের মাঠ পরিণত হলো শ্মশানে। উল্লাসে ফেটে পড়া কামিন্সের চিৎকার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামের আনাচ-কানাচে। ‘ক্যাপ্টেন লিডিং ফ্রম দ্য ফ্রন্ট’ উক্তিটির জন্য এর চেয়ে ভালো উদাহরণ আর কীই–বা হতে পারে?

অথচ এই কামিন্সের অধিনায়ক হওয়ার কথাই ছিল না। টিম পেইনের অক্রিকেটীয় আচরণ আর অ্যারন ফিঞ্চের অবসর—বহু দরজায় কড়া নেড়ে হুট করেই অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়কত্বের দায়িত্বটা এসে পড়ে প্যাট কামিন্সের কাঁধে।

দায়িত্ব ঠিকমতো বুঝে নেওয়ার আগেই উড়ে এল সমালোচনার তির। একজন বোলার কেন হবেন অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক? অজি অধিনায়ক থাকবেন বিশ্বসেরা কোনো ব্যাটাসম্যান। অ্যালান বোর্ডার, স্টিভ ওয়াহ, রিকি পন্টিং, মাইকেল ক্লার্ক, স্টিভ স্মিথরা তো সে ধারাই বয়ে এসেছেন। ১৪৬ বছর ধরে এই একই ধারা বয়ে এসেছে। অস্ট্রেলিয়ার সেরা ব্যাটসম্যানরা হবেন অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক। সেই ইতিহাস পাল্টে প্রথমবারের মতো কোনো বোলারের হাতে অধিনায়কের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিল অজিরা।

বিশ্বকাপ ট্রফি নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়দের উচ্ছ্বাস
ছবি: রয়টার্স

সমর্থক থেকে শুরু করে ক্রিকেট–পণ্ডিত, সাবেক খেলোয়াড়—সবার মনেই এক অজানা আশঙ্কা কামিন্সকে ঘিরে। ১০ বছরের ওপর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে তেমন আহামরি কোনো অর্জন নেই যাঁর, তাঁকে দিয়ে কি আর অধিনায়কত্ব হবে?

নিন্দুকদের ব্যর্থ প্রমাণ করতে বিন্দুমাত্র সময় নেননি কামিন্স। টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে তাঁর প্রথম সিরিজটাই ছিল অ্যাশেজ। চিরপ্রতিদ্বন্দী ইংল্যান্ডকে ৪-০ ব্যবধানে হারিয়ে জানান দিলেন, সমালোচনা শুনতে নয়, বরং তিনি এসেছেন নতুন ইতিহাস লিখতে।

আরও পড়ুন

২০২২ সালের শেষের দিকে সব ফরম্যাট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন অ্যারন ফিঞ্চ, ফলে তিন ফরম্যাটের অধিনায়ক হিসেবেই দায়িত্ব এসে পরে কামিন্সের কাঁধে। দায়িত্ব পেয়েই যেন ক্রিকেটের মনোযোগী ছাত্র হয়ে উঠলেন কামিন্স। আইপিএলের লোভনীয় প্রস্তাব সরিয়ে রেখে মনোযোগ দিলেন ক্রিকেটের আদি ও অকৃত্রিম দুই ফরম্যাটে। মুচকি হেসেছিল অনেকেই, দেশে-বিদেশের হাজার হাজার প্রতিভার সংমিশ্রণ যে আইপিএল, সেই আইপিএলকে সরিয়ে রেখে কী এমন প্রস্তুতি নিতে চান কামিন্স?

কামিন্সের প্রস্তুতির ভয়ানক রূপ দেখেছিল ভারত। সদ্য আইপিএল খেলে আসা ভারত দলকে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে একাই ধসিয়ে দিয়েছিলেন কামিন্স। প্রথমবারের মতো টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের গদা উঁচিয়ে ধরেছিল অস্ট্রেলিয়া। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের পরপরই ছিল অ্যাশেজ, অজি-ইংলিশদের মর্যাদার লড়াই। কামিন্সের অলরাউন্ড পারফরম্যান্সের ওপর ভর করে ইংল্যান্ডের মাটি থেকে অ্যাশেজ রেখে দেয় অস্ট্রেলিয়া। ব্যাট হাতে ১৬২ রান আর বল হাতে ৮ উইকেট, পুরো অ্যাশেজেই কামিন্স ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার ভরসার পাত্র।

আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে ভারতীয়দের মন ভেঙেছেন কামিন্স
রয়টার্স

এত অর্জনের পরও একদিনের ক্রিকেটে কামিন্সকে নিয়ে একটা সন্দেহ ছিলই। টেস্ট ফরম্যাটে অজিরা সব সময়ই ধারাবাহিক , কিন্তু একদিনের ক্রিকেটে ভঙুর অবস্থা সেই ১৫ বিশ্বকাপের পর থেকেই। এই বিশ্বকাপের আগেও বলার মতো কিছু করতে পারেনি অজিরা। ওয়ানডে দলটাই ঠিকমতো সাজাতে পারছিল না অস্ট্রেলিয়া। ওপেনিং, মিডল অর্ডার কোনোটাই গুছিয়ে উঠতে পারেনি অজিরা। কামিন্সবাহিনী নিজেদের বিশ্বকাপ প্রস্তুতি শেষ করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা আর ভারতের কাছে বাজেভাবে সিরিজ হেরে। বিশ্বকাপের শুরুটাও হয়েছিল ভয়াবহ, ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে লজ্জাজনক হার দিয়ে। প্রথম দুই ম্যাচে ২০০ রান পর্যন্ত পার করতে পারেনি অজিরা, বাজে নেট রান রেট নিয়ে তাদের অবস্থান ছিল পয়েন্ট টেবিলের তলানিতে।

