যে কৌশলে সিনারকে হারালেন আলকারাজ
‘লাল দূর্গেও আবার লড়াই হয়?’ ফ্রেঞ্চ ওপেনের ফাইনাল দেখতে টিভি পর্দার সামনে বসা দর্শকদের প্রতিক্রিয়া হয়তো এমনই ছিল। গত দুই দশক ধরে লাল মাটির কোর্টকে রীতিমতো দূর্গ বানিয়ে রেখেছিলেন রাফায়েল নাদাল। রোলাঁ গ্যারোঁতেও যে জমজমাট লড়াই হয়, হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে পারে দুজন — টেনিসপ্রেমীরা ভুলেই গিয়েছিল সে কথা। লাল কোর্টেও আনন্দ-অশ্রুর খেলা হয়, ফিরে আসার গল্প লেখা হয় — কার্লোস আলকারাজ আর ইয়ানিক সিনার সেই কথা আরেকবার মনে করিয়ে দিলেন।
ইয়ানিক সিনার যে ফর্মে ছিলেন, তাতে ফ্রেঞ্চ ওপেনের শিরোপা একপ্রকার তাঁর নামে লেখাই হয়ে গিয়েছিল। কোনো সেট না হেরে এসেছেন রোলাঁ গ্যারোঁর ফাইনালে। অস্ট্রেলিয়ান ওপেনেও ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। ভয় ছিল শুধু একটি নাম নিয়েই– কার্লোস আলকারাজ। ইয়ানিক সিনার পুরো বিশ্ব জয় করে এসে যেন আটকে যান এই একজনের কাছে। স্প্যানিশ তারকাকে থামানোর তরিকা এখনও ঠিক আয়ত্বে আনতে পারেননি তিনি। শেষ চারবারের দেখায় চারবারই মাথা নিচু করে কোর্ট ছাড়তে হয়েছে সিনারকে। সিনার সেই ভয় গায়ে স্পর্শই করতে দিলেন না শুরুতে।
৬-৪, ৭-৬ (৭-৪) ব্যবধানে প্রথম দুই সেট জিতে ম্যাচটা নিয়ে নিলেন নিজের আয়ত্ত্বে। একটা সময় মনেও হচ্ছিল, হয়তো কোনো সেট না হেরেই শিরোপার ছোঁয়া পাবেন সিনার। নিজের নামটা যোগ করবেন স্বয়ং রাফায়েল নাদালের পাশে। তৃতীয় সেটে এসেই ঘুরে দাড়ালেন আলকারাজ। ৬-৪ গেমে জিতে ম্যাচের গতি পালটে দিলেন আলকারাজ। চতুর্থ সেটে আবারও ঘুরে দাড়ালেন সিনার। শুধু ঘুরে দাঁড়ানো বললে ভুল হবে, একেবারে শিরোপা থেকে মাত্র এক পা দূরে তিনি। হাতে তিনটি চ্যাম্পিয়নশিপ পয়েন্ট, একটি ঠিকঠাক শট আলকারাজকে পার করে গেলেই শিরোপা লেখা হয়ে যাবে তাঁর নামে। সিনার পারলেন না। ন্যূনতম ব্যবধান থেকেও ম্যাচটাকে নিজের করে নিতে পারলেন না। একে একে তিনটি ম্যাচ পয়েন্টই বলি দিলেন আলকারাজের কাছে। অতঃপর সেটটাও। ইয়ানিক সিনারের বিদায় যেন লেখা হয়ে গিয়েছিল ঠিক সেই সময়েই। ইতিহাস অন্তত তাই বলে।
গত দুই বছরে টেনিস কোর্টে সিনারকে আটকানোর শত ফন্দি এটেছে খেলোয়াড়েরা। কোনোটাই কাজে দেয়নি–একটি ছাড়া। সেই ফন্দির নাম — পঞ্চম সেট! চার ঘন্টার পার হওয়া একটি ম্যাচও জিততে পারেননি সিনার। সিনারকে আটকানোর তাই একটাই রাস্তা–ক্লান্ত করে তার কাছ থেকে শেষ নিশ্বাসটা বের করে আনো, কাজ আপনাতেই হবে। আলকারাজ সেই ফন্দিই এঁটেছেন। একবার যখন ম্যাচ পয়েন্ট হারিয়েছেন সিনার, তখনই যেন নিজের ভবিষ্যৎ চোখের সামনে দেখতে পেরেছেন। কিন্তু হাল তো ছাড়া যাবে না। বিনা যুদ্ধে লাল মাটির একটি কণাও ছাড়তে রাজি নন কেউ। ফলে আলকারাজ-সিনারের লড়াই চলল আরও দেড় ঘন্টা!
