শেষ ভালো যার, সব ভালো তার

যার শুরু আছে, তার শেষও আছে। শেষ হয়ে যায় পর্দায় দেখা সিনেমা, শেষ হয়ে যায় পছন্দের সন্দেশ। শেষ হয় প্রিয় বইটাও। এই সুরে গলা মিলিয়ে মাত্র কয়েক দিন আগে ঘোষণা দিলেন লিওনেল মেসি—২০২২ ফুটবল বিশ্বকাপই হতে যাচ্ছে তাঁর শেষ। একই রকম শেষ বিশ্বকাপ ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর, হয়তো নেইমারেরও! এগুলো টের পেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতেই মনে পড়ল, কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার লাইন—‘নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়…।’

তর্কযোগ্যভাবে ফুটবলের দুই অলটাইম গ্রেটকে শেষবার এক মঞ্চের দেখার সুযোগ। আবারও মেসি-রোনালদোর শ্রেষ্ঠত্বকে ঘিরে তর্ক চলবে সামাজিক মাধ্যমের দেয়ালে, বন্ধুদের আড্ডায়। তাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে তর্ক থাকলেও একসঙ্গে এমন দুই গ্রেটের দেখা পাওয়ার কারণে আমরা যে অসাধারণ এক সময়ে বাস করছি, তা নিয়ে তর্কের কোনো অবকাশ নেই।

সেই ২০০৬ বিশ্বকাপে সার্বিয়া অ্যান্ড মন্টেনিগ্রোর বিপক্ষে গোল করে বিশ্বকাপে নিজের পদচিহ্ন রেখেছিল এক কিশোর বালক। ছোট্ট গড়ন, নিষ্পাপ হাসি নিয়ে বাঁ পায়ে জাদু দেখানো ছেলেটির খেলা দেখে সাড়া পড়ে গেল চারপাশে, জোর গুঞ্জন উঠল, ‘আবার একজন ম্যারাডোনা এসেছে।’ খোদ ম্যারাডোনা নিজেও সায় দিলেন, ‘ছেলেটা আমার মতোই খেলে।’

তারপর মাত্র কিছুদিন। জাদুকরি সেই কিশোরকে সবাই চিনেছে মেসি হিসেবে। লিওনেল মেসি বাঁ পায়ের জাদুকর। গোলের খেলা ফুটবলের অনন্য শিল্পী। ক্লাব ফুটবলের সব অর্জন তাঁর পায়ের কাছে গড়াগড়ি খেলেও আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে রাতারাতি কোনো সাফল্য আসেনি মেসির কাছে। প্রতিবার ভক্ত-সমর্থকদের পাহাড়সম আশা কাঁধে নিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু বিশ্বকাপের মঞ্চ তাঁকে খালি হাতে ফিরিয়েছে বারবারই। ২০১৪ সালে বিশ্বকাপের হাতছোঁয়া দূরত্বে থেকেও ফিরে আসতে হয়েছে রানার্সআপ হিসেবে।

ডি মারিয়া

আর্জেন্টিনা দলে কেবল মেসিই নন, শেষ বিশ্বকাপ খেলবেন ডি মারিয়া, ওতামেন্দিও। পোড়খাওয়া এই যোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে গত বছর মেসি জিতেছেন কোপা আমেরিকার শিরোপা। আর্জেন্টিনার জার্সিতে অধরা শিরোপার খরা কেটেছে রবার্ট ব্রুসের মতো বারবারের চেষ্টায়। আর্জেন্টিনাও বোধ হয় স্মরণকালের সবচেয়ে সুন্দর ফর্ম ধরে রেখে এসেছে বিশ্বকাপে। অনেকে তো ফেবারিটও মানছেন তাঁদের। কোচ স্কালোনির হাত ধরে দিনবদলের দেখা পেয়েছেন মেসি-মারিয়ারা। কোপা আমেরিকার চ্যাম্পিয়ন হিসেবে হারিয়েছেন ইউরোর চ্যাম্পিয়ন ইতালিকেও। মেসির রাজমুকুটে দরকার আর একটি পালক। বিদায়বেলায় এই ৩৫ বছর বয়সে বিশ্বকাপকে একবার কাছ থেকে ছুঁয়ে দেখার আক্ষেপ ঘোচাতে পারবেন না ছোট্ট জাদুকর?

