জুলে রিমে রহস্য

১.

২১ মার্চ ১৯৬৬। এফএর সভাপতি জো মেয়ার্সের কপালে চিন্তার ভাঁজ। ঠিক কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। এমন সময় বেজে উঠল ফোন। রিসিভার কানে ঠেকাতেই ওপাশ থেকে এক অচেনা কণ্ঠ। পরিচয়ের ধার না ধেরে বললেন, মেয়ার্স যেন পরদিন চেলসি ফুটবল ক্লাবের সামনে যান। একটা পার্সেল থাকবে তাঁর জন্য। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই কেটে গেল কল। জো মেয়ার্সের মুখ একই সঙ্গে থমথমে এবং ভীতসন্ত্রস্ত। প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ডকে ফুটবলের সবচেয়ে সম্মানজনক আসরের ভেন্যু হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আর এর মধ্যেই এই কাণ্ড! পায়চারি করতে লাগলেন ঘরের মধ্যে। বিশ্বকাপ শুরু হবে জুলাইয়ে। জানুয়ারি মাসে ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের কাছে স্বাগতিক হিসেবে ট্রফি রাখতে পাঠায় ফিফা। খুব নিরাপত্তার সঙ্গেই রাখা হচ্ছিল। ঝামেলা পাকাল স্ট্যানলি গিবসনের স্ট্যাম্প কোম্পানি। তারা জুলে রিমে ট্রফিটার প্রদর্শনী করতে চায়, অনুমতিও দেওয়া হয়েছিল। শর্ত হলো ট্রফিটি অবশ্যই রাখতে হবে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায়। সঙ্গে জমা দিতে হবে ৩০ হাজার পাউন্ডের ইনস্যুরেন্স মানি, যদিও ট্রফির মূল্যমান ৩ হাজার পাউন্ড। সব ঠিকঠাকই ছিল। ১৯ মার্চ থেকে ট্রফি প্রদর্শনীর ব্যবস্থাও করা হলো। স্থান ওয়েস্টমিনস্টার হল। বিশ্বকাপটা কাছ থেকে একনজর দেখার জন্য দর্শনার্থীদের ভিড়। এক ফাঁকে মেয়ার্স নিজেও গিয়ে দেখে এলেন নিরাপত্তাব্যবস্থা। দুজন ইউনিফর্মধারী গার্ডের সঙ্গে আরও দুজন সাদাপোশাকের গার্ড ঘোরাফেরা করছে ট্রফির ঠিক আশপাশেই। হলের বিভিন্ন জায়গায় দাঁড়ানো অন্য গার্ডরাও আছে। খুবই সন্তোষজনক নিরাপত্তাবলয়।

কিন্তু গোলমাল বাধে পরদিন। দুপুর ১২টার দিকে সাধারণত পালাবদল হয় গার্ডদের। ১২টা ১০-এর দিকে কেউ একজন খেয়াল করল ডিসপ্লে কেস খোলা। ভেতরটা ফাঁকা। ট্রফি নেই! খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, হলের পেছন দরজা খোলা। দরজা আটকে রাখা কাঠটা গড়াগড়ি খাচ্ছে মেঝেতে। ততক্ষণে সাড়া পড়ে গেছে। খবর পেয়ে মেয়ার্স এলেন, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড এল। শুরু হলো গার্ডদের জিজ্ঞাসাবাদ। কেউই কিছু বলতে পারল না। তবে একজন জানাল, টয়লেটে যাওয়ার পথে এক আগন্তুককে সন্দেহজনকভাবে টেলিফোন বুথের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে সে। গির্জায় আসা মিসেস কোম্বও জানাল একজনের কথা, তবে তার বর্ণনা মিলল না প্রথমজনের সঙ্গে। কী আর করা! দুজন সন্দেহভাজন অপরাধীর খোঁজে নামতে হলো পুলিশকে। মেয়ার্সের তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা। ব্রিটেনের মাটি থেকে বিশ্বকাপ চুরি! রেডিও আর পত্রিকার মাধ্যমে পুরো বিশ্বে খবর ছড়াতে দেরি হলো না। পুলিশের খোঁজাখুঁজি চলছেই। কিন্তু কোনো অগ্রগতির দেখা নেই। তারপরে সেই রহস্যময় ফোনকল।

পরদিন সকালে পার্সেল এল। ভেতরে ট্রফির ওপরদিকের কিছু অংশ আর একটা নোট রাখা। তাতে লেখা, ট্রফি অক্ষত পেতে হলে ১৫ হাজার পাউন্ড দিতে হবে, তবে সবগুলোই ১ আর ৫ পাউন্ডের নোটে। যদি কোনোভাবে পুলিশকে জানানো হয় তাহলে গলিয়ে ফেলা হবে বিশ্বকাপ ট্রফি। শর্তে রাজি থাকলে ইভিনিং নিউজ পত্রিকায় দিতে হবে একটা সাংকেতিক বিজ্ঞাপন।

