ইউরোর যত রেকর্ড

ফুটবল বিশ্ব কাঁপছে ইউরো জ্বরে, ইউরোপ মহাদেশের বিশ্বকাপখ্যাত এই প্রতিযোগিতায় দলগুলোর লড়াই চলছে সেয়ানে সেয়ানে। কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলতে রাজি নয়! এর মধ্যেই ঘটে চলেছে গুরুত্বপূর্ণ সব রেকর্ড ভাঙার দৌড়। একনজরে দেখে নেওয়া যাক এবারের ইউরোতে তৈরি হওয়া নতুন রেকর্ডগুলো।

সর্বোচ্চ দূরত্বের গোল

গ্রুপ ডির প্রথম রাউন্ডের খেলায় নিজেদের মাঠে চেক প্রজাতন্ত্রের মুখোমুখি হয়েছিল স্কটল্যান্ড। ম্যাচের বয়স তখন ৫১ মিনিট, অতিথি চেক তখন ১-০ গোলে এগিয়ে রয়েছে। মুহুর্মুহু আক্রমণ করে সমতাসূচক গোল খুঁজতে মরিয়া স্কটিশরা। প্রতিপক্ষের ওপর চাপ বাড়াতে স্কটল্যান্ডের রক্ষণভাগ তখন বেশ ওপরে উঠে এসেছে, সেই সঙ্গে তাদের গোলকিপারও অনেকটা সুইপার কিপারের দায়িত্ব পালন করতে ডি-বক্সের বাইরে এসে দাঁড়ান। এমনই এক আক্রমণের সময় স্কটিশ খেলোয়াড়ের শট চেক প্রজাতন্ত্রের খেলোয়াড়ের গায়ে ব্লক হয়, বল চলে আসে ফাঁকায় দাঁড়িয়ে থাকা চেক স্ট্রাইকার প্যাট্রিক শিকের আয়ত্তে। বুদ্ধিদীপ্ত শিক খেয়াল করেছিলেন স্কটিশ গোলকিপারের ডি-বক্সের বাইরে এসে পজিশন নেওয়াটা। তাই ঠিক মধ্যমাঠের রেখায় বল পেয়েই দ্রুতগতিতে দৌড়ে ঠিক মাঝমাঠ থেকে নেন বাঁ পায়ের বাঁকানো শট। ওদিকে গোলপোস্ট ছেড়ে ওপরে উঠে আসা স্কটিশ গোলকিপার মার্শাল ততক্ষণে বিপদের গন্ধ পেয়ে উল্টো দৌড়ে ছুটতে শুরু করেছেন। কিন্তু শিকের চাতুর্যপূর্ণ শটটি যেন ফিজিকসের সূত্রে অঙ্ক কষে বের করা নিখুঁত এক ফল। তাই গোলকিপারের গতি, বাতাসের বাঁক, গোলপোস্টের উচ্চতা—সবকিছুকে পরাস্ত করে বল জড়াল জালে। বিস্ময়কর এক গোল! এমন গোল ইতিহাস না ভাঙলে যেন অন্যায় হতো। তাই হিসাব কষে দেখা গেল, ৪৯.৭ মিটার দূর থেকে করা প্যাট্রিক শিকের গোলটি ইউরোর ইতিহাসে সর্বোচ্চ দূরত্বের গোলের তালিকায় প্রথম। বলাই বাহুল্য, একটি ফুটবল মাঠের সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য হতে পারে ১১০ মিটার, অর্থাৎ প্রায় মাঝমাঠ থেকেই করা হয়েছে গোলটি।

সর্বোচ্চ গোল ও ম্যাচ খেলার রেকর্ড

ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো এবারের ইউরোতে এসেছিলেন টুর্নামেন্টের যৌথ সর্বোচ্চ গোলদাতা হিসেবে। ফ্রান্সের কিংবদন্তি মিশেল প্লাতিনির সঙ্গে ভাগাভাগি করছিলেন গৌরবের মুকুট। দুজনেরই ছিল ৯ গোল। গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচেই মুকুট নিজের করে নেন ক্রিস্টিয়ানো। হাঙ্গেরির বিপক্ষে পেনাল্টি থেকে করেন টুর্নামেন্টে নিজের দশম গোল। সেই ম্যাচে আরও একটি গোল করে পাদপ্রদীপের সব আলো নিয়ে নেন নিজের ওপরে। গোল করেছেন পরের ম্যাচে জার্মানির বিপক্ষেও, দুর্দান্ত এক কাউন্টার অ্যাটাক গোল করতে তাঁকে দৌড়াতে হয়েছে প্রায় পুরো মাঠ। ৩৬ বছর বয়স যেন তাঁর জন্য নিছক সংখ্যাই! ফ্রান্সের বিপক্ষেও জোড়া গোল করে, এটি লেখার মুহূর্ত পর্যন্ত এবারের ইউরোর সর্বোচ্চ গোলদাতা পর্তুগালের ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো।