সি গ্রুপে আর্জেন্টিনা, সৌদি আরব, মেক্সিকো, পোল্যান্ডের মধ্যে আর্জেন্টিনাই ফেবারিট। দ্বিতীয় সেরা দল হিসেবে লড়াই হবে পোল্যান্ড আর মেক্সিকোর মধ্যে। রবার্ট লেফানডফস্কির সম্মানে পোল্যান্ড নিশ্চয়ই চাইবে তাদের যাত্রাকে নকআউট রাউন্ডে নিয়ে যেতে। সময়ের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার লেফানডফস্কির বয়স ৩৪। এ বয়সে এসেও তাঁর ফিনিশিং ক্ষুরধার। ক্লাব ফুটবলে একের পর এক জিতে চলেছেন শিরোপা। আন্তর্জাতিক ফুটবলে পোল্যান্ডের হয়ে শেষবারের মতো কিছু জেতার চেষ্টা করতে মরিয়া হয়ে থাকবেন তিনিও।

রবার্ট লেফানডফস্কি

গোল আর রেকর্ডের সঙ্গে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর সখ্য বহু পুরোনো। ফুটবল–বিশ্বে তাঁর যখন আবির্ভাব, তখন রোনালদো বলে একজন সুপারস্টার ছিলেন। রোনালদো বলতে ওই ব্রাজিলিয়ানকেই চিনত সবাই। আর ক্রিস্টিয়ানোকে বোঝাতে বলতে হতো ‘ছোট রোনালদো’। কিংবা পুরো নাম ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। সেখান থেকে কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায় আর একাগ্রতা দিয়ে এক অসম্ভব উচ্চতায় তুলেছেন নিজেকে। এখন রোনালদো বলতে সবাই তাঁকেই চেনেন, আর ব্রাজিলিয়ান রোনালদোকে চিনতে হয় ‘রোনালদো নাজারিও’ নামে!

বিশ্বকাপে পর্তুগাল সব সময় ফার্স্টবেঞ্চার। কিন্তু ফলের বেলায় পেছনে পড়ে যায় তারা। লুইস ফিগো থেকে আস্তে আস্তে দলের নেতৃত্ব এসে পৌঁছেছে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর বাহুতে। কিন্তু ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি তাঁদের। জাতীয় দলের হয়ে ইউরোর মতো বড় শিরোপা জিতলেও বিশ্বকাপে কখনো ফাইনাল খেলা হয়নি এই সুপারস্টারের। সেই ২০০৬ সালে সেমিফাইনাল খেলার পর, কখনো শেষ ১৬ পেরোতে পারেনি পর্তুগাল।

৭ নম্বর জার্সি গায়ে নিজের শেষ বিশ্বকাপটা নিশ্চয়ই স্মরণীয় করে রাখতে চাইবেন রোনালদো। যদিও ঘানা, উরুগুয়ে আর দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে একই গ্রুপ থেকে দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠার লড়াইটা সহজ হবে না। কিন্তু এটা তো শ্রেষ্ঠত্ব পাওয়ার নিয়ম। কঠিন সব চড়াই-উতরাই পার হয়েই না বিজয়ীর মুকুট মাথায় পরেন নায়ক! নিখুঁত ফিনিশিংয়ে প্রতিপক্ষের জালে বল জড়িয়ে কর্নার ফ্ল্যাগের কাছে গিয়ে রোনালদো করবেন সেই ট্রেডমার্ক গোল উদ্‌যাপন!

