ইউরোপজুড়ে কেন কাতার বিশ্বকাপ বয়কটের ডাক

‘বয়কট কাতার’ লেখা নিয়ে স্টেডিয়ামে ডর্টমান্ড সমর্থকরা

১৯৯৮ সালের জুন মাসে ফিফা সভাপতি হিসেবে হোয়াও হাভেলাঙ্গের স্থলাভিষিক্ত হন সেপ ব্লাটার। টানা ১৭ বছর দায়িত্ব পালন করে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে দায়িত্ব ছাড়েন তিনি। এর পরপরই দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা অভিযোগের তির ছুটে আসে ব্লাটারের দিকে। এর বেশ কিছু অভিযোগ প্রমাণিত হয়, আর ২০২৮ সাল পর্যন্ত ফুটবলের সব ধরনের কার্যক্রম থেকে ব্লাটারকে নিষিদ্ধ করে ফিফা।

সভাপতি থাকাকালে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন ব্লাটার। তার মধ্যে সবচেয়ে বিতর্কিত ঘটনাটি ছিল ২০২২ বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব কাতারকে দেওয়া।

২০১০ সালের ২ ডিসেম্বর, ২০২২ বিশ্বকাপের আয়োজনের স্বাগতিক দেশ হিসেবে কাতারকে বেছে নেওয়ার পর থেকে শুরু হয় ব্যাপক সমালোচনা। ফুটবলপাড়ায় গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে, দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে কাতারকে বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। ফিফার এই সিদ্ধান্তে আপত্তি জানায় অনেক দেশের ফুটবল সংস্থাও। তাদের এই প্রতিবাদ আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে এলে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামানো বন্ধ করে দেয় ফিফা।

কিন্তু কাতার বিশ্বকাপ এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে আবারও বিশ্বজুড়ে কাতারের বিশ্বকাপ আয়োজন নিয়ে প্রতিবাদ শুরু হতে থাকে। দুর্নীতির মাধ্যমে বিশ্বকাপ আয়োজক হওয়ার অভিযোগের সঙ্গে এবার যোগ হয় কর্তৃপক্ষের অবহেলায় বিভিন্ন স্টেডিয়ামে কাজ করার সময় নির্মাণশ্রমিকদের মৃত্যুও। পাশাপাশি ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নভেম্বর-ডিসেম্বরে আয়োজিত হচ্ছে বিশ্বকাপ। এ সময়ে ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন বড় বড় ফুটবল লিগ থাকে তুঙ্গে। এই অসময়ে বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হওয়ায় চোটাক্রান্ত হয়ে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেছেন অনেক তারকা ফুটবলার। সবকিছু মিলিয়ে কাতার বিশ্বকাপ ঘিরে আবারও তুমুল সমালোচনা শুরু হয়। বিভিন্ন দেশের ফুটবল–ভক্তসহ নানা জগতের তারকারা নতুন করে ডাক দেন কাতার বিশ্বকাপ বয়কট করার।

জার্মানি, ফ্রান্সের মতো ফুটবল–ভক্ত দেশের জনগণ ইতিমধ্যে অনলাইনে ও অফলাইনে সরব হয়েছেন কাতার বিশ্বকাপের বিরুদ্ধে। জার্মান লিগ বুন্দেসলিগার বেশির ভাগ ম্যাচে দর্শকদের দেখা গেছে ‘বয়কট কাতার’ লেখা বিশাল ব্যানার প্রদর্শন করতে। এফসি ফ্রাইবুর্গ, মেইঞ্জ, বরুসিয়া ডর্টমুন্ডে, হার্থা বার্লিন, বায়ার্ন মিউনিখ, অগসবুর্গসহ প্রতিটি দলের সমর্থকেরা নিজ দলের খেলার সময় বিভিন্নভাবে কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজনের প্রতিবাদ করেছেন। কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য জার্মানির ফুটবল সমর্থকেরা ‘বয়কট কাতার ২০২২’ নামের একটি সংগঠনও গঠন করেছেন। তাঁদের এই প্রতিবাদের কারণ জানতে চাওয়া হলে বের্ন্ড বেয়ার নামের এক ডর্টমুন্ড এবং কোলোন সমর্থক অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন, ‘২০১০ সালে কাতারকে বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব দেওয়া ছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত। আর সিদ্ধান্তটি এখনো ভুল। ফুটবল দিন দিন আরও বেশি বাণিজ্যিক হয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি যত শ্রমিক কাতারে নির্যাতিত ও নিপীড়িত হয়েছেন, তা অবিশ্বাস্য। মানবাধিকার নিয়ে কাতারের নীতিনির্ধারকদের কোনো মাথাব্যাথা নেই।’

জার্মান ফুটবল–ভক্তদের সঙ্গে এই যাত্রায় শামিল হয়েছে ফ্রান্সও। ফ্রেঞ্চ লিগ ওয়ানের বিভিন্ন ম্যাচে ভক্তদের দেখা গেছে কাতার বিশ্বকাপের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যানার–প্ল্যাকার্ড লিখে স্টেডিয়ামে আসতে। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজনের প্রতিবাদ জানিয়ে ঘোষণা দিয়েছে, বিশ্বকাপের কোনো ম্যাচ বড় পর্দায় দেখানো হবে না প্যারিসে। ফ্রেঞ্চ ক্লাব লিল, মার্শেই, বোর্দো, স্ত্রাসবুর্গ এবং রেইমসও নৈতিকভাবে এই সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ডাক দিয়েছে বিশ্বকাপ বর্জনের। কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজন করার সিদ্ধান্ত সরাসরি মানবাধিকার লঙ্ঘন করে এবং পরিবেশের জন্য চরম ক্ষতিকর আখ্যা দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন তাঁরা। সাবেক ফরাসি এবং ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড তারকা এরিক ক্যান্টোনাও জানিয়ে দিয়েছেন, এবারের বিশ্বকাপের কোনো ম্যাচ দেখছেন না তিনি।

শুধু যে ফুটবলাঙ্গনের মানুষেরা বিশ্বকাপ বর্জনের ডাক দিয়েছেন, ব্যাপারটা এমন নয়। গুঞ্জন উঠেছিল, বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পারফর্ম করবেন বিখ্যাত ব্রিটিশ পপসংগীতশিল্পী ডুয়া লিপা। নিজের ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইলে এক স্টোরির মাধ্যমে এই গুজব উড়িয়ে দিয়েছেন ডুয়া। ভক্তদের উদ্দেশে তিনি লেখেন, ‘আমি কাতার বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পারফর্ম করছি না। এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে আমার কোনো কথাও হয়নি। দূর থেকে এবার আমি ইংল্যান্ডকে সমর্থন করে যাব। যখন কাতারে সবার মানবাধিকার নিশ্চিত হবে আর কাতার বিশ্বকাপ আয়োজনের যোগ্যতা অর্জন করবে, সেদিন হয়তো আমি কাতার যাওয়ার কথা ভাবব।’

আগামীকাল শুরু হচ্ছে ফিফা বিশ্বকাপ। এত দেরিতে ভক্ত–সমর্থকদের এই বর্জনের ডাকে হয়তো এবারের বিশ্বকাপের তেমন কিছু আসবে–যাবে না। তবে এবারের প্রতিবাদ আগামী বছরগুলোয় ফিফাকে বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ নির্বাচনের আগে বেশ কয়েকবার ভাবতে বাধ্য করবে।