২০০৪ ইউরোতে অভিষেকেই করেছিলেন ২ গোল, ১ গোল করেছিলেন ২০০৮–এ, ২০১২ ও ২০১৬–তে করেন ৩টি করে গোল, এবারের টুর্নামেন্টে এখন পর্যন্ত করেছেন ৫ গোল—মোট ১৪ গোল করে ইউরোর ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা হিসেবে অনেকটাই ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছেন তিনি।

ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো

শুধু যে গোলদাতা হিসেবেই রেকর্ড ভেঙেছেন তা নয়, ইউরোর সর্বোচ্চসংখ্যক ম্যাচ খেলার রেকর্ডও তাঁর। বর্তমান আসরের গ্রুপ পর্ব পর্যন্ত খেলেছেন ২৪ ম্যাচ, এর মধ্যে রোনালদো গোল করেছেন ১০টিতেই! এতগুলো ম্যাচে গোল করার রেকর্ড আর কারও নেই। এমনকি ইউরোর পাঁচটি টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়া একমাত্র ফুটবলারও তিনি।

কেবল ইউরোর গ্রুপ পর্ব শেষ হলো, অদম্য ক্রিস্টিয়ানো সামনে নতুন সব রেকর্ড গড়লেও তাই অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

ফিরে দেখা

ইউরোর ইতিহাসে দ্রুততম গোলটি করেন দিমিত্রি কেরেচেঙ্কো, ম্যাচের মাত্র ৬৭ সেকেন্ডের সময় প্রতিপক্ষ গ্রিসের রক্ষণভাগের ভুলে বল পেয়ে যান রাশিয়ান স্ট্রাইকার কেরেচেঙ্কো। সামনে থাকা গোলকিপারকে পরাস্ত করতে কেবল ডান পায়ের টোকায় বল জালে জড়ান। ২০০৪ সালে করা রেকর্ডটি এখনো কেউ ভাঙতে পারেনি।

ইউরোর ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সে গোল করার রেকর্ডটিও ২০০৪ সালে, ফ্রান্সের বিপক্ষে সুইজারল্যান্ডের টিনেজার ইয়োহান ভলানথেন গড়েন রেকর্ডটি। ডান পায়ের গড়ানো শটে ফ্রান্সের তারকা গোলকিপার ফ্যাবিয়ান বার্থেজকে বোকা বানিয়ে করা গোলটির সময় ভলানথেনের বয়স ছিল ১৮ বছর ১৪১ দিন। যদিও ম্যাচটিতে জিদানের ফ্রান্সের কাছে ৩-১ গোলে হেরেছিল ভলানথেনের সুইজারল্যান্ড।

অন্যদিকে ইউরোর বয়স্কতম ফুটবলার হিসেবে গোল করেছিলেন ইভিকা ভাস্তিচ। ২০০৮-এর ইউরোতে অস্ট্রিয়ার এই মিডফিল্ডার পোল্যান্ডের বিপক্ষে দলের একমাত্র গোলটি করেন ৩৮ বছর ২৫৭ দিন বয়সে।

ইউরোর ইতিহাসে একক নৈপুণ্যে আলো কেড়ে নেওয়া ফুটবলার ছিলেন মিশেল প্লাতিনি। ১৯৮৪-এর আসরে ফ্রান্সের এই কিংবদন্তি করেছিলেন ৯ গোল! এক আসরে তাঁর চেয়ে বেশি গোল করতে পারেননি আর কেউ। মাত্র ৫ ম্যাচে খেলে, প্রতি ম্যাচেই গোল করে এই অনন্য রেকর্ড গড়েছিলেন তিনি। সেবারের রেকর্ড–যাত্রায় বেলজিয়াম ও যুগোস্লাভিয়ার বিপক্ষে করেছিলেন দুটি হ্যাটট্রিক, এক আসরে একাধিক হ্যাটট্রিকের রেকর্ডও কেবল তাঁরই। এমনকি যুগোস্লাভিয়ার বিপক্ষে বাঁ পায়ে, ডান পায়ে এবং হেডে গোল দিয়ে পারফেক্ট হ্যাটট্রিক করেন মাত্র ১৮ মিনিটে, যেটি ইউরোর ইতিহাসে দ্রুততম হ্যাটট্রিকেরও রেকর্ড। ইউরোর বয়স্কতম খেলোয়াড় হিসেবে হ্যাটট্রিক করার কৃতিত্বও তাঁর। সেবার প্লাতিনির জাদুতেই ইউরো জিতেছিল ফ্রান্স। এমন একক নৈপুণ্যের অর্জন ইউরোর ইতিহাসে আর কারও নেই।