সঙ্গী হিসেবে থাকা বার্নার্ডো সিলভা-রুবেন ডিয়াসরাও যোগ্য সতীর্থ। এখন কেবল মাঠের লড়াইয়ে প্রমাণ করার পালা। যদিও অতি রক্ষণমনস্ক ফুটবল খেলার কারণে সমালোচনার স্বীকার হতে হচ্ছে পর্তুগিজদের। কিন্তু সব সমালোচনার বিপরীতে বিশ্বকাপ জয়ের চেয়ে বড় জবাব আর কীই–বা হতে পারে! রোনালদোর জন্যও ট্রফির চেয়ে সেরা বিদায় উপহার আর কিছু হতে পারে না।

এডিনসন কাভানি

উরুগুয়ের দুই ভরসা লুইস সুয়ারেজ আর এডিনসন কাভানি। দীর্ঘদিন নেতৃত্ব দিয়েছেন দলের আক্রমণভাগ। সুয়ারেজ-কাভানি দুজনের বয়স ৩৫। সুয়ারেজ ফিরে গেছেন উরুগুয়েতেই, তাঁর ছেলেবেলার ক্লাবে। কাভানি খেলছেন লা লিগায়, ভিয়ারিয়ালে। এই বিশ্বকাপেই শেষবারের মতো দেখা যাবে উরুগুয়ের ইতিহাসের অন্যতম সেরা দুই স্ট্রাইকার। উরুগুয়ে দলও নিশ্চয়ই চাইবে দুই নায়ককে নায়কোচিত বিদায় উপহার দিতে। ২০১০ বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল খেলেছিল উরুগুয়ে। তারপর আর পেরোতে পারেনি কোয়ার্টার ফাইনালও। শেষবেলায় সুয়ারেজ-কাভানির কাছে দারুণ কিছু আশা করতেই পারে উরুগুয়ের সমর্থকেরা।

৩৫ বছরের লিওনেল মেসি, ৩৭ বছরের রোনালদো—তাঁদের পাশে নেইমার জুনিয়রের বয়স আহামরি বেশি নয়। কেবল ৩০ বছর। আধুনিক ফিটনেসের যুগে এখন এই বয়সকে বুড়ো বলার জো নেই। ফিটনেস–সচেতন থাকলে দিব্যি সামনের বিশ্বকাপও খেলতে পারবেন নেইমার। কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন জুড়ে দেয় ইনজুরি। অন্যদের চেয়ে বেশি ইনজুরিপ্রবণ এই ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার প্রায় প্রতিবছরই কোনো না কোনো বড় ইনজুরিতে পড়েছেন। এভাবে চলতে থাকলে নেইমারের জন্য আগামী বিশ্বকাপ খেলা একরকম অসম্ভব স্বপ্নই মনে হয়। ভক্তদের প্রার্থনায় হয়তো সেই অসম্ভবকে ছুঁয়ে ফেলতেও পারেন তিনি, কে জানে! অন্তত ব্রাজিলভক্তরা এটাকে নেইমারের শেষ বিশ্বকাপ বলতে রাজি নন।

থিয়াগো সিলভা

তবে শেষবারের মতো বিশ্বকাপ খেলবেন ব্রাজিলের রক্ষণভাগের নির্ভরযোগ্য প্রহরী থিয়াগো সিলভা। সব ঠিক থাকলে ৩৮ বছর বয়সেও ব্রাজিলের মতো বড় দলের মূল ভরসা হবেন এই ডিফেন্ডার। বয়স ৩৮ হলেও থিয়াগো সিলভা এখনো যেন ২৬ বছরের কোনো তরুণ। দারুণ ডিফেন্স–নৈপুণ্য দেখিয়ে চলেছেন ক্লাব ফুটবলে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের মতো কঠিন লিগে চেলসির রক্ষণে এই বয়সেও প্রথম পছন্দ তিনি। ব্রাজিলের বিশ্বকাপ–যাত্রায় থিয়াগো সিলভা বেশ পুরোনো সারথি, দারুণ ছন্দে থাকা নেইমার-ভিনিসিয়াসরা নিশ্চয়ই চাইবেন তাঁকে মনে রাখার মতো বিদায় দিতে।

সার্বিয়া, সুইজারল্যান্ড ও ক্যামেরুনের সঙ্গে গ্রুপ ভাগাভাগি করছে ব্রাজিল। টুর্নামেন্টের আগে থাকা ফর্ম ধরে রাখতে পারলে সহজেই গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে নকআউট রাউন্ডে নাম লেখাবে তারা। সর্বশেষ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বাদ পড়া সেলেকাওরা চাইবে এবার নিজেদের সেরাটা দিয়ে শিরোপার কাছাকাছি যেতে। ২০০২ বিশ্বকাপের পর আর ফাইনাল খেলতে পারেনি পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা।

