৫০ বছরের পুরোনো আটারি গেম কীভাবে দাবা খেলায় চ্যাটজিপিটিকে হারিয়ে দিল
একটা গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। একদল প্রযুক্তিবিদ ধুলা পড়া পুরোনো একটা আটারি কনসোল বের করলেন। কনসোলটা দাবা খেলায় পটু। ওটা দিয়ে মজার মজার গেম খেলা যেত। সেই সময়ে আটারি ছিল একটা দারুণ জিনিস। এখনকার দিনের স্মার্টফোন বা কম্পিউটারের মতো অত শক্তিশালী না হলেও ওটা ছিল তখনকার সময়ের সেরা। প্রযুক্তিবিদেরা ভাবলেন, দেখি তো পুরোনো দিনের সেই আটারি বর্তমানের অত্যাধুনিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে লড়তে পারে কি না। স্বাভাবিকভাবেই এমন অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে আটারির পেরে ওঠার কথা নয়। ভাবো তো, বাংলাদেশ ফুটবল দলকে যদি পূর্ণ শক্তির স্পেনের সঙ্গে খেলতে নামিয়ে দেওয়া হয়, কেউ কি ভাববে যে বাংলাদেশ ম্যাচটা জিতলেও জিততে পারে? হয়তো না। তেমনি পুরোনো আটারি যে আধুনিক প্রযুক্তির বিপক্ষে জিততে পারে, তা–ও কেউ ভাবেনি।
বাস্তবে আটারি কনসোল আধুনিক এআইকে হারিয়ে দিল। ব্যাপারটা শুধু একবার ঘটলে দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু একই ঘটনা বারবার ঘটলে তো আর দুর্ঘটনা বলা যায় না। আধুনিক প্রযুক্তিটি আটারির কাছে হার মেনে নিল। সঙ্গে ঘুম হারাম করে দিল প্রযুক্তিবিদদের। কীভাবে ৫০ বছরের পুরোনো একটি গেম আধুনিক সময়ের সেরা প্রযুক্তিটিকে হারিয়ে দিল?
এতক্ষণ যে গল্পটার কথা বললাম, সেটা আশির দশকের কোনো সায়েন্স ফিকশন মুভির গল্প নয়। বাস্তবেই এমনটা হয়েছে। আর আধুনিক যে প্রযুক্তিটির কথা বলা হয়েছে, সেটা বর্তমানের চ্যাটজিপিটি। এই প্রযুক্তির নাম তো তোমরা শুনেছ। হয়তো অনেকে ব্যবহারও করছ। এটা মানুষের মতো কথা বলতে পারে, প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে, এমনকি কবিতাও লিখতে পারে! কিন্তু প্রশ্ন হলো, কীভাবে আটারি কাজটা করল? সেই অবিশ্বাস্য ঘটনার পেছনে কারণ কী? চলো, তা বোঝার চেষ্টা করি।
এই পরীক্ষা চালানো হয়েছিল স্টেলা ইমুলেটরে। এটা একটা বিশেষ কম্পিউটার প্রোগ্রাম। এই ইমুলেটরে পুরোনো আটারি গেমগুলোকে আধুনিক কম্পিউটারে চালানোর জন্য ব্যবহার করা যায়। আর এতক্ষণ যে দাবা গেমটির কথা বললাম, সেটা বানিয়েছিলেন ল্যারি ওয়াগনার আর বব হোয়াইটহেড। তাঁরা যখন গেমটা বানিয়েছিলেন, তখন কম্পিউটারের ক্ষমতা আজকের মতো ছিল না। তাই তাঁরা খুব অল্প জায়গার মধ্যে, মানে অল্প র্যামসমৃদ্ধ প্রোগ্রামে গেমটা তৈরি করেছিলেন।
আটারি ২৬০০ নামের সেই যন্ত্রটার ভেতরে যে ছোট্ট কম্পিউটারটা ছিল, সেটা ছিল খুবই দুর্বল। ওর মনে রাখার ক্ষমতা ছিল মাত্র ১২৮ বাইট। তোমরা শুনলে হয়তো হাসবে, কারণ এখনকার দিনের একটা সাধারণ গানের ফাইলও এর থেকে অনেক গুণ বড় হয়। তবে এত কম মনে রাখার ক্ষমতা নিয়েও সেই গেমটা দাবার কিছু সাধারণ নিয়ম আর কৌশল মনে রাখতে পারত। শুরুতে সে মাত্র পরের একটি বা দুটি চাল ভাবতে পারত। কারণ, এর প্রসেসর ছিল মাত্র ১.১৯ মেগাহার্টজের।
