ভারত কি স্পিন খেলতে পারছে না?
ভারত যেন এক ধাক্কায় ফেরত নিয়ে গেল পঞ্চাশের দশকে। আজ থেকে ৬৬ বছর আগে এমন দৃশ্যের দেখা মিলেছিল ক্রিকেট মাঠে। টেস্ট ম্যাচের চার ইনিংসের চারটিই শেষ হয়েছে ২০০ রানের নিচে। ১৯৫৯ সালে ঢাকা স্টেডিয়ামে দেখা গিয়েছিল সেই দৃশ্য। ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা সেই পুরোনো স্মৃতি মনে করিয়ে দিল সকলকে। সেই সঙ্গে প্রশ্ন ছুড়ে দিল– ভারত কি দিন দিন নিজেদের সেরাটা হারিয়ে ফেলছে?
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজে স্পিন সহায়ক পিচ হবে, এমনটা ধারণা করেছিলেন অনেকেই। পুরো ৬ বছর পর টেস্ট ক্রিকেট ফিরেছে বিখ্যাত ইডেন গার্ডেনে। সেখানে প্রোটিয়াদের ধরাশায়ী করতে স্পিনের সহায়তা নেওয়াটা দোষের কিছু নয়। হোম অ্যাডভান্টেজ যদি না-ই নেওয়া হয়, তবে দেশের মাটিতে খেলে লাভ কী? তবে ভারতের জন্য যে সেটাই কাল হবে, তা হয়তো ভাবনাতেও ছিল না কারো।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ শুরুই হয়েছিল বিতর্ক দিয়ে। প্রোটিয়াদের অধিনায়ক টেম্বা বাভুমাকে নিয়ে আক্রমণাত্বক মন্তব্য করেছে ভারতীয় খেলোয়াড়েরা। স্লেজিং করতে তাঁকে ‘বাউয়া’ বা বামন ডাকতেও ছাড়েননি। টেম্বা বাভুমা তার জবাব দিয়েছেন ব্যাটে।
প্রথম ইনিংসে দক্ষিণ আফ্রিকা গুটিয়ে গিয়েছিল ১৫৯ রানে। তার বিনিময়ে ভারত করেছিল ১৮৯। দ্বিতীয় ইনিংসে নেমে ৬০ রানেই ৫ উইকেট হারায় প্রোটিয়ারা। তখনই দলের রক্ষাকর্তা হয়ে হাজির হন অধিনায়ক টেম্বা বাভুমা। ভারতীয় বোলারদের সামলানোর গুরুদায়িত্ব তুলে নেন কাঁধে। জাদেজা-প্যাটেলের স্পিন আর বুমরাহ গতি, কোনোটাই টলাতে পারেনি তাঁকে। বরং অপর পাশ থেকে একের পর এক উইকেটের পতন না ঘটলে হয়তো বাভুমাকে থামানো সম্ভবই হতো না। অপর পাশ থেকে যখন ব্যাটসম্যান ফুরিয়ে গিয়েছে, টেম্বা বাভুমাকে থামতে হয়েছে ১৩৬ বলে ৫৫ করে। অপরাজিত এক ইনিংস বদলে দিয়েছে ম্যাচের চিত্র। কারণ ১২৪ রানের টার্গেট আর ছুঁতে পারেনি ভারত।
চোট পাওয়ায় শুভমান গিল ছিলেন না দ্বিতীয় ইনিংসে। অধিনায়ক ছাড়া রান তাড়া করতে গিয়ে ডাহা ফেল মেরেছেন ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা। মাত্র চারজন ব্যাটসম্যান করতে পেরেছেন দুই অঙ্কের রান। বাকিরা শুধু আসা-যাওয়ার মিছিলই করেছেন। ৩৫ ওভারে মাত্র ৯৩ রানে অল আউট হয়ে যায় ভারত। ৩০ রানে জিতে সিরিজে এগিয়ে গেল দক্ষিণ আফ্রিকা। সেই সঙ্গে ১৫ বছর পর ভারতের মাটিতে টেস্ট জিতে নিল দক্ষিণ আফ্রিকা।
বাভুমার সঙ্গে ম্যাচের রাজা হয়ে উঠলেন ৩৬ বছর বয়সী সিমোন হার্মার। মাত্র ১৩ ম্যাচ খেলা হার্মার প্রোটিয়া দল থাকেন যাওয়া-আসার মধ্যে। কিন্তু যখন আসেন তখন যেন একেবারে তাক লাগিয়ে দিয়ে যান। লিস্ট এ ক্রিকেটে ১০০০ উইকেট নেওয়া হার্মার ঠিক কতটা বিধ্বংসী হতে পারেন, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ ছিল ভারত ম্যাচ। দুই ইনিংসে ৫১ রান দিয়ে নিয়েছেন ৮ উইকেট। ভারতের ব্যাটিং ধ্বসে গিয়েছে সেখানেই। ডান হাতি অফ ব্রেক বোলার, দূর্দান্ত টার্ন করাতে পারছেন। ব্যাস ভারতীয় ব্যাটিং লাইনআপ ধরাশায়ী।
ফলাফল দেখে মনে হতে পারে, এক ম্যাচেই বোধহয় এমন। কিন্তু না, ভারতের এই স্পিন সমস্যা চলছে বহুদিন ধরেই। বিশেষ করে কোচ গৌতম গম্ভীর আসার পর। গম্ভীর এসেই ডাক দিয়েছেন, স্পিনবান্ধব পিচ করার। টেস্ট দলকে সেভাবেই ঢেলে সাজাবেন তিনি। কিন্তু সেই আশা গুড়েবালি হয়েছে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। যে ভারতীয় দল নিজেদের অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছিল নিজেদের মাটিতে। সেই দলই কী না নিউজিল্যান্ডের কাছে সিরিজ হেরেছে। সেটাও আবার একেবারে ধবলধোলাই। তিন টেস্টের সিরিজে তিনটিই হেরেছে শোচনীয়ভাবে। আজাজ প্যাটেল, মিচেল স্যান্টনার আর গ্লেন ফিলিপস মিলে ভারতীয় ব্যাটিং লাইনআপকে রীতিমতো নাকানি-চুবানি খাইয়েছেন। রোহিত-কোহলি থেকেও দলকে বাঁচাতে পারেননি লজ্জা থেকে। এর মধ্যে এক ইনিংসে ভারত অল আউট হয়েছিল ৪৬ রানে!