কেভিন ডি ব্রুইনা

ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা যদি নিজেদের গ্রুপে চ্যাম্পিয়ন হয়ে নকআউট রাউন্ডে উঠতে পারে এবং সব ম্যাচ জিততে পারে, তাহলে সেমিফাইনালে দেখা হবে দুই দলের। কোনো এক দল গ্রুপ রানার্সআপ হলে আর নকআউট রাউন্ডের সব ম্যাচ জিততে পারলে বিশ্বকাপ ফাইনালে মঞ্চস্থ হবে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার মহারণ।

সর্বশেষ বিশ্বকাপজয়ী ফরাসি অধিনায়ক হুগো লরিসও খুব সম্ভবত নিজের শেষ বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছেন। ৩৫ বছর বয়সী লরিসকে আগামী বিশ্বকাপে ফ্রান্সের গোলবারে দাঁড়াতে দেখার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। তাঁর সঙ্গে শেষ বিশ্বকাপ খেলবেন করিম বেনজেমাও। সর্বশেষ ব্যালন ডি’অর জেতা করিম বেনজেমা অনেক দিন উপেক্ষিত ছিলেন ফ্রান্স জাতীয় দলে। গত বিশ্বকাপের স্কোয়াডে জায়গা মেলেনি তাঁর। সুস্থ থাকলে এবার জায়গা তো মিলবেই, নেতৃত্ব দেবেন দলের আক্রমণভাগেও।

ডি গ্রুপে থাকা ফ্রান্সের গ্রুপসঙ্গীরা হলো অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক ও তিউনিসিয়া। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডকে সহজ করে নেওয়া গেলেও ডেনমার্কের সামনে কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে ল ব্লুজদের। গত ইউরোতে সবাইকে চমকে দিয়ে সেমিফাইনাল খেলা ডেনিশদের প্রাক্‌-বিশ্বকাপ ফর্মও একেবারে মন্দ নয়। ডেনমার্কের হয়ে শেষ বিশ্বকাপ খেলতে পারেন তাদের অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার ক্রিশ্চিয়ান এরিকসেন। ইউরোর ম্যাচ চলাকালে হার্ট অ্যাটাক করায় তাঁর জন্য অশ্রুসিক্ত হয়েছিলেন লাখো ফুটবলভক্ত। এরিকসনের আরেকটি বিশ্বকাপ খেলার মৃদু সম্ভাবনা থাকলেও তাঁদের গোলকিপার ক্যাসপার স্মাইকেল এবং ডিফেন্ডার সিমন কায়েরের সেই সম্ভাবনা একেবারেই নেই। ডেনিশ ফুটবলের কিংবদন্তিসম এই দুই পুরুষকে বিদায় জানাতে যে আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি হবে, তা না বললেও চলে।

ম্যানুয়েল নয়্যার

ম্যানুয়েল নয়্যার ও থমাস মুলার—জার্মানির উত্থানে সামনের সারিতে থেকে অবদান রেখেছেন দুজনই। শেষ বিশ্বকাপ হতে যাচ্ছে তাঁদেরও। ৩৬ বছর বয়সী নয়্যার আর ৩৩ বছরের মুলারের কাছে তাই জার্মানদের প্রত্যাশা একটু বেশি। এ বয়সে এসেও গোলবারের নিচে অতন্দ্রপ্রহরী নয়্যার। ফর্মের বিচারে কম যান না থমাস মুলারও। বিশ্বকাপে গোলসংখ্যার বিচারে বর্তমান সময়ের ফুটবলারদের মধ্যে মুলারই এগিয়ে আছেন। ১০ গোল নিয়ে বিশ্বকাপ শুরু করবেন তিনি। আর মাত্র ৬টি গোল করতে পারলে সর্বোচ্চ গোলদাতার রেকর্ডে ভাগ বসাবেন সাবেক সতীর্থ মিরোস্লাভ ক্লোসার সঙ্গে। মুলারের জন্য এবারের বিশ্বকাপ তাই আলাদা অর্থ বহন করবে।

