রূপকথার মতো রঙিন এক বিশ্বকাপ

ফিফা বিশ্বকাপ শেষ হয়ে গেছে বেশ আগেই। কিন্তু রেশ রয়ে গেছে এখনো। কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে গতবারের চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকে টাইব্রেকারে হারিয়ে এবারের বিশ্বকাপ শিরোপা উঁচু করেছে লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা। উত্তেজনা আর রোমাঞ্চে ঠাসা এ আসর ক্ষণে ক্ষণে বদলেছে রং, কমিয়ে এনেছে ছোট-বড় দলের মধ্যকার চিরায়ত ব্যবধান। উপভোগ করিয়েছে বিশ্বকাপ ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোল–উৎসব। এক মাসের কম সময় নিয়ে প্রথমবারের মতো শীতকালীন আয়োজন, যাকে ইতিহাসের অন্যতম সেরা হিসেবে মেনে নিয়েছেন অনেকেই। ফিরে দেখা যাক কেমন ছিল ফিফার চোখধাঁধানো ২২তম আসর।

প্রথমবারের মতো এবারের বিশ্বকাপে স্বাগতিক দেশ হিসেবে গ্রুপ পর্বের তিনটি ম্যাচই হেরেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতার। ইকুয়েডর, সেনেগাল ও নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে তিনটি ম্যাচেই দুই গোলের ব্যবধানে হেরেছে তারা। গোল খেয়েছে সাতটি, করেছে মাত্র একটি। কাতারের ইতিহাসের মহামূল্যবান সেই গোল করেছেন দলটির স্ট্রাইকার মোহাম্মেদ মুনতারি। এর আগে ২০১০ বিশ্বকাপের দক্ষিণ আফ্রিকাই ছিল একমাত্র দেশ, যারা স্বাগতিক হয়েও পরের রাউন্ডে যেতে পারেনি। এবার তাদের পাশে নাম লিখিয়েছে কাতারও।

এশিয়ার মাটিতে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় বিশ্বকাপে মনে রাখার মতো খেলেছে আফ্রিকা ও এশিয়ার বেশির ভাগ দেশ। ইউরোপের দলগুলো তো বরাবরই বিশ্বকাপের মঞ্চে ভালো খেলে, লাতিন আমেরিকার দলগুলোও তা–ই। এশিয়া ও আফ্রিকার দলগুলোর দৌড় সাধারণত ওই গ্রুপ রাউন্ডে অংশ নেওয়া পর্যন্তই ছিল। কিন্তু প্রথমবারের মতো এ অঞ্চলের মোট পাঁচটি দেশ—অস্ট্রেলিয়া, জাপান, সেনেগাল, দক্ষিণ কোরিয়া ও মরক্কো গ্রুপ রাউন্ডের বাধা পেরিয়ে পৌঁছেছে নকআউট রাউন্ডে। বলা হচ্ছে, কাতারের আবহাওয়া ও পরিবেশ অনুকূল হওয়ায় নিজেদের সেরা খেলা উপহার দিতে পেরেছে এই দুই মহাদেশের দলগুলো।

বড় মঞ্চে ছোট দল বলে যে কিছু নেই, সেই তর্কের অবসান ঘটাতে একেবারে প্রথম রাউন্ড থেকেই মরিয়া হয়ে উঠেছিল দলগুলো। নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে দারুণ লড়াই করেও হার দিয়ে শুরু হয় সেনেগালের। ওদিকে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে নিজেদের ইতিহাসের সেরা জয়টি তুলে নেয় সৌদি আরব! তারকায় ভরা লাতিন আমেরিকার দলটিকে খেলায় টেক্কা দিয়ে ২-১ গোলের জয় তুলে নেয় তারা। কোচ হার্ভে রেনার্দের দারুণ ট্যাকটিকসের কাছে আটকে যায় লিওনেল মেসি-দি মারিয়ারা। তবে দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়ার ভালো সম্ভাবনা তৈরি করেও শেষ পর্যন্ত কাজে লাগাতে পারেনি সৌদিরা। ডি গ্রুপে ইউরোপের আরেক শক্তিশালী দেশ ডেনমার্ককে নিজেদের প্রথম ম্যাচে রুখে দিয়ে নজর কাড়ে তিউনিসিয়া। শেষ ম্যাচে গতবারের চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকেও হারায় আফ্রিকার দলটি। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাদের, অস্ট্রেলিয়ার কাছে পিছিয়ে পড়ে নকআউট রাউন্ডে যেতে পারেনি তারা। এই গ্রুপ থেকে এশিয়ার প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া অস্ট্রেলিয়া দুই জয় নিয়ে রানার্সআপ হয়। তিউনিসিয়াকে হারানোর পাশাপাশি ডেনমার্ককেও ১-০ গোলে পরাজিত করে তারা।

