ফিঞ্চ অধ্যায়ের অবসান

২০১৮ সালের কথা। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ড মিলে খেলছে ট্রান্স-তাসমান টি-টোয়েন্টি সিরিজ। সিরিজের পঞ্চম ম্যাচটি খেলে নিউজিল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়া। শুরুতে ব্যাটিংয়ে নেমে মার্টিন গাপটিলের সেঞ্চুরিতে ২৪৩ রানের বিশাল সংগ্রহ পায় কিউইরা। এই ম্যাচ জিততে হলে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে সর্বোচ্চ রান তাড়া করে রেকর্ড গড়তে হবে অস্ট্রেলিয়াকে। দুই ওপেনার ডেভিড ওয়ার্নার আর ডার্সি শর্ট শুরুতেই অস্ট্রেলিয়াকে এনে দেন শক্ত ভিত। ম্যাচ জিততে যেহেতু করতে হবে ২৪৪ রান, কাঙ্ক্ষিত রানরেট সব সময়ই ওঠানামা করছিল ৯–এর আশপাশেই।

এরই মধ্যে প্রায় একই সঙ্গে আউট হয়ে গেলেন দুই সেট ব্যাটসম্যান শর্ট আর ম্যাক্সওয়েল। ক্রিজে এলেন অ্যারন ফিঞ্চ। জয়ের জন্য অস্ট্রেলিয়ার দরকার ৪ ওভারে ৪২ রান। তবে রানরেট যে ১০–এরও ওপরে, ফিঞ্চকে দেখে তা বোঝার কোনো উপায় নেই। চুইংগাম চিবোচ্ছেন নির্বিকার ভঙ্গিতে। তাঁর টগবগে আত্মবিশ্বাসে পুড়লেন বিশ্বের অন্যতম সেরা বোলার ট্রেন্ট বোল্ট। ১৭তম ওভারে এল ২৫ রান, যার ২৪ রানই নিলেন ফিঞ্চ। ম্যাচটা কার্যত শেষ ওই ওভারেই।

যদিও এই ম্যাচের নায়ক অ্যারন ফিঞ্চ নন। কিন্তু তাঁর গোটা ক্যারিয়ারের ছোট্ট একটা চিত্র তুলে ধরে এই ইনিংসটি। খেলার পরিস্থিতি কেমন, ফিঞ্চের চেহারা দেখে সেটা বোঝার কোনো উপায় ছিল না কখনো। যতক্ষণ ক্রিজে থাকতেন, এক মুহূর্তের জন্যও বিচলিত মনে হতো না তাঁকে। এমনকি যেদিন ব্যাটিংটা প্রত্যাশা অনুযায়ী করতে পারতেন না, সেদিনও খুব স্বাভাবিকভাবেই মাঠ থেকে বেরিয়ে যেতেন। খেলাটা এতটাই সহজাত ছিল এই অস্ট্রেলিয়ান ওপেনারের কাছে।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে অ্যারন ফিঞ্চ অবসর নিয়েছিলেন ওয়ানডে আর টেস্ট থেকে। দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। গ্রুপ পর্ব থেকে অস্ট্রেলিয়া বিদায় নেওয়ার পর টি-টোয়েন্টি দলের অধিনায়কত্ব নিয়ে চলছিল আলোচনা। অবসরের ঘোষণা দিয়ে সেই আলোচনার অবসান ঘটিয়ে দিলেন ফিঞ্চ নিজেই।

ক্রিকেটের তিন সংস্করণে খেললেও মূলত সাদা বলের ক্রিকেটে নিজের জাত চিনিয়েছেন ফিঞ্চ। ২০১১ সালের ১২ জানুয়ারি ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি ম্যাচে অভিষেক হয় তাঁর। এর দুই বছর পর, ২০১৩ সালের ১১ জানুয়ারি শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে খেলেন ক্যারিয়ারের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচ। পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলেছেন পাঁচটি টেস্ট ম্যাচও।

অভিষেকের পর থেকেই অস্ট্রেলিয়া দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ অ্যারন ফিঞ্চ। দেশের হয়ে ১৪৬ ওয়ানডে খেলে ১৭ সেঞ্চুরি আর ৩০ ফিফটিতে করেছেন ৫৪০৬ রান। টি-টোয়েন্টিতে ফিঞ্চ আরও সফল, ১০৩ ম্যাচে ৩৪.২৯ গড় আর ১৪২.৫৩ স্ট্রাইক রেটে সংগ্রহ করেছেন ৩১২০ রান। ২০১৮ সালে হারারেতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে মাত্র ৭৬ বলে ১০ ছয় আর ১৬ চারে খেলেন ১৭২ রানের অবিশ্বাস্য ইনিংস। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহের রেকর্ড এটি।

মাইকেল ক্লার্কের নেতৃত্বে ২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে অস্ট্রেলিয়া। অস্ট্রেলিয়ার সেই বিশ্বকাপ দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন অ্যারন ফিঞ্চ। ২০১৮ সালে বল টেম্পারিংয়ের দায়ে এক বছরের জন্য নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েন অস্ট্রেলিয়ার তৎকালীন অধিনায়ক স্টিভ স্মিথ আর সহ-অধিনায়ক ডেভিড ওয়ার্নার। দলের ওই দোদুল্যমান পরিস্থিতিতে ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টি দলের অধিনায়কত্ব তুলে দেওয়া হলো ফিঞ্চের হাতে। অস্ট্রেলিয়াকে ৫৫টি ওয়ানডে এবং ৭৬টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে নেতৃত্ব দেন তিনি। যার মধ্যে ৩১টি জয় পান ওয়ানডেতে, আর টি-টোয়েন্টিতে পান ৪১ জয়।

অধিনায়ক হিসেবে ফিঞ্চের সবচেয়ে বড় অর্জন ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়। বিশ্বকাপের আগে ফর্মের অভাবে রীতিমতো ধুঁকছিলেন তিনি। অধিনায়কত্ব তো বটেই, আলোচনা চলছিল তাঁকে দল থেকে বাদ দেওয়ারও। কিন্তু সব সমালোচনাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন ফিঞ্চ, প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়াও জিতে নেয় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ।

২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর থেকেই নিজের অবসর নিয়ে ভাবছিলেন ফিঞ্চ। দলে নতুনদের সুযোগ করে দিতেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানান তিনি, ‘২০২৪ টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ যে আমার পক্ষে খেলা সম্ভব নয়, সেটা আমি জানি। ফলে এখনই বিদায় বলার সঠিক সময়। তাহলে বিশ্বকাপের আগেই নতুন আর গোছানো একটা দল পাব আমরা।’

আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিলেও ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলো আরও কিছুদিন খেলে যাবেন ফিঞ্চ। বিগ ব্যাশে মেলবোর্ন রেনেগেডসের হয়ে খেলতে চান আরও কয়েক বছর। পাশাপাশি খেলবেন অন্যান্য লিগেও। অবসর নিলেও আরও বেশ কিছুদিন ফিঞ্চের খেলা উপভোগ করা যাবে, ভক্তদের জন্য সান্ত্বনা এখন এটিই।