আলো ছড়ানো গল্পগুলো অলিম্পিকের

১৩ বছর বয়সে কী করছিলে?

আমি যা করেছিলাম, সেটা পাতে তোলার মতো নয়। সে বছর ক্রিকেট বা ফুটবল, কোনো কিছুর বিশ্বকাপ ছিল না, ছিল না অলিম্পিকও। ফলে বেশ ভাব নিয়ে ‘খেলা দেখছিলাম’, এটা বলারও সুযোগ নেই। তাই সর্বোচ্চ যা করেছি, ঘরে ‘মকরুহ’ বলে বিবেচিত তিন গোয়েন্দা বা হুমায়ূন আহমেদের বইয়ে সময় কাটছিল। লুকিয়েটুকিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমরেশের বইও কয়েকটা পড়া হচ্ছিল।

সে ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ আপাতত দূরে থাকুক। এখন একটু ককোনা হিরাকির নামটা জানা যাক। হিরাকির বয়স এখন ১৩। এই তো ২৬ আগস্ট ঘটা করে জন্মদিন পালন হলো তার।

ককোনা হিরাকির

এক মাস আগে জাপানি এই কিশোরী কম বিখ্যাত ছিল, এটা বলা যাবে না। তবে সেটা নির্দিষ্ট একটা গণ্ডিতে। কিন্তু টোকিও অলিম্পিক সব বদলে দিয়েছে। পাঁচ বছর বয়স থেকে স্কেটবোর্ড নিয়ে পড়ে থাকাটা যে অলিম্পিকে রুপার পদকে পরিণত করেছে সে। মায়ের স্কেটবোর্ড নিয়ে তুমুল আগ্রহ দেখে এ খেলায় মাতা হিরাকি যেদিন অলিম্পিক মাতাল, সেদিন তার বয়স গুনে গুনে ১২ বছর ৩৪৩ দিন! জাপানের ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ অলিম্পিক পদকজয়ী এখন হিরাকি।

মমিজি নিশিয়ার বয়সও কিন্তু ১৩-এর ঘরে। তার কীর্তি আরও বড়। এই কিশোরীও স্কেটবোর্ডার। তবে পার্ক নয়, স্ট্রিট স্কেটবোর্ডার সে। জাপানের হয়ে সর্বকনিষ্ঠ মেডেল বিজয়ীর রেকর্ডটা হিরাকি কেড়ে নিয়েছে এক সপ্তাহ পর। নিশিয়া অন্তত একটি রেকর্ড নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। ১৩ বছর ৩৩০ দিন বয়সে সোনা জেতা নিশিয়া জাপানের সর্বকনিষ্ঠ সোনা বিজয়ী। অলিম্পিক ইতিহাসেই তার চেয়ে কম বয়সে সোনা জিতেছে মাত্র একজন (সে গল্প আরেক দিন হবে।)

স্কাই ব্রাউন

স্কেটবোর্ড থেকেই টোকিও অলিম্পিকের সর্বকনিষ্ঠ আরও দুই পদকজয়ীর দেখা মিলেছে। হিরাকির ইভেন্টে ব্রোঞ্জ জিতেছে স্কাই ব্রাউন। ব্রিটেনের ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ পদকজয়ী অবশ্য বহু আগে থেকেই বিখ্যাত। বিখ্যাত ব্রেন্ড নাইকির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর সে। রাইসা লিলও কম বিখ্যাত নয়। ৭ বছর বয়সে রাজকুমারী সেজে স্কেটবোর্ডিং করে নজরে পড়ে গিয়েছিল স্কেটবোর্ডের একমেবাদ্বিতীয়ম টনি হকের। স্ট্রিট স্কেটবোর্ডিংয়ে টোকিওতে নিশিয়ার সঙ্গে পেরে ওঠেনি, কিন্তু ১৩ বছর ২০৪ দিন বয়সে ব্রাজিলের হয়ে সর্বকনিষ্ঠ পদকজয়ীর রেকর্ড তো অন্তত ‘ফাদিনিয়ার’ই।