মিশেল প্লাতিনি

দলগত অর্জন

জার্মানি ও স্পেন—ইউরোর সফলতম দুটি দল। দুই দলেরই রয়েছে তিনটি করে শিরোপা। এর মধ্যে স্পেনের অর্জনটি সবার চেয়ে আলাদা। একমাত্র দল হিসেবে পরপর দুই আসরের (২০০৮, ২০১২) শিরোপা জেতে তারা। জাভি-ইনিয়েস্তাদের সেই স্বর্ণালি স্পেনকে অবশ্য ইউরোর ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ দল হিসেবেও তকমা দেন অনেক ফুটবল বোদ্ধা। ওই দুই আসরের স্পেনকে যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা অবশ্য এর দ্বিমত করবেন না।

প্লাতিনির ফ্রান্স ১৯৮৪ সালে টুর্নামেন্টে ১৪ গোল করেছিল, যেটা এখন পর্যন্ত ইউরোতে কোনো দলের সর্বোচ্চ গোল। একই আসরে যুগোস্লাভিয়া ১০ গোল হজম করে ইউরোর ইতিহাসে গ্রুপ পর্বে সর্বোচ্চ গোল খাওয়ার লজ্জাজনক রেকর্ডে নাম লেখায়।

ইউরোর বাছাইপর্ব ও মূল পর্ব মিলিয়ে একটানা সবচেয়ে বেশি ম্যাচ জয়ের রেকর্ড জার্মানির। ২০১০-১২ সালের মধ্যে তারা একটানা ১৪টি ম্যাচ জিতেছিল। জার্মানির ওই রেকর্ডকে চোখ রাঙানি দিচ্ছে এবারের আসরে দুর্দান্ত খেলতে থাকা ইতালি ও বেলজিয়াম। ২০১৯–এর বাছাইপর্ব থেকে বর্তমান আসরের গ্রুপ রাউন্ড পর্যন্ত ১৩টি করে ম্যাচ জিতেছে দুই দলই। তাদের কেউ সেমিফাইনালে পৌঁছাতে পারলে ভেঙে যাবে জার্মানির রেকর্ড।

ইউরোর আরও কিছু রেকর্ড

বাছাইপর্ব ও মূল পর্ব মিলিয়ে সর্বাধিক গোল : ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো (পর্তুগাল), ৪৫ গোল

বাছাইপর্ব ও মূল পর্ব মিলিয়ে সর্বাধিক ম্যাচ খেলেছেন: ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো (পর্তুগাল), ৫৯ ম্যাচ

ইউরোর কনিষ্ঠতম খেলোয়াড়: বর্তমান আসরে অভিষেক হওয়া ক্যাসপার কোজয়োভস্কি (পোল্যান্ড), ১৭ বছর ২৪৬ দিন

ইউরোর বয়স্কতম খেলোয়াড়: ২০১৬ আসরে খেলা হাঙ্গেরির গোলকিপার গ্যাবর কিরালি, ৪০ বছর ৮৬ দিন

সবচেয়ে বেশিবার টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছে: জার্মানি/পশ্চিম জার্মানি

সবচেয়ে বেশি ম্যাচ জিতেছে: জার্মানি/পশ্চিম জার্মানি, ৫২টি

এক আসরে এক দল থেকে সর্বোচ্চ আলাদা আলাদা গোলদাতা: জার্মানি, ২০১২ সালের আসরে তাদের ৮ জন খেলোয়াড় গোল করেছিলেন

সবচেয়ে বেশি ক্লিনশিট: ইকার ক্যাসিয়াস (স্পেন), ৯টি

(কিশোর আলোর জুলাই ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত)