ক্রিকেটার থেকে আম্পায়ার হলেন যে বাংলাদেশি

বাংলাদেশের আম্পায়ার শরফুদ্দৌলা ইবনে শহীদ
প্রথম আলো

এবারের আইসিসি ওয়ানডে ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপে প্রথম বাংলাদেশের একজন আম্পায়ার আম্পায়ারিং করছেন। তিনি শরফুদ্দৌলা ইবনে শহীদ, বাসার সবাই ও বন্ধুরা যাকে সৈকত বলে ডাকেন।

বিশ্ব-ক্রিকেটকে নিয়ন্ত্রণ করে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল। সংক্ষেপে আইসিসি। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আয়োজন করে আইসিসি। ২০২৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর আইসিসি বিশ্বকাপের আম্পায়ারদের তালিকা ঘোষণা করে। এ তালিকায় শরফুদ্দৌলার নাম শুধু তাঁকে ও তাঁর শুভানুধ্যায়ীদের আনন্দিত করেনি, সারা বাংলাদেশে নিয়ে এসেছে খুশির বন্যা। কারণ, এই প্রথম বাংলাদেশের কোনো আম্পায়ার পুরুষ ক্রিকেট বিশ্বকাপে আম্পায়ারিং করতে যাচ্ছেন।

সৈকত যখন খেলোয়াড় ছিলেন

ছোটবেলায় খেলতে ভীষণ ভালোবাসতেন সৈকত। বাবার চাকরির সুবাদে সৈকতের বেড়ে ওঠা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। বাসার সামনে বিশাল মাঠ, যাকে ক্যাম্পাসের সবাই বলত—লর্ডসের ময়দান। সেখানে কাঠের ব্যাট দিয়ে ক্রিকেট, ডাল ঘুঁটনি দিয়ে হকি, আর বাঁকানো কাঠ দিয়ে চলত বেসবল খেলা। সকাল থেকে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা, তারপরও খেলা আর খেলা।

সময়ের সঙ্গে মন দিলেন ক্রিকেটে। খেলায় অনেক বড় ভাই আর বয়সী খেলোয়াড়। তাঁদের বল করতে হবে। সৈকত দেখলেন, জোরে বল করার চেয়ে ঘুরিয়ে বল করলে তাঁরা সহজে খেলতে পারেন না। বাঁ হাঁতে জোর বেশি বলে ঘুরিয়ে বল করতে করতে একদিন বাঁহাতি স্পিনারে পরিণত হলেন সৈকত। সঙ্গে ব্যাটও চালাতে পারেন ভালো। তাই একদিন রাজশাহী ইউনিভার্সিটি স্কুলের ক্যাপ্টেন হয়ে দলকে রাজশাহী জেলার চ্যাম্পিয়ন টিমে পরিণত করল সৈকত। এরপর খেলা নিয়ে চলে এলেন ঢাকায়। স্কুল চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও সৈকতের বোলিং নজর কাড়ল সবার। খেলার কারণে সেবার স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়া হলো না। ফিরে এলেন রাজশাহীতে। খেলার কারণে স্কুলে বিশেষ বিবেচনায় ক্লাস এইট থেকে নাইনে ওঠার সময় অটো প্রমোশন পেলেন।

রাকিবুল হাসানের আশ্রয়ে

১৯৮৯ সালে যুব এশিয়া কাপ বসেছিল ঢাকায়। সৌরভ গাঙ্গুলী, অজয় জাদেজা, আতাপাত্তুদের সামনে বোলিং করার সুযোগ এসেছিল সৈকতের সামনে। বয়স বিবেচনায় সেবার যুব দলে খেলার সুযোগ পাননি। ঠিকই নজরে পড়ে গেলেন পাকিস্তান ক্রিকেট টিমের প্রথম বাঙালি ক্রিকেটার রাকিবুল হাসানের।