১৩–এর ঘরে আটকানো যাচ্ছে না, তাই বলে হংচেন কুয়ানের কথা বলতে নিশ্চয় বাধা নেই! টোকিও অলিম্পিকে ১৪ বছর বয়সী চীনের কিশোরী যা করেছে, তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। ১০ মিটার ডাইভিংয়ের ফাইনালে নিজের দ্বিতীয় ও চতুর্থ ডাইভে সাতজন বিচারককে ১০-এ ১০ দিতে বাধ্য করেছে সে। এমনই দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে আগের অলিম্পিক রেকর্ড দুমড়েমুচড়ে গেছে। কৃষক পরিবারে বেড়ে ওঠা কুয়ান ডাইভিং শুরু করেছিল ৭ বছর বয়সে। সাত বছরের ব্যবধানে অলিম্পিকের সোনা এনে দিয়ে পরিবারের আত্মত্যাগের পুরস্কার এনে দিয়েছে কুয়ান।

হংচেন কুয়ান

হেন্দ জাজা কোনো পদক পায়নি, আত্মত্যাগের পুরস্কার অন্তত টোকিওতে বুঝে নিতে পারেনি সে। কিন্তু জাজার গল্পটা হয়তো এদের সবার চেয়ে দুর্দান্ত। নিশিয়া বা কুয়ানরা প্রতিদিন রাতে ঘুমাতে যায় পরদিন কী করবে, সেটা জেনে। আগামীকাল কতটুকু অনুশীলন করবে, কতটা বিশ্রাম নিতে হবে, নতুন কোনো কৌশল শেখা দরকার কি না—কোচদের সঙ্গে সে আলোচনা চলে। জাজার ঘুম ভাঙে গোলাগুলির শব্দে। সে তিতকুটে স্বাদ ভুলতে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করে টেবিল টেনিসে। কিন্তু সার্ভ করার মুহূর্তেই হয়তো হাত থেকে পিংপং বল পড়ে যায় বিস্ফোরণের ধাক্কায়। অদূরে কোথাও হয়তো আবার গোলাগুলি হচ্ছে, ধারেকাছেই শেষ আর্তনাদ তুলছে কেউ।

মমিজি নিশিয়া

গৃহযুদ্ধ গত ১০ বছরে ৫ লাখ মানুষের প্রাণ নিয়েছে। মাত্র দুই বছর বয়স থেকেই গোলাগুলির শব্দ জাজার নিত্যসঙ্গী। এর মধ্যেই বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া, ফার্মাসিস্ট বা আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন দেখা। সেই সঙ্গে টেবিল টেনিসে অলিম্পিক পদক জেতার স্বপ্ন তো আছেই। অনুশীলনের ভালো ব্যবস্থা নেই, উন্নতমানের কোনো টেবিল নেই—এমন এক পরিস্থিতিতে অনুশীলন করেও মাত্র ১১ বছর বয়সে সরাসরি অলিম্পিকে চলে আসা জাজার গল্পটা তাই আরও বেশি প্রেরণা দেয়।

অলিম্পিক মানেই তো প্রেরণার গল্প। সাঁতার মানেই এতদিন ছিল মাইকেল ফেলপেস। এবার তাঁরই দেশের ড্রেসেল জিতেছেন ৫টি স্বর্ণ। বোল্টের সম্পত্তি হয়ে ওঠা ১০০ মিটার স্প্রিন্টে এবার রুপা বিজয়ী যুক্তরাষ্ট্রের ফ্রেড কারলি। আর সোনা বিজয়ী? কারলির মুখেই শুনুন, ‘আমি ওর ব্যাপারে আসলেই কিছু জানি না।’ জীবনে কখনো কোনো প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হননি মার্চেল ইয়াকবস। ২০২১ সালের আগে কখনো ১০ সেকেন্ডের নিচে দৌড় শেষ করতে পারেননি। টোকিওতে হিটে ক্যারিয়ারসেরা সময় গড়ে সেমিতে সেটা টপকে গেলেন ৯.৮৪ সেকেন্ডে। তবু প্রথম দুজনের মধ্যে ছিলেন না। শুধু টাইমিংয়ের কারণে ফাইনালে জায়গা পেয়েছিলেন। তাঁর নাম না জানায় তাই কারলির দোষ নেই।

ইয়াকবস ফাইনালে নিজের ক্যারিয়ার সেরা দৌড়টাই দিলেন। ৯.৮০ সেকেন্ড। ব্যস, এটুকু সময়ই দরকার হলো বিশ্বকে স্তব্ধ করে দিতে। অ্যাথলেটিকসের সবচেয়ে গৌরবময় ইভেন্টের রাজা ফাইনালে প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছেই অপরিচিত এক মুখ।

