আনচেলত্তি কার? ব্রাজিল না রিয়ালের?

মৌসুমের ইতি টানতে এখনো বেশ কিছুদিন বাকি। নিশ্চিত হয়ে গেছে লিভারপুলের শিরোপা, বার্সেলোনাও জিতেছে কোপা দেল রে। একের পর এক শেষ হচ্ছে শিরোপার লড়াই। কিন্তু এর ফাঁকেই অদৃশ্য এক দড়ি টানাটানিতে ব্যস্ত রিয়াল মাদ্রিদ ও ব্রাজিল ফুটবল দল। সেটাও আবার কোচ কার্লো আনচেলত্তিকে নিয়ে। সপ্তাহখানেক ধরে চলছে দুই বোর্ডের মন–কষাকষি। শেষ পর্যন্ত কোন দিকে ভিড়বেন ইতালিয়ান কোচ?

জীবনের ৬৫ বসন্ত কাটিয়ে ফেলেছেন কার্লো আনচেলত্তি। সামনের জুনে পা দেবেন ৬৬ বছরে। পুরো জীবনটাই বিলিয়ে দিয়েছেন ফুটবলের পেছনে। ভালো খেলোয়াড় নাকি ভালো কোচ হতে পারেন না—এমনটা মনে করেন অনেকেই। অথচ আনচেলত্তি সেই মিথ এমনভাবে ভেঙেছেন যে তাঁর খেলোয়াড়ি জীবনের অর্জন বেমালুম ভুলে যান অনেকে। ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগের শিরোপা আছে তাঁর ঝুলিতে, আছে পাঁচটি চ্যাম্পিয়নস লিগও। এমন অভিজ্ঞ কোচকে দলে পেতে কে না চায়? ব্রাজিল জাতীয় দলও তাই মুখিয়ে আছে।

এটা জেনেই আনচেলত্তির দিকে হাত বাড়িয়েছিল ব্রাজিলের ফুটবল সংস্থা সিবিএফ। পরবর্তী আন্তর্জাতিক ম্যাচ আসতে এখনো ঢের সময় বাকি। দরিভাল জুনিয়রের পর তাই নতুন কোনো কোচকে নিয়োগ দেয়নি তারা। মৌসুম শেষে রিয়াল ছাড়চ্ছেন ভেবে আগেভাগেই আনচেলত্তির সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে ব্রাজিল

ব্রাজিলের এত বছরের ফুটবল ইতিহাসের এখন পর্যন্ত কোনো বিদেশি কোচ আসেনি। নিজেদের ফুটবল তত্ত্ব আর ঐতিহ্যের ওপর বড় ভরসা ছিল তাদের। কিন্তু সময় বদলেছে। নিজেদের দেশের কোচদের যেমন অভিজ্ঞতা কমেছে, তেমনই ইউরোপিয়ান কোচদের দক্ষতা বেড়েছে মাঠে। ফলে গত কয়েক বিশ্বকাপ ধরেই ব্রাজিলের ভরাডুবি বেশ চোখে লাগার মতো। টানা ৫ বিশ্বকাপে শিরোপাহীন তারা। অন্যদিকে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনা চোখের সামনে উঁচিয়ে ধরেছে কোপা-বিশ্বকাপ-কোপা ট্রেবল। আশু পরিবর্তন প্রয়োজন ছিল ডাগআউটে। আনচেলত্তি ছিলেন সহজ সমাধান।

এখানেই বিপত্তি বাঁধিয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ। ব্রাজিলের লক্ষ্য ছিল গত মৌসুম। আনচেলত্তির চুক্তিও ছিল শেষের দিকে। দুইয়ে দুই মিললেই ব্রাজিলের ডাগআউটে জায়গা করে নিতেন ইতালিয়ান ডন। কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে ১৫তম বারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগ উঁচিয়ে ধরল রিয়াল মাদ্রিদ। আনচেলত্তিও খুশি মনে দুই বছরের চুক্তি স্বাক্ষর করলেন রিয়ালের সঙ্গে। অগত্যা নতুন কোচের দিকে নজর দিতে হলো ব্রাজিলকে। প্রথমে ফার্নান্দো দিনিজ, অতঃপর দরিভাল জুনিয়রের মতো কোচ দিয়ে নামকাওয়াস্তে কাজ চালিয়েছে তারা। নজর বরাবরই ছিল আনচেলত্তির দিকে।

