অদম্য অ্যালিসা হিলি

বিশ্বকাপ ফাইনাল। প্রতিপক্ষ চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইংল্যান্ড। টুর্নামেন্টজুড়েই ফর্মে ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার দুই ওপেনার অ্যালিসা হিলি ও র‌্যাচেল হেইন্স। কিন্তু ঝুঁকি নেননি দুজনের কেউই। ইংল্যান্ডের বোলিং আক্রমণ সম্পর্কে ভালোই ধারণা আছে দুই ব্যাটারের। ২০ ওভার শেষে একসময় অস্ট্রেলিয়ার রান ছিল মাত্র ৯২। অনেকে ভেবেছিলেন, অন্য সব ম্যাচের মতো এ ম্যাচেও হয়তো রানটা ২৫০-২৭৫-এ গিয়ে থামবে। কিন্তু অ্যালিসা হিলি ফাইনাল খেলতে নেমেছিলেন নিজের মতো করে। মঞ্চটা তৈরিই ছিল, বাকি ছিল শুধু গল্প রচনা। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে সেটাই লিখলেন তিনি।

এর আগে মেয়েদের বিশ্বকাপ ফাইনাল শতক দেখেছিল মাত্র একটি। ২০০৫ সালে ভারতের বিপক্ষে ১০৭ রানে অপরাজিত ছিলেন অস্ট্রেলিয়ারই ক্যারেন রোল্টন। অ্যালিসা সে রেকর্ড তুচ্ছ করেছেন অনায়াসেই। ৪৪তম ওভারে এসে ছেলেদের রেকর্ডও ভাঙলেন তিনি। ২০০৭ বিশ্বকাপ ফাইনালে ১০৪ বলে ১৪৯ রানের অবিশ্বাস্য এক ইনিংস খেলেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। সেই রেকর্ড অনায়াসে টপকে গেলেন স্বদেশি উইকেটকিপার ব্যাটার অ্যালিসা হিলি। নারী-পুরুষ মিলিয়ে তিনি এখন বিশ্বকাপ ফাইনালে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডধারী ক্রিকেটার। একসময় মনে হচ্ছিল, প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে বিশ্বকাপ ফাইনালে দ্বিশতকের রেকর্ড ছোঁয়াও সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু অ্যালিসার স্বপ্নযাত্রা থামে ১৭০ রানে। অসাধারণ এ ইনিংসে ছিল ২৬টি বাউন্ডারি। অ্যালিসার ব্যাটে ভর করে ৫ উইকেটে ৩৫৬ রানের বিশাল স্কোর তোলে অস্ট্রেলিয়া। অ্যালিসা যখন মাথা উঁচু করে ড্রেসিংরুমে ফিরছেন, ততক্ষণে ক্রিকেটের রানি তকমাটা তাঁর গায়ে লেগে গেছে পাকাপাকিভাবে। বিশাল সেই রান তাড়া করতে পারেনি ইংল্যান্ড। থেমে গেছে ২৮৫ রানেই। ম্যাচসেরা তো হয়েছেনই, অ্যালিসা জিতে নিয়েছেন টুর্নামেন্ট–সেরার পুরস্কারটাও।

অথচ ছোটবেলায় ক্রিকেটে আগ্রহই ছিল না হিলির। বাবা ছিলেন কুইন্সল্যান্ডের ক্রিকেটার। চাচা ইয়ান হিলি অস্ট্রেলিয়া দলের সর্বকালের অন্যতম সেরা উইকেটরক্ষক। সাত বছর পর্যন্ত ফুটবলেই বেশি আগ্রহ ছিল অ্যালিসা হিলির। পরিবর্তনটা আসে কুইন্সল্যান্ড থেকে সিডনিতে আসার পর। সিডনিতে এসে ক্রিকেটের দিকে ঝুঁকে পড়েন অ্যালিসা। বাবা গ্রেগ হিলিও আর দেরি করেননি, ভর্তি করিয়ে দেন ক্রিকেট একাডেমিতে। আর সেখানেই অ্যালিসার সঙ্গে পরিচয় মিচেল স্টার্কের।

পরিচয়পর্বটা অবশ্য খুব একটা সুখকর ছিল না। নর্দান ডিস্ট্রিক্টের যুব দলে উইকেটরক্ষক ছিলেন মাত্র দুজন। অ্যালিসা হিলি আর মিচেল স্টার্ক। মাঠে একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার লড়াই ছিল দুজনের মধ্যেই। যদিও কিছুদিন পরই উইকেটকিপিং ছেড়ে বোলিংয়ে মনোযোগ দেন স্টার্ক। আর উইকেটকিপিং জায়গাটা একান্তই নিজস্ব হয়ে যায় অ্যালিসা হিলির। সেই থেকে শুরু।

বেকারস কলেজ দলে অ্যালিসা (পেছনের সারিতে দাঁড়ানো)

অ্যালিসার বয়স তখন ১২। জীবনে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা আসে তখনই। অনুশীলন শেষে নিজের মতো করে সময় কাটাচ্ছিলেন বাসায়। হঠাৎ ফোন পেয়ে তাঁকে একা রেখেই বেরিয়ে যান মা। সেদিন রাতে তাঁকে নিতে আসেন তাঁরই এক বান্ধবীর মা। অ্যালিসা নিজেও সে সময় ভেবেছিলেন, এটাই হয়তো তাঁর জীবনের সেরা রাত। কারণ, এর আগে সচরাচর বাড়ির বাইরে থাকা হতো না তাঁর। বান্ধবীর বাসায় ভালোই সময় কাটছিল অ্যালিসার। পরদিন সকালে জানতে পারলেন, নিজের প্রিয় বড় বোন কারিন কোমায়। এক সপ্তাহ পর অ্যাকাডেমির একটি ম্যাচে দারুণ খেললেন অ্যালিসা। ম্যাচ শেষে শুনলেন শহরের আরেক প্রান্তে তাঁর বাবা খুলে রেখেছিলেন কারিনের লাইফ সাপোর্ট। সেদিন থেকে অ্যালিসার জীবনে ক্রিকেট শুধুই কষ্ট ভুলে থাকার গল্প।

অ্যালিসা সবার নজরে আসেন ১৬ বছর বয়সে। তবে সেটা পারফরম্যান্সের জন্য নয়, বরং নিজের জন্য। একদিন সকালে উঠে দেখেন, বাসার সামনে উঠানভর্তি সাংবাদিক। ঘটনা তেমন কিছুই নয়, আগের দিন বেকারস কলেজ একাদশে উইকেটকিপিং করেছেন অ্যালিসা। স্কুল পর্যায়ের পুরো টুর্নামেন্টে একমাত্র মেয়ে তিনি। এর আগেও তো খেলেছেন ছেলেদের সঙ্গে, তখন তো এমন সাংবাদিকদের ভিড় হয়নি।

ঘটনা ঘটিয়েছিল তাঁর বিপক্ষ দলে থাকা এক খেলোয়াড়। অ্যালিসার ছবিসহ খবরটা সংবাদপত্রে পাঠিয়েছিল সে। সঙ্গে ছিল বেকারস কলেজ ক্রিকেটকে রক্ষা করার আহ্বান। ১৬ বছর বয়সী অ্যালিসা হিলিকে সেদিন সাংবাদিকদের রোষানল পেরিয়ে যেতে হয়েছিল স্কুলে। তখন তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন চাচা ইয়ান হিলি। বলেছিলেন, স্কুল পর্যায়ের ক্রিকেটে যোগ্যতা থাকলে সবারই খেলার সুযোগ পাওয়া উচিত।

এর পর থেকেই আমূল পরিবর্তন আসে অ্যালিসার খেলায়। ১৭ বছর বয়সেই ডাক পান নিউ সাউথ ওয়েলস মূল দলে। সে সময় উইকেটের পেছনে ছিলেন লিওনি কোলম্যান। যে কারণে দলে স্পেশালিস্ট ব্যাটার হিসেবেই সুযোগ মিলত অ্যালিসার। যতটুকু সুযোগ পেতেন, সেটুকুতেই চেষ্টা করতেন ঝলক দেখানোর। আর সেই ঝলকের ফলাফল হিসেবে মিলল অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ওপেনিং করার সুযোগ।

সেখানেই অ্যালিসা বুঝিয়ে দিলেন, কেন তাঁকে ডাকা হয়েছিল ছেলেদের সঙ্গে খেলতে। ১৯ বছর বয়সে ডাক পেয়েছিলেন অনূর্ধ্ব-২৩ দলে খেলার। সেখানেও তাঁকে খেলতে হয়েছে স্পেশালিস্ট ব্যাটার হিসেবেই। কিন্তু নিজের আগমনের জানান দিচ্ছিলেন ঠিকই। এরই মধ্যেই উইকেটরক্ষকের গ্লাভস তুলে রাখেন লিওনি, প্রথমবারের মতো উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলার সুযোগ পান পেশাদার পর্যায়ে। আর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ডাক আসে জাতীয় দলে। ২০১০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি মাত্র ২০ বছর বয়সে অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দলের জার্সি ওঠে অ্যালিসার গায়ে।

কিন্তু লিগের অ্যালিসা আর জাতীয় দলের অ্যালিসার মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। লিগে যেখানে রানের ফোয়ারা ছুটিয়েছেন, সেখানে জাতীয় দলে ৩৭ ইনিংসে অর্ধশতক মাত্র ১টি। খালি চোখে দেখে মনে হবে, জাতীয় দলের জার্সিতে নিষ্প্রভ অ্যালিসা, কিন্তু তা নয়। লিগে নিয়মিত টপ অর্ডারে ব্যাটিং করতেন। জাতীয় দলে তাঁর জায়গা ছিল ৬-৭ নম্বরে। বেশির ভাগ সময়ই তাঁকে জুটি বাঁধতে হতো বোলারদের সঙ্গে। এর ফলে অ্যালিসার রানের চাকাটাও থামত ওই জায়গাতেই।

২০১৭ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে তেমনই একটা পরিস্থিতিতে মাঠে নামতে হয়েছিল অ্যালিসাকে। চালিয়ে খেলতে গিয়ে উল্টো ম্যাচটাই খুইয়ে আসেন তিনি। এরপরই তাঁর জীবনে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন নিয়ে আসেন কোচ ম্যাথু মট। বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়ার পর হিলিকে নিয়ে একান্তে বসেন কোচ। আর তখনই প্রস্তাব দেন, এখন থেকে অ্যালিসাকে ওপেনিংয়ে চান তিনি।

বিশ্বকাপের ট্রফি দিয়েই ভর্তি হয়ে যাবে অ্যালিসা-র্স্টাকের ড্রইংরুম

অ্যালিসা নিজেও সন্দিহান ছিলেন নিজের এমন ভূমিকা নিয়ে। টপ অর্ডারে নিয়মিত খেলেছেন বটে, কিন্তু একজন ওপেনারের স্কিল আর সক্ষমতার সঙ্গে একজন লোয়ার অর্ডার হার্ড হিটারের সক্ষমতার আকাশ-পাতাল পার্থক্য। সে সময়েই এগিয়ে এলেন মিচেল স্টার্ক। স্ত্রী অ্যালিসাকে নিয়ে গেলেন বন্ধু অ্যাশ স্কোয়ারের কাছে। তাঁর কাছেই নিজের প্রিয় সুইপ শটকে আরও শাণিত করেন অ্যালিসা। আর সেদিন থেকেই পুনর্জন্ম হয় অ্যালিসা হিলির। যে পুনর্জন্মের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত হাতে হাত ধরে ছিলেন মিচেল স্টার্ক।

স্টার্ক অবশ্য হিলির হাত ধরে আছেন অনেক দিন ধরেই। নর্দান ডিস্ট্রিক্টের উইকেটকিপিং নিয়ে ঝগড়া, সেখান থেকে একসঙ্গে পথচলা। ছয় বছর একই জায়গা নিয়ে ঝগড়া করেছেন, লড়াই করেছেন। ঝগড়াটা কখন ভালোবাসায় রূপ নিয়েছে, সেটা হয়তো বুঝে উঠতে পারেননি। দুজনের পথ আলাদা হয়ে গেলেও মনের টান কমেনি। তাই তো ১৪ বছরের পরিচয় শেষে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে যখন হিলির হাত ধরার প্রস্তাব দিয়েছিলেন স্টার্ক, তখন ‘না’ বলার কোনো কারণই খুঁজে পাননি অ্যালিসা।

স্টার্ক তখন উঠতি তারকা, মিচেল জনসনের সঙ্গে দলে থাকার জন্য প্রতিযোগিতা। ওদিকে নারী দলে অ্যালিসার জায়গাটাও খুব একটা স্থায়ী নয়। কিন্তু কেউই হাল ছাড়েননি, দুজনে হাতে হাত রেখে চলার যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তাই মেনে চলেছেন আজীবন। ঝড়-ঝঞ্ঝা সবই এসেছে, কিন্তু হাল না ছাড়ার ব্যাপারে দুজনই ছিলেন অনড়।

কোচ ম্যাথু মট যে ভুল ছিলেন না, তার প্রমাণ মিলেছে পরের বছরের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। ২০১৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজে অনুষ্ঠিত সেই বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন অ্যালিসা। ৫ ইনিংসে ৫৬ গড়ে করেছিলেন ২২৫ রান, ছিল ২টি অর্ধশতক!

পরের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও অ্যালিসা ছিলেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। ৬ ইনিংসে ৪০ গড়ে তাঁর রান ছিল ২৩৬। এর মধ্যে ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে খেলেছিলেন ম্যাচ জেতানো ৭৫ রানের ইনিংস। তাঁর থেকে বেশি রান করতে পেরেছিলেন তাঁরই সতীর্থ বেথ মুনি।

আর এবারের বিশ্বকাপের কথা তো না বললেই নয়। ৯ ইনিংসে ৫৬ গড়ে করেছেন ৫০৯ রান। চারটি অর্ধশতকের সঙ্গে দুটি শতক। শতক দুটিও এসেছে বড় ম্যাচে—সেমিফাইনাল আর ফাইনালে। ক্রিকেট ইতিহাসে সেমিফাইনাল আর ফাইনাল—দুটিতেই শতকের রেকর্ড করতে পারেননি কেউই।

অভিষেকের পর থেকে ২০১৭ বিশ্বকাপ পর্যন্ত এক দিনের ক্রিকেটে যেখানে তাঁর ব্যাটিং গড় ছিল ১৮.৭২; ওপেনিংয়ে আসার পর তা হয়েছে ৫২.৬০। আর টি-টোয়েন্টিতে ১৭.৫৩ গড়কে তুলে এনেছেন ৩২-এ, যার মধ্যে রয়েছে ১৪৮ রানের একটি অপরাজিত ইনিংস! এটাকে পুনর্জন্ম বলা ছাড়া আর কোনো বিশেষণে বাঁধা যায়, তোমরাই বলো?

বিশ্বজয়ের পর স্টার্ক-অ্যালিসা

আজ স্টার্কের নামের পাশে দুটি বিশ্বকাপ, বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের তকমা। অ্যালিসার নামের পাশে ফাইনালে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। সঙ্গে পাঁচ-পাঁচটি বিশ্বকাপ। ভালোবাসার মানুষের হাত পাশে থাকলে কী করা যায়, তারই উৎকৃষ্ট প্রমাণ হয়তো হিলি-স্টার্ক।

ফাইনালে ১৩৮ বলে ১৭০ রান করে যখন মাথা উঁচু করে মাঠ ছাড়ছিলেন অ্যালিসা, তখন মিচেল স্টার্কের হাসিই বলে দিচ্ছিল, ভালোবাসার মানুষটার জন্য ঠিক কতটা খুশি তিনি। আইপিএলে নাম লেখাননি, পাকিস্তান সিরিজ ছেড়ে মাঝপথে চলে এসেছেন—নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে অজেয় হতে দেখতে। স্টার্ককে নিরাশ করেননি অ্যালিসা, বিশ্বকাপের ট্রফি নিয়েই ফিরেছেন বাড়িতে।