মার্কিন ক্লাউড কম্পিউটিং ইঞ্জিনিয়ার রবার্ট কারুসো চ্যাটজিপিটিকে দাবার চালগুলো বলে দিতেন। কারণ, আটারির স্ক্রিনে দাবার ঘুঁটিগুলো একটু অন্য রকম ছিল—সংকেতের মতো। তবে চ্যাটজিপিটির জন্য সবকিছু সহজ করে দেওয়ার পরও ওটা বারবার ভুল করতে থাকে। কোনটা নৌকা আর কোনটা হাতি, সেটাই বুঝতে পারত না। এমনকি খুব সহজ ফাঁদও সে ধরতে পারত না। খেলা যত এগোত, বোর্ডের দিকে খেয়াল রাখতে এটির ততই সমস্যা হতো। একসময় তার খেলার মান এতটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে মনে হচ্ছিল যেন কোনো নবিশ দাবা খেলছে! প্রায় দেড় ঘণ্টা চেষ্টা করার পরে শেষ পর্যন্ত চ্যাটজিপিটি হার মেনে নেয়।
এখন প্রশ্ন হলো, কেন এমন হলো? কেন একটা ১২৮ বাইটের পুরোনো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অত্যাধুনিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে হারিয়ে দিল? এককথায় বললে, যে জিনিসটা যে কাজের জন্য তৈরি, সেটা সেই কাজটাই ভালো করতে পারে।
আটারির দাবার গেমটা শুধু একটা কাজ করার জন্যই বানানো হয়েছিল, দাবা খেলা। কীভাবে দাবার ঘুঁটি সরবে, কীভাবে খেললে জিততে পারবে, সবকিছু ওটার ভেতরে খুব ভালোভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ওটা শুধু দাবা খেলার নিয়মকানুন আর কীভাবে ভালো চাল দিতে হয়, সেটুকুই জানত।
অন্যদিকে চ্যাটজিপিটি হলো একটা ‘সবজান্তা শমশের’। মানে একটা অতিবুদ্ধিমান প্রোগ্রাম। ওটা অনেক কিছু জানে, অনেক কিছু করতে পারে। কিন্তু ওর ভেতরে আলাদা করে দাবার জন্য কোনো বুদ্ধি নেই। ওটা দাবার নিয়মকানুনগুলো মনে রাখে, কিন্তু নিজে থেকে বোর্ডের অবস্থা বুঝতে পারে না। চ্যাটজিপিটি আসলে মানুষের কাছ থেকে শেখা চালগুলো দেখেই আন্দাজ করার চেষ্টা করে যে পরে কোন চালটা দেওয়া উচিত।
আটারির গেমটা ওর ছোট্ট মস্তিষ্কের ভেতরে পুরো দাবার বোর্ডের ছবিটা ধরে রাখতে পারত। কোন ঘুঁটি কোথায় আছে, কোন ঘুঁটি কীভাবে চলতে পারে—সবকিছু ওর মুখস্থ ছিল। কিন্তু চ্যাটজিপিটি বোর্ডের কোনো ছবি তার ভেতরে জমা রাখে না। সে শুধু মনে রাখে তাকে কী বলা হয়েছে। ফলে অনেক সময় আসল বোর্ডের সঙ্গে ওর মনে করা বোর্ডের মিল থাকে না। ফলাফল, ওটা ভুল ফেলে।
এ ছাড়া আটারির গেমটা ‘চিন্তা’ করে না, শুধু মুখস্থ করা নিয়ম মেনে চলে। তাই ওটার ভুল করার কোনো সুযোগ নেই। অবশ্য প্রোগ্রামের ভেতরে ভুল থাকলে সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু চ্যাটজিপিটি চেষ্টা করে মানুষের মতো বুদ্ধি খাটিয়ে খেলতে। আর এখানেও আটকে যায় চ্যাটজিপিটি। অতিবুদ্ধিমান হলেও তো ওটা মানুষ নয়! তাই দাবার মতো কঠিন খেলার নিয়মগুলো ওটা ভালোভাবে বুঝতে পারে না।
তাহলে বোঝো, পুরোনো দিনের একটা সাধারণ গেমের যন্ত্র, যার বুদ্ধি আজকের একটা ছোট্ট স্মার্ট ঘড়ির চেয়েও কম, সে কি না আধুনিক একটা সুপার-বুদ্ধিমান প্রোগ্রামকে দাবায় হারিয়ে দিল! এর মূল কারণ হলো, যখন কোনো কাজ করার জন্য বিশেষভাবে কোনো যন্ত্র বা প্রোগ্রাম তৈরি করা হয়, তখন সে সেই কাজটা খুবই ভালোভাবে করতে পারে। এমনকি যদি ওটার বুদ্ধি কমও থাকে। অন্যদিকে অনেক বুদ্ধিমান হলেও যদি কোনো প্রোগ্রামের ভেতরে কোনো নির্দিষ্ট কাজের জন্য আলাদা কিছু শেখানো না থাকে, তাহলে ওটা হয়তো সেই কাজটা ভালোভাবে করতে পারবে না।
এখান থেকে কিন্তু তোমরাও একটা শিক্ষা নিতে পারো। শুধু বুদ্ধি থাকলেই সবকিছু হয় না, অনেক সময় নির্দিষ্ট কাজের জন্য সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ নিতে হয়, অভিজ্ঞ হতে হয়।
সূত্র: দ্য ইকোনমিক টাইমস