ব্রাজিলিয়ানদের সঙ্গে বরাবরই মধুর সম্পর্ক আনচেলত্তির।
ছবি: এক্স

অথচ এক মাস আগেও কার্লো আনচেলত্তির চাকরি ছিল পুরোপুরি নিশ্চিত। কোচ আর দল, দুটির বৃহস্পতিই ছিল তুঙ্গে। চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনাল, কোপা দেল রে ফাইনাল, লিগেও টেক্কা দিচ্ছেন বার্সেলোনার সঙ্গে। সব মিলিয়ে রিয়াল মাদ্রিদের ওপর মহলে আনচেলত্তির প্রতি একটা সুনজর ছিল। যদিও ট্যাক্টিকস আর রোটেশন নিয়ে বেশ সমালোচনা ছিল সমর্থকদের মধ্যে, কিন্তু দিনের শেষে মাঠে জয়টাই মুখ্য। আনচেলত্তি সেখানে ছিলেন অটুট। কিন্তু দেড় সপ্তাহের মধ্যে বদলে গেল সবটা। প্রথমে আর্সেনালের কাছে হার, অতঃপর বার্সেলোনার কাছে কোপা দেল রের ফাইনালে হার। দুই হার আনচেলত্তিকে ছিটকে দিয়েছে রিয়ালের চেয়ার থেকে। গুঞ্জন ছিল মৌসুমের মাঝপথেই হয়তো দল ছাড়বেন তিনি। কিন্তু তা হচ্ছে না। কিন্তু মৌসুম শেষে যে দল ছাড়ছেন, তা এখন প্রায় নিশ্চিত।

এটা জেনেই আনচেলত্তির দিকে হাত বাড়িয়েছিল ব্রাজিলের ফুটবল সংস্থা সিবিএফ। পরবর্তী আন্তর্জাতিক ম্যাচ আসতে এখনো ঢের সময় বাকি। দরিভাল জুনিয়রের পর তাই নতুন কোনো কোচকে নিয়োগ দেয়নি তারা। মৌসুম শেষে রিয়াল ছাড়চ্ছেন ভেবে আগেভাগেই আনচেলত্তির সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে ব্রাজিল। বিপত্তি বাঁধে শিডিউল নিয়ে। প্রতি মৌসুমের মতো এবার জুন মাসে মৌসুম শেষ হচ্ছে না। বরং নতুন শুরু হতে চলা ক্লাব বিশ্বকাপের জন্য ফুটবল মৌসুম শেষ হচ্ছে জুলাই মাসে। যে ৩২টি দল বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়েছে, তাদের খেলোয়াড় থেকে শুরু করে কোচ সবাইকে তাই চুক্তির থেকেও বেশি সময় থাকতে হবে দলের সঙ্গে।

সেই হিসেব অনুযায়ী কার্লো আনচেলত্তিও দলের সঙ্গে থাকবেন জুলাইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত। কিন্তু সিবিএফ চাইছে লা লিগা শেষ হওয়া মাত্রই ব্রাজিলে যোগ দেন তিনি। কারণ, আগামী জুন মাস থেকেই শুরু হয়ে যাবে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের প্রস্তুতি। এবার প্রস্তুতিতে কোনো ফাঁক রাখতে চায় না তারা। রিয়াল আবার বেঁকে বসেছে এখানে। নিজেদের অভিজ্ঞ কোচকে ক্লাব বিশ্বকাপের আগে আগে ছাড়তে নারাজ ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ। বরং বিশ্বকাপ শেষে তাঁকে নিয়ে যেতে পারে ব্রাজিল। দরকার হলে ১ বছরের চুক্তি বনিবনা করে শেষ করে দেবে রিয়াল নিজেই।