ফর্মের বিচারে জার্মানরা তেমন একটা সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। স্বর্ণালি সময় তো পার হয়েছেই, গত বিশ্বকাপে এবং ইউরোতে অপ্রত্যাশিতভাবে দ্রুত বিদায় নিতে হয়েছে তাঁদের। কিমিখ-গুন্ডোগানদের নিয়ে গড়া জার্মানির বর্তমান স্কোয়াডে রয়েছে তারুণ্য ও অভিজ্ঞতার মিশেল। তবু একই গ্রুপে থাকা স্পেন, কোস্টারিকা আর জাপানের সামনে কঠিন প্রতিরোধে পড়তে হবে।

থমাস মুলার

স্পেনের অবস্থাও অনেকটা জার্মানির মতোই। সুদিন পার করে এসেছে, বিদায় নিয়েছেন সব তারকা খেলোয়াড়। এখন আবার নতুন করে থিতু হতে হচ্ছে তরুণ ফুটবলারদের। কোচ লুইস এনরিকে ভালোভাবেই করছেন সেটা। পেদ্রি-গাভিদের নতুন প্রজন্মের ওপর তাই এখনই নজর এসে পড়ে। নতুন প্রজন্মের স্পেন তাই জার্মানদের সামলে পরের রাউন্ডে যাওয়ার অগ্নিপরীক্ষায় কতখানি সফল হবে, সেটা সময়ই ভালো বলবে।

লুকা মদরিচ

৩৭ বছর বয়সী লুকা মদরিচকে দেখে এখনো বোঝার উপায় নেই, এটা তাঁর শেষ বিশ্বকাপ। তরুণদের টেক্কা দিয়ে এখনো রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে খেলে যাচ্ছেন সমানভাবে। গত মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদের জার্সিতে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার পাশাপাশি ক্রোয়েশিয়ার হয়েও আছেন দারুণ ফর্মে। ২০১৮ বিশ্বকাপে সবাইকে চমকে দিয়ে ফাইনাল খেলা ক্রোয়েশিয়া এবারও চাইবে মদরিচের কাঁধে ভর করে অনেক দূর যেতে। এফ গ্রুপে ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গী দলগুলো হচ্ছে কানাডা, মরক্কো ও বেলজিয়াম।

ক্রোয়াটদের মতো বেলজিয়ামেরও স্বর্ণালি যুগের শেষ বিশ্বকাপ এটা। এডেন হ্যাজার্ড, কেভিন ডি ব্রুইনা, ইয়ান ভেরতগনেন, টবি আল্ডারওয়াইল্ডদের বয়স ৩০ ছাড়িয়েছে। কাতার বিশ্বকাপে শেষবারের মতো মাঠে নামবেন বেলজিয়ামের বেশির ভাগ খেলোয়াড়। গত বিশ্বকাপের সেমিফাইনালিস্ট বেলজিয়ামকে নিয়ে এবারও বড় আশা করছেন অনেক ফুটবলবিশারদ। এমনকি ইউরোপের দলগুলোর মধ্যে তাঁরাই অন্যদের তুলনায় ভালো করবেন বলছেন অনেকে।

এডেন হ্যাজার্ড

গত বিশ্বকাপের আরেক সেমিফাইনালিস্ট ইংল্যান্ড। তাদের মধ্যমাঠের কান্ডারি জর্ডান হেন্ডারসন খেলবেন শেষ বিশ্বকাপ। হ্যারি কেন, স্টার্লিং, ফোডেনদের নিয়ে তারকাবহুল স্কোয়াড ইংল্যান্ডের। গত ইউরোর ফাইনালেও খেলেছে দলটি। ‘ইটস কামিং হোম’ স্লোগানে সর্বত্র মুখর করে রাখা ইংলিশ ভক্তরা এবার সত্যি সত্যিই আশা রাখছেন বিশ্বকাপ জিতে ট্রফিকে ঘরে আনার। কিন্তু তাদের কোচ গ্যারেথ সাউথগেটের রক্ষণাত্মক কৌশলের কারণে সন্দিহান অনেক ফুটবল–পণ্ডিত। বি গ্রুপে ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হবে যুক্তরাষ্ট্র, ইরান ও ওয়েলস। গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হতে পারলে ইংল্যান্ডের কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার রাস্তা অন্যদের চেয়ে তুলনামূলক সহজ।