হেন্দ জাজা

ইয়াকবসের সে পাগলাটে মুহূর্তকে পূর্ণতা দিয়েছেন জিয়ানমার্কো তাম্বেরি। ইয়াকবস তখনো জয়ের আনন্দে পুরো ভাসেননি। তাঁর আগেই ট্র্যাকে থাকা তাম্বেরি এসে জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে। নিজের গায়ে থাকা ইতালির পতাকাটা জড়িয়ে দিলেন ইয়াকবসের গায়ে।

একটু আগেই তাম্বেরি আনন্দাশ্রু ঢেলেছেন ট্র্যাকে। পাগলের মতো গড়াগড়ি খেয়েছেন, কী করবেন বুঝতে না পেরে এদিক-ওদিক দৌড়ে বেড়িয়েছেন। ইয়াকবস দৌড়ে ১০০ মিটারের দাগটা পেরিয়ে এসে পড়েছেন ওই তাম্বেরির কাছে। ইভেন্ট হিসেবে ১০০ মিটার বড়, না হলে তাম্বেরিকেই অভিবাদন জানানোর কথা ইয়াকবসের।

কালেব ড্রেসেল

২০১৬ রিও অলিম্পিকের আগে ক্যারিয়ার সেরা ফর্ম ছিল তাম্বেরির। লং জাম্পে ইতালিয়ান রেকর্ড ভেঙে ফেলার একটু পরই গোড়ালির টেন্ডনে চিড় ধরে তাঁর। অলিম্পিকের ৬ সপ্তাহ আগে সে দুর্ঘটনা তার রিও যাত্রা আটকায়নি। কিন্তু তাম্বেরি ছিলেন গ্যালারিতে। পায়ে প্লাস্টার বেঁধে অন্যদের অংশ নিতে দেখেছেন, আর প্রতিজ্ঞা করেছেন ২০২০ অলিম্পিকে ফিরবেনই। সে প্লাস্টারে এবারও নিয়ে এসেছেন তাম্বেরি। নিজেকে প্রেরণা দেওয়ার জন্য, কতটা কঠিন পথ পাড়ি দিয়েছেন সেটা মনে রাখার জন্য।

মার্চেল ইয়াকবস

মুতাজ ইসা বারশিম তেমন কিছু বয়ে আনেননি। কিন্তু লং জাম্পে সম্ভাব্য সবকিছু জেতা এই কাতারি অ্যাথলেট কোনোভাবে অলিম্পিকের সোনা জেতা হচ্ছিল না। ২০১৮ সালে বিশ্ব রেকর্ড ভাঙার একদম কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন। সে রেকর্ড ভাঙার জন্য দেওয়া লাফ তাঁর গোড়ালির টেন্ডনেও চিড় ধরায়।

চোটের বিরুদ্ধে লড়াইটা দুজনের একই ছিল, ফাইনালে দুজনে এগিয়েছেন একই ভঙ্গিতে। একবারও কোনো ভুল না করে ২.৩৭ মিটার পেরিয়েছেন দুজন। এ অবস্থায় একজন বিজয়ী নির্ধারণ করার জন্য ‘জাম্প অফ’ করতে বলা হয়। সেটা ফুটবলের সাডেন ডেথের মতো। নির্দিষ্ট একটি উচ্চতায় দুজন লাফ দেবেন, যিনি পারবেন না, তিনি জিতবেন রুপা। অন্যজন চূড়ান্ত বিজয়ী। দুজনই এতে রাজি হতে পারতেন। তাম্বেরির ২.৩৯ মিটার লাফানোর রেকর্ড আছে, বারশিম তো সর্বকালের দ্বিতীয় সেরা ২.৪৩ মিটারও পেরিয়েছেন আগে।

বারশিম ও তাম্বেরি

বারশিম সে পথে হাঁটেননি। অফিশিয়ালদের জিজ্ঞেস করেছেন, দুজনকেই সোনা দেওয়া যায় কি না। ফেবারিট হয়েও বারশিমের এমন প্রস্তাব দেখে কিছুক্ষণ বাক্‌রুদ্ধ থাকা তাম্বেরির প্রতিদ্বন্দ্বীর কোলে চড়ার দৃশ্যটা এই অলিম্পিকেরই সেরা।

অলিম্পিকের জন্মই তো এমন কিছু গল্পের জন্য!