২০১৫ সালে ব্রাজিলের জার্সিতে দেখা গিয়েছিল আনচেলত্তিকে।
ছবি: এক্স

দুই পক্ষের দুই মতামতের বলি হয়েছেন আনচেলত্তি। রিয়াল-আর্সেনাল ম্যাচের পর আনচেলত্তির সঙ্গে পাকা কথা সেরে ফেলে সিবিএফ। এমনকি কোপা দেল রে ফাইনালের পরও ব্রাজিলের একজন প্রতিনিধি দেখা করেন আনচেলত্তির সঙ্গে। সকলেই দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নিয়েছিলেন। দ্য অ্যাথলেটিকের রিপোর্ট এমনটাই বলছিল। কিন্তু এক দিনের মাথায় বদলে যায় সবটা, রিপোর্টে আসে মুদ্রার উল্টো চিত্র।

রিয়ালকে না জানিয়ে এমন আলোচনায় কিছুটা মনঃক্ষুণ্ন হয়েছে তারা। একে তো পর পর দুই শিরোপা হারিয়ে দলে দিশাহারা অবস্থা, অন্যদিকে লিগেও ভালো অবস্থানে নেই। এমন সময় অন্য দলের সঙ্গে আলোচনা ভালো চোখে দেখেনি রিয়াল। ফলে আনচেলত্তিকে ক্লাব বিশ্বকাপ পর্যন্ত রাখতে চায় লস ব্লাঙ্কোসরা। এরপর যদি সিদ্ধান্ত হয়, তবে ব্রাজিলের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ। ফলে ভেস্তে যায় ডিল। নতুন কোচের সন্ধান করতে থাকে ব্রাজিল বোর্ড। এমনকি এমনটাও শোনা যাচ্ছিল, ব্রাজিলিয়ান লিগে রিয়ালের স্কাউটদের আনাগোনা বন্ধ করে দিবেন সভাপতি।

কিন্তু তাঁর কিছুই সামনে এগোয়নি। বরং সাময়িক মনোমালিন্য শেষে আবারও কথাবার্তায় ফিরেছে দুই বোর্ড। এখনো আনচেলত্তির সুযোগ আছে রিয়াল ছেড়ে ব্রাজিলের কোচ হওয়ার। তবে এখনই সেই সিদ্ধান্ত নয়। লা লিগা জেতার বেশ ভালো সম্ভাবনা রয়েছে রিয়ালের সামনে। ফলে এখনই এসব চিন্তা মাথায় এনে কোচের মনোযোগ সরাতে চাইছে না তারা। ব্রাজিলও মেনে নিয়েছে সে শর্ত। ফলে দুই পক্ষের কথাবার্তাই আপাতত স্থগিত। তবে রিয়াল ছেড়ে কার্লো ব্রাজিল যাচ্ছেন, এটা প্রায় নিশ্চিত। আলোচনা শুধু সময় নিয়ে।

ব্রাজিলের বোর্ড প্রেসিডেন্ট এদনালদো রদ্রিগেজের পছন্দ আলচেলত্তি।
ছবি: এক্স

সময় বাদেও আরেকটি আলোচনা রয়েছে রিয়াল আর ব্রাজিলের মধ্যে। সাধারণত মেয়াদ ফুরোনোর আগে কোনো কোচ দল ছাড়তে চাইলে একটা মোটা অঙ্কের রিলিজ ক্লজ পরিশোধ করতে হয় তাঁকে। অন্যদিকে কোচকে ছাটাই করলে মোটা অংকের জরিমানা দিয়ে ছাঁটাই করতে হয় দলকে। রিয়াল এবং আনচেলত্তির মধ্যকার সম্পর্কটা ঠিক কোন জায়গাতে থামবে, সেটা নির্ভর করছে আলোচনার ওপর। রিয়াল রাজি না হলে বিশাল অঙ্কের টাকা পরিশোধ করতে হবে ব্রাজিলকে। ব্রাজিল সেটা পারবে কিনা, সেটাও একটি প্রশ্ন।

অন্যদিকে ক্লাব বিশ্বকাপের আগে কোচের দায়িত্ব ছাড়লে কে হবেন রিয়ালের কোচ, সে নিয়েও আছে জল্পনা-কল্পনা। দৌড়ে জাবি আলানসো এগিয়ে থাকলেও শুরুতেই বড় টুর্নামেন্টের দায়িত্ব নিতে চাইবেন কিনা, প্রশ্ন আছে তা নিয়েও। এখন সবটাই আটকে আছে সময়ের কাছে।

আরও পড়ুন