আরও পড়ুন

তারপরই ঘুরে দাঁড়াল অস্ট্রেলিয়া। সেটাও কামিন্সের হাত ধরেই। প্রথম দুই ম্যাচে হেরে অস্ট্রেলিয়ার পিঠ ঠেকে গিয়েছিল দেয়ালে। তৃতীয় ম্যাচে শ্রীলঙ্ক কোনো উইকেট না হারিয়েই তুলে ফেলেছিল ১২৫ রান। ২২তম ওভারে আক্রমণে ফিরে দুই ওপেনারকেই প্যাভিলিয়নে পাঠালেন কামিন্স। অস্ট্রেলিয়ার ঘুরে দাঁড়ানোর শুরু সেখান থেকেই। বিনা উইকেটে ১২৫ থেকে শ্রীলঙ্কা অলআউট ২০৯ রানে। ৫ উইকেটের জয় নিয়ে অস্ট্রেলিয়া রীতিমতো বুলডোজার চালাল নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে। বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জয় বদলে দিল অস্ট্রেলিয়ার মোমেন্টাম। এর পর থেকে শুধু নিজেদের ছাড়িয়ে যাওয়ার মিশন। প্রতিটি ম্যাচেই জয়, সেটাও ধুঁকে ধুঁকে নয়, ফেবারিটের মতো জয়। আর যে ম্যাচে ব্যাকফুটে ছিল, সেখান থেকেও জয় ছিনিয়ে এনেছে বীরের বেশে। প্রথম দুই ম্যাচ শেষে বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়া অস্ট্রেলিয়া গ্রুপ পর্ব শেষ করল তৃতীয় অবস্থানে থেকে। আর সেই জয়রথের নেতৃত্ব দিয়েছেন কামিন্স—একদম সামনে থেকে।

ম্যাচের শুরুতে অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক কামিন্স ও ভারতের রোহিত শর্মা
ছবি: এএফপি

পরিস্থিতির সঙ্গে মুহূর্তেই নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার অদ্ভুত এক ক্ষমতা আছে কামিন্সের। ব্যাট হাতে কামিন্স বরাবরই আগ্রাসী, আইপিএল বা টি-টোয়েন্টিতে তাঁর মারকাটারি ইনিংস দেখলে সেটা যে কেউ বলতে বাধ্য। অথচ বিশ্বকাপে ক্ষণে ক্ষণে পাল্টেছে তাঁর ভোল। ম্যাচের পরিস্থিতি বুঝে দলকে এগিয়ে নিয়েছেন। যখন চড়াও হওয়ার দরকার, তখন যেমন চড়াও হয়েছেন কামিন্স, তেমনই সময় বুঝে ব্যাক গিয়ারে গিয়ে দলকে রক্ষাও করেছেন। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে স্লগ ওভারে নেমে ১৪ বলে ৩৭ যেমন করেছেন, তেমনি আফগানিস্তানের বিপক্ষে বিপর্যয়ের মুখে ৬৮ বলে করেছেন অপরাজিত ১২ রান। সেমি ফাইনালের মতো গুরুত্বপূর্ণ নক-আউট ম্যাচে স্নায়ু ধরে রেখে দলকে পৌঁছে দিয়েছেন জয়ের বন্দরে। শুধু ব্যাট হাতে নয়, বল হাতেও কামিন্স ছিলেন অজিদের রক্ষাকর্তা। মিডল ওভারে ব্রেকথ্রু এনে দেওয়া, স্লগ ওভারে রান সামাল দেওয়া; যখন যেখানে প্রয়োজন, নিজেকে সামলে নিয়ে এগিয়ে এসেছেন দলের প্রয়োজনে। ১১ ম্যাচে ১৮ উইকেটই তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ।

কামিন্স তাঁর সেরাটা জমিয়ে রেখেছিলেন নক-আউট পর্বের জন্য। বড় ম্যাচে নার্ভ ধরে রাখার লড়াইয়ে অস্ট্রেলিয়ার সমতুল্য নেই কেউ। তাই তো গত তিন মাসে যাদের কাছেই বারবার ধরাশায়ী হয়েছে অজি দল, তাদেরকে হারিয়েই শিরোপাটা নিজের করে নিলেন তিনি। দুই বছর আগে ঠিক এই সময়টাতেই অস্ট্রেলিয়ার ৪৭তম টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন তিনি, এক বছর আগে পেয়েছেন ওয়ানডে দলের অধিনায়কত্ব।

কোহলিকে তুলে নেন প্যাট কামিন্স
ছবি: এএফপি

কামিন্স ছিলেন প্রথাভাঙা এক অধিনায়ক, অস্ট্রেলিয়ার প্রথম বোলার–অধিনায়ক। কে ভেবেছিল, এই প্রথাভাঙা অধিনায়কই বদলে দেবেন অট্রেলিয়ার ১৪৭ বছরের ইতিহাস? কামিন্স ইতিহাসে জায়গা করে নেবেন একই বছরে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ, অ্যাশেজ ও বিশ্বকাপ জেতা একমাত্র অধিনায়ক হিসেবে। দুই বছর আগেও যে মানুষটাকে অযোগ্য ভেবে নাক সিটকাচ্ছিলেন পণ্ডেতেরা, তাঁরাই আজ দুহাতে বরণ করে নিচ্ছেন তাঁকে। এর চেয়ে দারুণ আর কীই–বা হতে পারে?