২০১৩ সালের পর সেটাই ছিল ভারতের নিজেদের মাটিতে কোনো টেস্ট সিরিজ হার। মজার ব্যাপার হলো, নিজেদের মাটিতে খেলা শেষ ৬ টেস্টের ৪টিতেই হেরেছে ভারত। আর যে দুটো জয় এসেছে, সেটাও এসেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। অথচ ২০১৩ থেকে ২০২৩, ১০ বছরে ভারত নিজেদের মাটিতে টেস্ট হেরেছে মাত্র ৩টি।
পরিবর্তনটা কোথায়? কোচ গৌতম গম্ভীর দলকে ঠিক যেভাবে সাজাতে চাইছেন, দল আসলে আর সেই অবস্থায় নেই। থাকার কথাও না। একটা সময় ভারতীয় ব্যাটিং লাইনআপ জুড়ে ছিল দূর্দান্ত স্পিন খেলতে পারা ব্যাটার। শচীন-দ্রাভিড়-লক্ষ্মণ থেকে শুরু করে রোহিত-কোহলি-পূজারা। দীর্ঘসময় পিচে থেকে চিন্তাভাবনা করে খেলা ব্যাটার ছিলেন তাঁরা। পৃথিবীর যে প্রান্তের স্পিনারই আসুক না কেন, স্পিন খেলতে তাদের কোনো দ্বিধা ছিল না। সেই স্বর্ণযুগ এখন আর নেই। তাঁদের বদলে যে খারাপ খেলোয়াড় উঠে এসেছেন, তা কিন্তু নয়। বরং স্পোর্টিং পিচে তাঁদের পারফরম্যান্স এখনও দারুণ। সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় যখন একেবারে স্পিন পিচে খেলতে নামেন। একজন ভালো বোলার দাঁড়িয়ে গেলেই যেন আর খেই খুঁজে পান না ব্যাটসম্যানরা।
এই যেমন কেএল রাহুলের কথাই ধরা যাক, দূর্দান্ত ব্যাটার। স্পোর্টিং পিচে তাঁর ব্যাটিং মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে দেখতে হয়। কিন্তু এই স্পিন পিচে এসেই যেন সব খেই হারিয়ে ফেলেছেন। তাঁকে এই স্পিনের স্বর্গরাজ্যে খুঁজে বের করাই মুশকিল। একই কথা প্রযোজ্য যশস্বী জয়সোয়াল, ঋষভ পন্তের ক্ষেত্রেও। স্পোর্টিং পিচে তাঁরা ঠিক যতটা দুর্দান্ত, স্পিনিং পিচে ততটাই নিজেদের ছায়া হয়ে থাকেন। ফলাফল? নিজেদের মাটিতে পেতে হচ্ছে পরাজয়ের স্বাদ।
ভারতের স্পিন সমস্যার আশু সমাধান কারও কাছে নেই বললেই চলে। বরং কোচ এসেই নামকরা টেস্ট খেলোয়াড়দের সরিয়ে দিয়েছেন রাডার থেকে। সরফরাজ খান বাদ পড়েছেন, কোহলি-রোহিত ছেড়ে দিয়েছেন সাদা জার্সি। যে জাসপ্রিত বুমরাহকে ঘরের মাটিতে টেস্টে দেখাই যেত না, তাকে জমিয়ে রাখা হতো বিদেশি টেস্টের জন্য, সেই বুমরাহ নিয়মিত খেলেও দলকে বাঁচাতে পারছেন না। এখন সমাধানের একটা রাস্তাই খোলা আছে ভারতের সামনে। নিজের কোচিং ক্যারিয়ার লম্বা করতে চাইলে স্পোর্টিং পিচেই খেলতে চাইবেন গৌতম গম্ভীর। তাতে অবশ্য কয়েকটা ম্যাচে জয় আসলেও আসতে পারে।