তবে রূপকথার মতো রং পাল্টানো গ্রুপ ছিল জাপান, স্পেন, জার্মানি, কোস্টারিকার। দুই ইউরোপিয়ান পরাশক্তি স্পেন ও জার্মানিকে হারিয়ে অন্য রকম এক গ্রুপ জার্নি পার করে জাপান। পিছিয়ে পড়েও দুটি ম্যাচেই অসাধারণ লড়াকু মানসিকতা দিয়ে শেষ পর্যন্ত জয় ছিনিয়ে আনে সামুরাইয়ের দেশটি। কোচ হাজিমে মরিয়াসু মুগ্ধ করেন তাঁর ট্যাকটিক্যাল প্রজ্ঞা দিয়ে। একক কোনো খেলোয়াড়ের ওপর ভরসা করে নয়, বরং দলগত ফুটবল খেলে গেছে দলটি। তাদের কারণে এই গ্রুপ থেকে বাদ পড়ে জার্মানি। নিজেদের প্রথম ম্যাচে ৭-০ গোলের জয় নিয়েও গ্রুপ রানার্সআপ হয় স্পেন। গ্রুপের শেষ ম্যাচ দুটি এতই উত্তেজনার ছিল যে ৯০ মিনিটের কোনো না কোনো সময় গ্রুপের প্রতিটি দলেরই শেষ ১৬ খেলার সুযোগ তৈরি হয়েছিল, এমনকি তৈরি হয়েছিল স্পেন-জার্মানি দুটি দলেরই বাদ পড়ার আশঙ্কাও!

এফ গ্রুপের ফেবারিট বেলজিয়ামকে হারিয়ে শোরগোল ফেলে দেওয়া দলটির নাম মরক্কো। উত্তর আফ্রিকার দেশটি যেন এবার নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার পণ নিয়ে এসেছিল। ক্রোয়েশিয়া, বেলজিয়ামের মতো শক্তিশালী ফুটবল খেলুড়ে দুই দেশকে পেছনে ফেলে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয় তারা। গোলের খেলা ফুটবলে আক্রমণকে প্রতিহত করার অনবদ্য এক প্রদর্শনীর আয়োজন করে মরক্কো। মাত্র তিন মাস আগে দায়িত্ব নেওয়া কোচ ওয়ালিদ রেগরাগুই দলটির সেরা পারফরম্যান্স বের করে আনতে মনোযোগ দেন ডিফেন্সিভ ফুটবলে। রোমান সাইস, আমরাবাত, আশরাফ হাকিমিরা একদিকে প্রতিপক্ষকে আটকে দেন, অন্যদিকে হাকিম জিয়েখ, এন নাসরিরা দ্রুতগতির কাউন্টার অ্যাটাকে গোল করার নিপুণ কৌশল রপ্ত করেন। এতে কাজও হয়! গ্রুপ পর্বের পর শেষ ষোলোতে স্পেন ও কোয়ার্টার ফাইনালে পর্তুগালের মতো শিরোপাপ্রত্যাশী দুই দলকে বিদায় করে দেয় তারা। সেমিফাইনালেও ফ্রান্সের সঙ্গে প্রায় সমানে সমান লড়াই করার চেষ্টা করে, কিন্তু বেশ কটি সুযোগ কাজে লাগাতে না পারায় শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপে চতুর্থ হয়ে থাকতে হয়। প্রথম আফ্রিকান দল হিসেবে তাদের এ জ্বলজ্বলে কীর্তিকে দীর্ঘদিন স্মরণ করবে ফুটবল–ভক্তরা।

বিশ্বকাপের ফেবারিট হিসেবে এসেছিল আরেক লাতিন পরাশক্তি ব্রাজিল। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে তাদের ১-০ গোলে হারিয়ে চমক উপহার দেয় আফ্রিকার আরেক দেশ ক্যামেরুন। পরের রাউন্ডে না উঠতে পারলেও বিশ্বকাপ থেকে একেবারে খালি হাতে ফেরেনি তারাও।

ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের তারকা ফুটবলার সন হিউং-মিনের দক্ষিণ কোরিয়া একেবারে শেষ মুহূর্তে পর্তুগালকে হারিয়ে জায়গা করে নেয় নকআউট পর্বে। বাদ পড়ে সুয়ারেজ-কাভানির উরুগুয়ে ও আরেক আফ্রিকান পরাশক্তি ঘানা। প্রাণবন্ত ফুটবল খেলেছে তারাও। একের পর এক আক্রমণে প্রতিপক্ষকে ব্যতিব্যস্ত রাখলেও শেষ পর্যন্ত ভাগ্য সহায় হয়নি তাদের। দক্ষিণ কোরিয়ারও বিশ্বকাপ–যাত্রা থেমে যায় শেষ ষোলোর ম্যাচে ব্রাজিলের কাছে হেরে।

ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ের নিচের দলগুলো এবার ভালো করলেও ওপরের দলগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভুলে যাওয়ার মতো ফুটবল খেলেছে। তারকাখচিত দল নিয়েও গ্রুপ রাউন্ড পার করতে পারেনি জার্মানি ও বেলজিয়াম। অথচ বিশ্বকাপ শুরুর আগে দল দুটির ভালো করার সম্ভাবনা নিয়ে কারও মনে তেমন সন্দেহ ছিল না। স্পেন নকআউট রাউন্ডে উঠলেও পার করতে পারেনি মরক্কোর বাধা। সুন্দর ফুটবলের পসরা নিয়ে আসা স্প্যানিশরা প্রথম ম্যাচের পর থেকেই অনেকটা নিষ্প্রভ হতে শুরু করে। পাসিং ও পজেশনকে মন্ত্র করে ফুটবল খেলা দলটি গোল করতে ব্যর্থ হয়েছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। তাই ভাগ্যও খুব বেশি সঙ্গ দেয়নি তাদের।

কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নেওয়া ব্রাজিল, নেদারল্যান্ডস, ইংল্যান্ড ও পর্তুগালের সবাই এবারের বিশ্বকাপের অন্যতম ফেবারিটই ছিল বলা চলে। কিন্তু অটল ক্রোয়েশিয়া, জাদুবাস্তবতার আর্জেন্টিনা, আত্মবিশ্বাসী ফ্রান্স ও দুর্গম মরক্কো বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাদের সামনে। কেউই পার করতে পারেনি তা। নেইমার, ফন ডাইক, হ্যারি কেইন, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে তাই বিদায় নিতে হয়েছে চোখের জলে। শিরোপা থেকে মাত্র দুই ম্যাচ দূরত্বে বিদায় নেওয়ার কষ্ট মেনে নেওয়া যে ভীষণ কঠিন!

এমবাপ্পে নাকি লিওনেল মেসি—ফাইনালের এমন এক সমীকরণ রোমাঞ্চিত করতে থাকে কোটি কোটি ফুটবল দর্শককে। ৩-৩–এর সমতায় শেষ হওয়া সেই ফাইনালে কী ছিল না! প্রায় হেসেখেলে শিরোপার কাছাকাছি চলে যাওয়া আর্জেন্টিনাকে এমবাপ্পে বুঝিয়েছেন কেন তিনি আগামী দিনের সেরা। ৯০ মিনিটে জোড়া গোল করে হারতে বসা ফ্রান্সকে অতিরিক্ত সময়ে নিয়ে যান তিনি। সেখানে আবারও মেসির গোলে এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। নিজের হ্যাটট্রিক পূরণ করে ফাইনালকে টাইব্রেকারে টেনে নিয়ে যাওয়ার কারিগর প্যারিসের ছেলে এমবাপ্পেই।

শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপের স্বর্ণখচিত ট্রফি দ্বিতীয়বার স্পর্শ করার সুযোগ না মিললেও পেয়েছেন গোল্ডেন বুটের সম্মান। এক আসরে ৮ গোল করে ব্রাজিলের কিংবদন্তি রোনালদোর পাশে নাম লিখিয়েছেন ২৪ বছর বয়সী এই তারকা। ফাইনালে জোড়া গোল করে প্রায় সমানে সমান ছিলেন লিওনেল মেসিও! ফুটবল কিংবদন্তি মেসির ক্যারিয়ারে এই একটি মাত্র ট্রফিরই শূন্যস্থান ছিল। বহু আকাঙ্ক্ষিত এই ট্রফি তাঁকে নিয়ে গেল সর্বকালের সর্বসেরাদের ছোট্ট ব্র্যাকেটে। প্রায় ১৬ বছর ধরে চলতে থাকা এক গল্প যেন অবশেষে পূর্ণ হলো!