স্কুলে পড়া শেষ করার আগেই সৈকতের ঢাকায় খেলার ডাক এসেছিল। কিন্তু ঢাকায় থাকবেন কোথায়? রাকিবুল হাসান রাজশাহীতে গিয়ে বললেন, ‘তুমি আমার বাসায় থেকে ক্রিকেট খেলবে।’ শুরু হলো সৈকতের সংগ্রাম—ঢাকায় গিয়ে খেলা। মায়ের উপদেশ, খেলার সঙ্গে যেন পড়ালেখাটাও সমানতালে চলে। ৭০০–এর বেশি মার্কস পেয়ে সৈকত ভর্তি হলেন রাজশাহী বিভাগের সেরা কলেজ রাজশাহী কলেজে। সেখান থেকে পড়ার সুযোগ পেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে। সে সময় একই সঙ্গে চালিয়ে গেছেন ক্রিকেট ও পড়ালেখা। প্রথমে যোগ দিলেন ওরিয়েন্ট ক্লাবে, তারপর ভিক্টোরিয়া হয়ে সূর্যতরুণ। সৈকতের দাদাবাড়ি কিশোরগঞ্জে আর নানাবাড়ি ময়মনসিংহে। তাই জিএমসিসিতে ক্রিকেট খেলেছেন দীর্ঘদিন। জিএমসিসি মানে হচ্ছে গ্রেটার ময়মনসিংহ ক্রিকেট ক্লাব।

জাতীয় দলে

প্রথম আলো

১৯৯৪ সালে জাতীয় দলে ডাক পান সৈকত। আইসিসি ট্রফি খেলতে যেতে হবে সুদূর কেনিয়ায়। সেবার বাংলাদেশের সুযোগ ছিল ১৯৯৬-এর ক্রিকেট বিশ্বকাপে খেলার। কিন্তু দ্বিতীয় রাউন্ডে প্রথমে হল্যান্ড ও পরে কেনিয়ার কাছে হেরে বাংলাদেশ আর বিশ্বকাপ খেলতে পারেনি; সেই সঙ্গে বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্নও হারিয়ে যায় সৈকতের। যদিও সেবার তিন ম্যাচ খেলে ৬ উইকেট পেয়েছিলেন সৈকত।

করপোরেট জীবনে

চোটের কারণে বেশি দিন খেলা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষ করে সৈকত কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। এখানেও ক্রিকেটের ভূমিকা আছে। ২০০৪ সালে করপোরেট ক্রিকেট লীগে নাম লিখিয়েছিল এখনকার মোবাইল কোম্পানি রবি। সে সময় অবশ্য কোম্পানিটির নাম ছিল অ্যাকটেল। অ্যাকটেলের খেলোয়াড় হিসেবে সৈকত কেবল খেলার মাঠে কর্মকর্তাদের মুগ্ধ করেননি, মাঠের বাইরেও মেধার কারণে তাঁকে প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

বিসিবি ও আম্পায়ারিং

বিশ্বকাপে আম্পায়ারিং প্যানেলে আছেন বাংলাদেশের শরফুদ্দৌলা ইবনে শহীদ
ছবি: প্রথম আলো

পরে সৈকত বিসিবিতে ক্রিকেট অপারেশন্সে যোগ দেন। সবকিছুর মধ্যেও তিনি আম্পায়ারিং চালিয়ে যান। প্রথম শ্রেণির আম্পায়ার হিসেবে যাত্রা শুরু করেন ২০০৭ সালে। ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আম্পায়ারিংয়ের সুযোগ পান। শুরুটা হয় বাংলাদেশ বনাম শ্রীলঙ্কার এক দিনের ম্যাচ দিয়ে।

২০১১ সালে বাংলাদেশ বনাম পাকিস্তানের ম্যাচ দিয়ে তিনি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচ পরিচালনা করেন। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজের টেস্ট ম্যাচে আম্পায়ারিংয়ের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক টেস্ট ম্যাচ পরিচালনা শুরু করেন।

পুরুষ দলের আগে সৈকত নারী বিশ্বকাপে আম্পায়ারিং করেছেন। বাংলাদেশের আর কোনো আম্পায়ারের এই রেকর্ড নেই। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ বনাম আয়ারল্যান্ডের তৃতীয় টি-টোয়েন্টিতে আম্পায়ারিংয়ের মাধ্যমে তিনি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে শততম আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ পরিচালনা করছেন।

সৈকত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেছেন। পাশাপাশি দুটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্কেটিং ও এইচআরএমে এমবিএ করেছেন। আম্পায়ার সৈকতের লক্ষ্য আম্পায়ারিংয়ে সততা বজায় রাখা। আর এই সততাই বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের একজন আম্পায়ারকে তুলে ধরেছে।