এত দুরবস্থায় আগে কখনো পড়েননি মেয়ার্স। একটু পরপর ঘামছেন। কিছুক্ষণ পরই আবার ফোন। এবার পরিচয় দিল জ্যাকসন নামের কেউ একজন। বলল, নির্দেশনা বদলে ৫ আর ১০ পাউন্ডের নোটে টাকাটা দিতে। পরিস্থিতি যতই কঠিন হোক না কেন সহজে বুদ্ধি হারান না জো মেয়ার্স। নোটে থাকা নিষেধ অমান্য করে গেলেন পুলিশ এবং স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দা চার্লস ব্যাগির কাছে। পুলিশ বলল, ২৪ মার্চ পত্রিকায় ওই বিজ্ঞাপনটা দিতে। আর স্থানীয় কোনো ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করে নকল টাকার ব্যবস্থা করতে। বান্ডিলের ওপরে আর নিচে থাকবে আসল টাকা, ভেতরে সাধারণ কাগজ। দুজন পুলিশও মেয়ার্সের সঙ্গে তাঁর বাড়িতে এল, নকল টাকা ডেলিভারিতে সাহায্য করার জন্য।

ট্রফি উদ্ধার করে একেবারে তারকা হয়ে গেল পিকলস

সবকিছুই পরিকল্পনামাফিক এগোচ্ছে। কিন্তু অ্যাজমা অ্যাটাক হলো মেয়ার্সের। ফোন রিসিভ করলেন তাঁর স্ত্রী। জ্যাকসনকে জানালেন মেয়ার্সের অসুস্থতার কথা এবং কথা বলতে বললেন মেয়ার্সের সহকারী ম্যাকফির সঙ্গে। ম্যাকফি আর কেউই নন, ছদ্মবেশী গোয়েন্দা ব্যাগি। জ্যাকসন খানিকটা ইতস্তত করলেও ম্যাকফির সঙ্গেই সব চূড়ান্ত হলো। জায়গা ঠিক হলো ব্যাটার্সি পার্ক।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে ব্যাগি একাই পার্কে যাচ্ছেন মুক্তিপণের টাকা নিয়ে। কিন্তু ছদ্মবেশী পুলিশ গাড়ি নিয়ে আছে কাছেই। পৌঁছানোর পর ব্রিফকেসভর্তি টাকা দেখানো হলো জ্যাকসনকে। নকল টাকাগুলো ধরতেই পারল না সে। ব্যাগি জানালেন, ট্রফি দেখার আগে টাকা দিতে রাজি নন। জ্যাকসনও রাজি হয়ে ব্যাগির গাড়িতে উঠে বসল। তাঁদের অনুসরণ করছে ছদ্মবেশী পুলিশগাড়ি। একটু তাকাতেই পুরো ব্যাপারটা টের পেয়ে গেল জ্যাকসন। একটা ট্রাফিক সিগন্যালে ব্যাগিকে গাড়ি থামাতে বলল সে। ট্রফি আনার কথা বলে গাড়ি থেকে নামল সে। কিন্তু খানিকটা এগোতেই আর দেখা গেল না তাকে। ভোজবাজির মতো উধাও যেন। ফের যখন দেখা গেল তাকে গাড়িতে উঠতে বললেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। একটা চলন্ত গাড়িতে উঠে পালাতে চাইল জ্যাকসন। পিছু পিছু ছুটলেন ব্যাগিও। প্রথমে গাড়ি নিয়ে, পরে দৌড়ে। শেষে একটা বাড়ির বাগানে গিয়ে তাকে ধরল পুলিশ। গ্রেপ্তার করে কেনিংটন পুলিশ স্টেশনে আনার পর জানা গেল তার আসল নাম এডওয়ার্ড বিচলে, একজন ছিঁচকে চোর। ট্রফি চুরির মামলা হলো তার নামে। কিন্তু চুরির কথা অস্বীকার করল বিচলে। আবার বলল জামিন পেলে ট্রফি এনে দিতে পারবে সে। তবে শেষে জানাল, পোল নামের এক ব্যক্তি ৫০০ পাউন্ডের বিনিময়ে মধ্যস্থতাকারী ব্যক্তি হিসেবে অফার করে তাকে। সে শুধু সেই কাজটুকুই করছিল। মিসেস কোম্ব বিচলেকে দেখে শনাক্ত করেন। তবে গার্ডের দেওয়া বর্ণনার সঙ্গে মেলে না কিছুই।

সন্দেহভাজন ধরা পড়ল, তবু ট্রফির খোঁজ নেই। চারদিকে গুঞ্জন বিশ্বকাপ আসরের তাহলে কী হবে!

