৮১১ দিন পর ফিরলেন পগবা

ফ্রান্সের হয়ে ২০১৮ বিশ্বকাপ জয়ের পর পল পগবাফাইল ছবি: এএফপি

বহুদিন পর মাঠে ফেরার অনুভূতি ঠিক কী রকম? স্কুল–কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া যে কারও এই অনুভূতি বেশ ভালোভাবেই জানা আছে। দীর্ঘদিন পর ব্যাট হাতে তুলে নেওয়া। বল পায়ে একটা পাস দেওয়া—এই অনুভূতির কোনো তুলনা হয় না। কিন্তু সেই অনুভূতি একজন পেশাদার খেলোয়াড়ের কাছে কী রকম? পল পগবার থেকে এই প্রশ্নের উত্তর ভালোভাবে জানার কথা নয় কারও।

পল পগবাকে ধরা হতো প্রজন্মের সেরা মিডফিল্ডারদের একজন। বল পায়ে এমন কিছু নেই, যেটা করতে পারতেন না তিনি। ডিফেন্সে সাহায্য লাগবে, পগবা আছেন। মাঝমাঠে বল ধরে রাখা লাগবে, পগবা আছেন। অ্যাটাকাররা বল পাচ্ছেন না, পগবার দুর্দান্ত পাসই যথেষ্ট ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে। মাঝমাঠের অলরাউন্ডার ছিলেন পল পগবা। ফ্রান্সের কোচ দিদিয়ের দেশম তাই তাঁর কোচিং ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় বাজি রাখতেন তাঁর ওপরে। পগবা যেন ‘ওয়ান–স্টপ সলিউশন সেন্টার’, যেখানে সব সমস্যার সমাধান মেলে। সেই পগবা হারিয়ে গিয়েছিলেন ফুটবলের দুনিয়া থেকে।

‘হেয়ার স্টাইল’ আর ‘খেলার স্টাইল’ ছিল পগবার সবকিছু
ছবি: রয়টার্স

৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩। এম্পোলির বিপক্ষে জুভেন্টাসের জার্সিতে শেষ দেখা গিয়েছিল পগবাকে। চোট থেকে ফিরে সেদিন মাত্র ২৮ মিনিটের জন্য মাঠে নেমেছিলেন ফরাসি মিডফিল্ড মায়েস্ত্রো। সেদিনই বদলে যায় তাঁর জীবনের চিত্র। যদিও ঘটনার সূত্রপাত এর কিছুদিন আগে। ২০ আগস্ট উদিনেসের মাঠে খেলতে গিয়েছিল জুভেন্টাস। সেদিন মাঠে না নামলেও ম্যাচের শেষে রুটিন চেকআপের অংশ হিসেবে তাঁর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো হয়। সেই পরীক্ষায় টেস্টোস্টেরনের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি ধরা পড়েছে। সাময়িকভাবে তখনই তাঁকে নিষিদ্ধ করা হয় খেলা থেকে। এরপরও চলতে থাকে বেশ কিছু পরীক্ষা।

জুভেন্টাস ও ইতালিয়ান বোর্ড তাঁকে কিছুদিন সময় দিয়েছিল, নিজেকে প্রমাণ করার। কিন্তু ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে আনুষ্ঠানিক নির্দেশনা আসে অ্যান্টি-ডোপিং কোর্ট থেকে। পগবার বিপক্ষে শক্ত প্রমাণ পাওয়া গেছে। নিয়ম অনুযায়ী তাঁকে নিষিদ্ধ করা হয় চার বছরের জন্য। সব ধরনের খেলাধুলা থেকে দূরে থাকতে হবে তাঁকে। পগবার বয়স যখন মাত্র ৩০। মাঝমাঠের তারকাদের জন্য নিজের কারিকুরি দেখানোর একদম সেরা সময়। অথচ সেই সময়টাতেই ফুটবল থেকে তাঁকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় ফিফা। সবাই ধরেই নিয়েছিলেন, পগবার ক্যারিয়ারের বুঝি এখানেই ইতি টানা হয়ে গেছে।