দেড় ঘন্টার একবার আক্রমণ করলেন আলকারাজ, পরমুহূর্তেই তার জবাব ফিরিয়ে দিলেন সিনার। পঞ্চম সেটের প্রথমেই এগিয়ে গেলেন আলকারাজ। মনে হচ্ছিল সিনার বুঝি তাঁর মনোবল, শক্তি সবটা জলাঞ্জলি দিয়েছেন। পরমূহূর্তেই ঘুরে দাড়ালেন সিনার। ম্যাচটাকে টেনে নিয়ে গেলেন তাঁর দিকে। ম্যাচ যখন আবারও জেতার দ্বারপ্রান্তে সিনার, তখন আলকারাজ সেটাকে টেনে নিয়ে গেলেন সুপার টাইব্রেকারে। আর সেখানেই আটকে গেলেন সিনার। পঞ্চম সেটে এসে সুপার টাইব্রেকারে ১০-২ ব্যবধানে জিতে ফ্রেঞ্চ ওপেনের শিরোপা নিজের করে নিলেন কার্লোস আলকারাজ।
৫ ঘন্টা ২৯ মিনিটের ফাইনাল রোঁলা গ্যাঁরোর ইতিহাস তো বটেই, গ্র্যান্ডস্লাম ইতিহাসের দ্বিতীয় দীর্ঘতম ফাইনাল। প্রথম স্থানটা এখনও দখল করে রেখেছেন রাফায়েল নাদাল আর নোভাক জোকোভিচের ২০১২ অস্ট্রেলিয়ান ওপেন ফাইনাল। আলকারাজের পাশাপাশি তাই ধন্যবাদটা সিনারেরও প্রাপ্য। সাড়ে পাঁচ ঘন্টায় যেমন মেজাজ শান্ত রেখেছেন, আম্পায়ারের ভুল কল পর্যন্ত শুধরে দিয়েছেন নিজে। ছিল না কোনো বাথরুম ব্রেক, ছিল না কোনো মেডিক্যাল টাইম আঊট। সাড়ে পাঁচ ঘন্টা ধরে একে অপরকে তাড়া করেছেন শিরোপার জন্য। ম্যাচ শেষ দৌড়ে গিয়েছেন আলকারাজকে অভিবাদন জানাতে। মাঠের লড়াইটা মাঠেই রেখেছেন, ব্যক্তিগত পর্যায়ে আনতে দেননি। ‘বিগ ফোর’-এর ক্ষয়ে যাওয়ার পর যখন কে হাল ধরবে এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় টেনিসপ্রেমীরা, তখন সেই হালে পানি দিচ্ছেন সিনার-আলকারাজ একত্রে।
মাইক হাতে আলকারাজের প্রথম ধন্যবাদটা গেল রাফায়েল নাদালের কাছেই। ‘ম্যাচে যখন জেতার কোন আশাই পাচ্ছিলাম না, তখন রাফার কথা মনে করেছি। মনে পড়েছে সে কীভাবে ম্যাচে কামব্যাক করতো।’ আলকারাজ শুধু নাদালের কথা মনেই করেননি, নাম লিখিয়েছেন নাদালের পাশেও। নাদালের পর টানা দুই ফ্রেঞ্চ ওপেন জেতা দ্বিতীয় খেলোয়াড় তিনি। এমনকী নিজের পঞ্চম গ্র্যান্ডস্লামও জিতেছেন ঠিক নাদালের সঙ্গে। ২০০৮ সালে নাদাল যখন তার পঞ্চম গ্র্যান্ডস্লাম জেতেন রজার ফেদেরারকে উইমবলডনে হারিয়ে, তখন তার বয়স ছিল ২২ বছর ১ মাস ৩ দিন। কার্লোস আলকারাজও ফ্রেঞ্চ ওপেন দিয়ে নিজের পঞ্চম গ্র্যান্ডস্লাম জিতলেন ২২ বছর ১ মাস ৩ দিনে। কালতালীয় না স্বপ্নদ্রষ্টা? কার্লোস আলকারাজ নিজের ইতিহাস লেখার দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন নিজের কাঁধেই।