টোটাল ফুটবলের দেশ নেদারল্যান্ডস ছাড়া বিশ্বকাপের অভিজ্ঞতা ঘটেছে ২০১৮ বিশ্বকাপে। এবার তারা কোনো অঘটন ঘটতে দেয়নি। বাছাইপর্বে নিজেদের শক্ত পারফরম্যান্স দেখিয়ে বিশ্বকাপের মূল পর্বে জায়গা করে নিয়েছে ডাচরা। কিংবদন্তি ডাচ কোচ লুই ফন হালেরও হয়তো এটাই শেষ বিশ্বকাপ। ৭১ বছর বয়সী এ কোচের অধীন ২০১৪ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলেছিল নেদারল্যান্ডস। এবারও তাঁর অধীন থাকা দলটি যে কারও জন্য শক্ত প্রতিপক্ষ। ডাচ ফুটবলের নতুন উত্থান দেখা যেতে পারে ডি ইয়ং, ডি লিট, ফন ডাইকদের হাত ধরে। এ গ্রুপে তারা প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পাচ্ছে স্বাগতিক কাতার, আফ্রিকান চ্যাম্পিয়ন সেনেগাল ও ইকুয়েডরকে। গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হতে পারলে কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়ার রাস্তাটাও ইংল্যান্ডের মতো তুলনামূলক সহজ ডাচদের জন্য।

তবে আয়োজনের হিসাবে এবারের বিশ্বকাপ কিন্তু অন্যবারের চেয়ে আলাদা। সাধারণত, জুন-জুলাই মাসে ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপের আয়োজন করে থাকে। প্রথমবারের মতো আয়োজক হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতার। তাই এবার নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে আয়োজন করা হচ্ছে বিশ্বকাপ। জুন-জুলাই মাসের প্রচণ্ড গরম এড়াতেই এ সিদ্ধান্ত। তাই প্রথমবারের মতো শীতের রাতে বিশ্বকাপ দেখার আনন্দই হবে অন্য রকম।

বিশ্বকাপ শুরু হতে আর কয়েকটা দিন বাকি। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শেষ হলেও তীব্র হবে ফিফা বিশ্বকাপের আমেজ। চায়ের দোকান, বন্ধুদের আড্ডায়, সামাজিক মাধ্যমের দেয়ালে সবাই মেতে উঠবে বিশ্বকাপ নিয়ে। কেউ বলবে আর্জেন্টিনার জয়রথ থামানো যাবে না, কেউ বলছেন র‌্যাঙ্কিংয়ের এক নম্বরে থাকা ব্রাজিল কি ছেড়ে কথা বলবে নাকি? এক অদ্ভুত মিষ্টি-মধুর সময় আমাদের মতো ফুটবল–সমর্থকদের জন্য। প্রতিবার ফুটবল বিশ্বকাপ এলে চারপাশের এমন উন্মাদনা দেখলে যেন উৎসব উৎসব মনে হয়!

কাতার বিশ্বকাপ ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত বিশ্বকাপ হয়ে উঠবে এবার। আধুনিক ফুটবলের অনেক তারকাই বিদায় নেবেন এবারের মঞ্চে। কারও ভাঙবে মন, কারও চোখে নামবে আনন্দের অশ্রুধারা। শেষবারের মতো প্রিয় তারকাকে টিভি সেট কিংবা স্ক্রিনের সামনে খেলতে দেখে সাক্ষী হব ইতিহাসের, অজান্তে হয়তো আর্দ্র হয়ে উঠবে চোখের কোণ। একটা চর্মগোলককে ঘিরে এত আয়োজন, এত অনুভূতির অবতারণা—ফুটবল খেলা এক বিস্ময়ই বটে!