পিকলসকে নিয়ে তৈরি হবে চলচ্চিত্র, সেটার চিত্রনাট্য দেখছে সবাই মিলে

মার্চের ২৭ তারিখ, লন্ডনের বিউলা হিল ডিস্ট্রিক্টের ডেভিড কর্বেট হাঁটতে বেরিয়েছেন তাঁর কুকুর পিকলসকে সঙ্গে নিয়ে। বাড়ির বেড়ার দিকে আসতেই পিকলসের অস্বাভাবিক ভঙ্গি। শুঁকে শুঁকে বেড়ার নিচ থেকে টেনে বাইরে আনল পুরোনো পত্রিকায় মোড়ানো একটা কিছুকে। তার দিয়ে পেঁচিয়ে বাঁধা। খুলতেই দেখা গেল সেই হারানো ট্রফি। যেটার নিচে স্পষ্ট খোদাই করা আগের বিশ্বকাপগুলোর চ্যাম্পিয়নদের নাম। সরাসরি পুলিশের কাছে। পুরোটা খুলে বললেন কর্বেট। প্রথমে তাঁকেই চোর ভেবে সন্দেহ করল পুলিশ। কিন্তু শক্ত একটা প্রমাণ থাকায় পার পেয়ে গেলেন কর্বেট। এফএ থেকে শনাক্ত করা হলো জুলে রিমে ট্রফিকে। রাতারাতি খ্যাতি পেয়ে গেলেন কর্বেট আর তাঁর কুকুর পিকলস। জুলাইয়ে হওয়া বিশ্বকাপটা জিতল ইংল্যান্ডই। কর্বেট পেলেন ছয় হাজার পাউন্ডের পুরস্কার এবং বিশ্বকাপজয়ী সদস্যদের সঙ্গে ডিনারের সুযোগ। আর এডওয়ার্ড বিচলের দুই বছরের সাজা হলো, চুরির চেষ্টা এবং মুক্তিপণ চাওয়ার অভিযোগে।

২.

জুলে রিমে রহস্যটা এখানেই শেষ হয়নি। বরং এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে বলা যায়। সত্তরের বিশ্বকাপটা তৃতীয়বারের মতো জিতে নেয় ব্রাজিল। প্রতিশ্রুতিমাফিক জুলে রিমে ট্রফি দিয়ে দেওয়া হয় সেলেকাওদের। ব্রাজিল ফুটবল কনফেডারেশনের রিও ডি জেনিরোর ভবনেই সাজানো ছিল সেটা। তখন ১৯৮৩ সাল। সার্জিও পেরাল্টা নামের এক ব্যাংকার এবং ক্লাব এজেন্ট নীলনকশা আঁকে জুলে রিমে চুরি করার। সঙ্গে রাখে একজন সাবেক পুলিশ অফিসার এবং এক ডেকোরেটর ব্যবসায়ীকে। পরিকল্পনামতো তারা নিরাপত্তা প্রহরীদের পরাস্ত করে রাতের বেলা ভবনে ঢোকে। ট্রফিকেস থেকে জুলে রিমের সঙ্গে আরও দুই ট্রফি নিয়ে পালিয়ে যায় তারা।

কিন্তু পালিয়ে থাকতে পারেনি। পেরাল্টা আর তার সঙ্গীরা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে কয়েক দিন বাদেই। তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয় আন্তনিও সেত্তা নামক এক সিন্দুক ভাঙতে জানা ব্যক্তি। পেরাল্টা তাকেও প্রস্তাব দিয়েছিল, কিন্তু দেশপ্রেমের কারণে রাজি হননি এই কাজে। ধরা পড়ার পর পেরাল্টা জানায়, ট্রফিকে গলিয়ে সোনার বার তৈরি করা হয়েছে জুয়ান কার্লোস ফার্নান্দেজ নামক আর্জেন্টাইন স্বর্ণ ব্যবসায়ীর মাধ্যমে। জুয়ান কার্লোস অস্বীকার করে এই অভিযোগ। তার ঢালাই কারখানায় খুঁজে ট্রফির উপাদানওয়ালা কোনো সোনার বার পাওয়া যায়নি। তবে ট্রফিটা খাঁটি সোনার তৈরি ছিল না যে সহজেই গোল্ডবারে রূপান্তর করা যাবে। তবু ফার্নান্দেজ এবং বাকিদের গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু সাজার রায় দেওয়ার আগেই পালিয়ে যায় তারা। যদিও পরে এদের একজন মারা যায় এবং বাকিরা ধরা পড়ে। পুলিশের অনেক চেষ্টা ছাড়াও ফুটবল গ্রেট পেলেসহ অনেকেই অনুরোধ করেছেন ট্রফি ফেরত দিতে। তবে সেই ট্রফিটা আর উদ্ধার হয়নি। ব্রাজিল ফুটবল কনফেডারেশন রেপ্লিকা জুলে রিমে ট্রফিই সাজিয়ে রেখেছে শো-কেসে।

হয়তো কারও ব্যক্তিগত সংগ্রহে নয়তো সোনার বারেই শেষ পরিণতি ঘটেছে আসল জুলে রিমের।