মোনাকোর সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেন পগবা।
ছবি: এক্স

পগবা নিজেও হয়তো তা–ই ভেবেছিলেন। কারণ, পেশাদার ফুটবল তো দূরে থাক, নিজের মতো করে ট্রেনিং করার, নিজেকে শাণিত করার কিংবা আন-অফিশিয়াল কোনো লিগে গিয়েও খেলার সুযোগ হারিয়েছেন তিনি। নিজের অজান্তে নিষিদ্ধ ওষুধ খেয়ে ক্যারিয়ারের ইতি টেনেছেন নিজেই। অবশেষে আন্তর্জাতিক ক্রীড়া আদালতে (সিএএস) আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে পগবার নিষেধাজ্ঞা ৪ বছর থেকে নেমে এসেছে ১৮ মাসে।

পগবা ভেবেছিলেন জুভেন্টাসের জার্সিতেই হয়তো ফিরবেন তিনি। তাঁর নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২৫ সালের ১১ মার্চ, জন্মদিনের মাত্র চার দিন আগে। কিন্তু সেই আশা গুড়ে বালি করে তাঁকে বিদায় করে দেয় জুভেন্টাস। পগবার ওপর ভরসা রাখতে পারেনি কেউই। তাই তো পগবার সময় কেটেছে স্পিডের সঙ্গে লাইভ স্ট্রিম করে, যেখানে স্পিডকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়েছে ছোট ছোট বাচ্চারা, কিন্তু তাঁকে চিনতে পারেনি কেউ। পগবা সেই কষ্ট সয়ে ফিরে এসেছেন মাঠে।

অবশেষে তাঁর জন্য এগিয়ে এল মোনাকো। জুনের শেষ দিকে এসে পগবাকে এক বছরের জন্য দলে ভেড়ায় ফ্রেঞ্চ দলটি। চুক্তিপত্রের দিকে তাকিয়ে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি পগবা। কাঁদতে কাঁদতে নিজের ভবিষ্যতের রাস্তা মেপে নিয়েছিলেন। বিশ্বকাপজয়ী খেলোয়াড়, একসময়ের সবচেয়ে দামি খেলোয়াড়, নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলেন সবকিছুর মধ্যে। একসময় যেখানে ছিল শুধুই অন্ধকার, সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছেন। স্বপ্ন দেখছেন নতুন করে শুরু করার। সেদিন কান্নাজড়িত কণ্ঠে পগবা কথা দিয়েছিলেন, ফুটবলে ফিরতে যা দরকার, সবকিছু করবেন তিনি। পগবা সেই কথা রেখেছেন। প্রায় পাঁচ মাস পেরিয়েছে। পগবা প্রতিদিন ট্রেনিংয়ে ঘাম ঝরিয়েছেন। নিজেকে শাণিত করেছেন, প্রস্তুত করেছেন মাঠে নামার জন্য।

আট মিনিটের জন্য মাঠে নেমেছিলেন পগবা
ছবি: এক্স

অবশেষে ফ্রেঞ্চ লিগে রেঁনের বিপক্ষে সেই সুযোগ মিলল পগবার। হোক না সেটা ৮ মিনিটের জন্য। রেঁনের বিপক্ষে ম্যাচ আগেই হারিয়ে ফেলেছিল মোনাকো। ৬৬ মিনিটে ডেনিস জাকারিয়ার লাল কার্ড, ৮৩ মিনিটে চার গোল হজম করার পর পগবা নেমেছিলেন মাঠে। সেই কয় মিনিটেই নিজের ঝলকটা দেখিয়েছেন। প্রতিভার মৃত্যু হয় না, শুধু একটু শান দেওয়া দরকার। পগবা সেই মন্ত্র নিয়েই মাঠে নেমেছিলেন। দর্শকরাও হেরে যাওয়া ম্যাচে স্বাগত জানিয়েছে তাঁকে।

৩২ বছর বয়সে এসে পগবার ফিরে আসার গল্প যেন নতুন করে মনে করিয়ে দেয়, জীবনে শেষ বলে কিছু নেই। জীবন দ্বিতীয় সুযোগ তুলে দেবে হাতে। সেটা ব্যবহার করার সবচেয়ে বড় দায়িত্ব তোমাদের।