কেমন হবে বদলে যাওয়া চ্যাম্পিয়নস লিগ?

২০২৪-২৫ মৌসুম থেকে নতুন আঙ্গিকে হবে চ্যাম্পিয়নস লিগছবি: উয়েফা

ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ আসর উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ। ইউরোপের সেরা দলের সেরা তারকারা মুখোমুখি হন নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে। ইউরোপিয়ান ফুটবলের আলোচিত যত লড়াই, অধিকাংশই রচিত হয়েছে এই চ্যাম্পিয়নস লিগের মঞ্চে। সেই ১৯৫৫-৫৬ মৌসুম থেকে প্রতিবছর কোনো বিরতি ছাড়াই চলে আসছে ফুটবলের অন্যতম রোমাঞ্চকর এই লড়াই।

ইউরোপ–সেরাদের লড়াই কিন্তু সব সময় এমন ছিল না। ১৬ দল নিয়ে শুরু হওয়া টুর্নামেন্টে পরিবর্তন এসেছে বহুবার। দলের সংখ্যা থেকে টুর্নামেন্টের নাম—বদল এসেছে সবকিছুতেই। সেই ধারা বজায় রেখে আবারও বদলে যাচ্ছে চ্যাম্পিয়নস লিগ। শুধু দলের সংখ্যা বেড়েই ক্ষান্ত হচ্ছে না উয়েফা, বদল আসতে চলেছে খেলার ফরম্যাটেও।

১৯৯৯ সাল থেকে চলে আসা চ্যাম্পিয়নস লিগের বর্তমান ফরম্যাটটা মোটামুটি সবার জানা। ইউরোপের সেরা ৩২ দলকে ভাগ করা হয় ৮টি গ্রুপে। প্রতিটি গ্রুপে চারটি করে দল। হোম ও অ্যাওয়ে ভিত্তিতে প্রতিটি দল গ্রুপ পর্বে খেলে মোট ৬টি ম্যাচ। প্রতি গ্রুপের সেরা দুই দল সুযোগ পায় পরবর্তী রাউন্ডে। সেখান থেকে দুই লেগের নকআউট ম্যাচ খেলে ফাইনাল। অবশেষে ফাইনাল। সেখান থেকেই নিশ্চিত হয় ইউরোপিয়ান শ্রেষ্ঠত্ব। তবে ২০২৪-২৫ মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগ হবে নতুন ফরম্যাটে। নতুন এই ফরম্যাটের ঘোষণা দেওয়া হয় গত ১ সেপ্টেম্বর। কী কী পরিবর্তন আসছে, কীভাবে বদলে যাচ্ছে ইউরোপিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই?

দল

নতুন ফরম্যাটের চ্যাম্পিয়নস লিগে দলের সংখ্যা বেড়ে হবে ৩৬। নতুন করে যুক্ত হবে চারটি দল। কিন্তু এই চারটি দল নির্বাচন হবে কীভাবে? আগের ৩২টি দল তো থাকছেই। নতুন করে যুক্ত হওয়া একটি স্লট পাবে উয়েফার লিগ র‍্যাঙ্কিংয়ে পাঁচে থাকা লিগ। বর্তমানে পঞ্চম অবস্থানে আছে নেদারল্যান্ডসের লিগ। তাদের দেশ থেকে আরেকটি দল সরাসরি যোগ দেবে চ্যাম্পিয়নস লিগে। অন্য স্লটটি পাবে ‘কোয়ালিফাইং রাউন্ড’ থেকে উঠে আসা দলগুলো। বর্তমান নিয়মে চ্যাম্পিয়নস লিগের ‘কোয়ালিফাইং রাউন্ড’ বা ‘চ্যাম্পিয়নস পাথ’ থেকে সরাসরি সুযোগ পায় চারটি দল। ২০২৪-২৫ মৌসুম থেকে সেখানে সুযোগ পাবে পাঁচটি দল। অন্য দুটি স্লট পাবে উয়েফার লিগ র‍্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে থাকা দুই দেশের পঞ্চম দল। বর্তমান র‍্যাঙ্কিং অনুযায়ী দল দুটি হতো ইংলিশ লিগের লিভারপুল এবং ‘সিরি আ’র ক্লাব আতালান্তা।

ফরম্যাট

নতুন চার দলের আগমনে পুরোপুরি বদলে গেছে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফরম্যাট। নতুন এই ফরম্যাটকে ভাগ করা যায় তিনটি ভাগে।

প্রথম পর্ব

২০২৩-২৪ মৌসুমেই শেষবারের মতো দেখা যাচ্ছে চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপ পর্ব। আগামী মৌসুম থেকেই বাতিল করে দেওয়া হচ্ছে গ্রুপ পদ্ধতি। গ্রুপের বদলে যুক্ত হচ্ছে লিগ পদ্ধতি। যেখানে প্রতিটি দল তাদের পয়েন্টের ভিত্তিতে র‍্যাঙ্কিং পাবে। তবে খেলার ফরম্যাটটা হবে ‘সুইস মডেল’-এ। দাবার বড় বড় টুর্নামেন্টে ব্যবহার করা হয় এই সুইস মডেল।

এই মডেলে মূলত প্রতিটি দলকে প্রতিটি দলের মুখোমুখি হতে হবে না। স্বাভাবিক লিগ ফরম্যাটে হোম-অ্যাওয়ে ভিত্তিতে প্রত্যেকে একে অপরের বিপক্ষে খেলে। এই মডেলে তার প্রয়োজন নেই। বরং একটি দল কেবল ১০টি ম্যাচ খেলার সুযোগ পাবে। এই ১০টি ম্যাচ হবে ভিন্ন ১০টি দলের বিপক্ষে। ৫টি নিজেদের মাঠে, ৫টি প্রতিপক্ষের মাঠে।

প্রথম পর্বের ১০ ম্যাচ শেষে পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে থাকা ৮টি দল সরাসরি চলে যাবে শেষ ষোলোয়। ৯ম থেকে ২৪তম অবস্থানে থাকা দলগুলো চলে যাবে দ্বিতীয় পর্ব বা প্লে-অফ রাউন্ডে। আর শেষের ৮ দল অর্থাৎ ২৫ থেকে ৩৬ নম্বর দলের ইউরোপযাত্রা শেষ হবে সেখানেই।

দ্বিতীয় পর্ব বা প্লে-অফ রাউন্ড

পয়েন্ট টেবিলের ৯ম থেকে ২৪তম অবস্থানে থাকা ১৬টি দল সুযোগ পাবে চ্যাম্পিয়নস লিগের দ্বিতীয় পর্বে। যদিও সেখানে কে-কার মুখোমুখি হবে, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে আশা করা যাচ্ছে, লটারির মাধ্যমেই সেটা নিশ্চিত করা হবে। হোম-অ্যাওয়ে ভিত্তিতে দুই লেগের প্লে-অফ খেলবে ১৬টি দল। জয়ী আট দল চলে যাবে চ্যাম্পিয়নস লিগের পরবর্তী পর্বে। আর বাকি ৮ দল চলে যাবে উয়েফা ইউরোপা লিগে।

তৃতীয় পর্ব বা নকআউট রাউন্ড

চ্যাম্পিয়নস লিগের এই পর্ব এখনকার মতোই। শেষ ১৬ থেকে শেষ ৮, অতঃপর ৪। শেষ পর্যন্ত ২। প্রতিটি পর্বেই হোম-অ্যাওয়ে ভিত্তিতে মুখোমুখি হবে দলগুলো। জয়ী দল যাবে পরবর্তী পর্বে, হেরে যাওয়া দল বিদায়। আর ফাইনাল হবে প্রতিবারের মতো নিরপেক্ষ কোনো ভেন্যুতে।

কেন বদলে যাচ্ছে চ্যাম্পিয়নস লিগ?

একবাক্যে প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে উত্তরটা হবে টাকা। উয়েফার মাথা থেকে এই বিদঘুটে ফরম্যাটের উদ্ভব হয়েছিল ২০২১ সালে। তখন ইউরোপিয়ান সুপার লিগ নিয়ে পুরো পৃথিবীতে চলছে তোড়জোড়। ইউরোপের বড় দলগুলো তখন ভিড়েছিল সুপার লিগ নামক ছাতার নিচে। তখনই তড়িঘড়ি করে এই ফরম্যাট তৈরি করে উয়েফা।

এই ফরম্যাটে প্রতিটি দলকে অন্তত ১০টি ম্যাচ খেলতেই হবে। চ্যাম্পিয়নস লিগে ম্যাচের সংখ্যা বেড়ে ১০০ থেকে হচ্ছে ১২৫। যত বেশি ম্যাচ, তত বেশি টাকা। টিকিট বিক্রি, টিভি স্বত্ব, স্যাটেলাইট স্বত্ব; বিশাল টাকার ঝনঝনানি। শুধু উয়েফা নয়, ক্লাবগুলোর পকেটেও যাবে সেই টাকার লভ্যাংশ। আর বেশি ম্যাচ মানেই বড় দলগুলোর মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা বহু গুণে বেড়ে যাওয়া। ফলে চ্যাম্পিয়নস লিগের প্রতি মৌসুমেই দেখা যাবে হেভিওয়েটদের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। যা শুধু অর্থের দিক দিয়েই নয়, দর্শক টানার দিক দিয়েও সাহায্য করবে উয়েফাকে।

এই ফরম্যাটের ঘোষণা এল এমন এক সময়ে, যখন ইউরোপ থেকে বিদায় নিয়েছেন মেসি রোনালদো দুজনেই। ফুটবলের দুই সুপারস্টারের বিদায় উয়েফার মাথায় চিন্তার বলিরেখা তৈরি করতে বাধ্য। নতুন ফরম্যাটে হেভিওয়েট ম্যাচ দিয়ে যদি কিছুটা হাইপ তৈরি করা যায়, তাতে ক্ষতি কী?

এই ফরম্যাটের খারাপ দিকও আছে বৈকি। এমনিতেই ইউরোপিয়ান লিগ সিজনের চাপ সামলাতে হাঁসফাঁস অবস্থা খেলোয়াড়দের। সেখানে মৌসুমে আরও বাড়তি চারটি ম্যাচ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাঁচটি। লিগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় জানুয়ারি মাসে প্লে-অফের খেলা। সব মিলিয়ে ক্লাব কোচ এবং খেলোয়াড় প্রত্যেকের ওপর দিয়েই বিশাল একটা ধকল যাবে। এমনিতেই জোটে জর্জর হয়ে প্রিয় খেলোয়াড়দের মৌসুম কাটাতে হচ্ছে মাঠের বাইরে। নতুন ফরম্যাটে নতুন তারকাদের উত্থান দেখতে পাবে তো দর্শক? নাকি খেলোয়াড়দের দেখতে হবে হাসপাতালে?